রসরাজ

তিনি রসরাজ। তাঁর নামে বাঙালির মুখে হাসি ধরে না। ডাকনামেই পেয়েছিলেন খ্যাতি। তিনি হলেন অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ প্রয়াণদিবসে তাঁকে স্মরণ করেছেন ড. শঙ্কর ঘোষ

Must read

কথামুখ
নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী তাঁর ছেলেবেলায় লেখাপড়া শুরু করেছিলেন মাস্টারমশাই জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। একসময় ঢাকা নবাব এস্টেটের সদর মোক্তার ছিলেন জিতেন্দ্রনাথ। স্ত্রী সুনীতি দেবী ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ চট্টরাজের মেয়ে। যোগেন্দ্রনাথই প্রথম ব্রিটিশ রাজশক্তির অন্ধকূপ হত্যা মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করেন। এমন বাবা আর মায়ের ছেলে সাম্যময়। মাত্র ১২ বছর বয়সে ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হন। হেমচন্দ্র ঘোষ ও মেজর সত্য গুপ্তের তৈরি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের (বি ভি) সদস্য হন। এই গুপ্ত সমিতির দলে তিনি হয়ে ওঠেন বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের পার্শ্বচর। ১৯৪১ সালে তাঁর নামে ওয়ারেন্ট বেরোয়। ১৯৪০ সালে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরই ১৯৪১ সালের ১৪ অক্টোবর তাঁকে ঢাকা ছাড়তে হয়। কলকাতায় পালিয়ে এসে কেন্দ্রীয় সরকারের আয়রন অ্যান্ড স্টিল কন্ট্রোলে কেরানির চাকরি শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে গায়িকা নীলিমা মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন। ১৯৫৬ সালের জানুয়ারিতে চাকরি ছেড়ে দেন।

আরও পড়ুন-সাড়ে ছ’টাকার কম দাম পেলে ক্ষতিপূরণ, আলুচাষিদের পাশে রাজ্য সরকার

অভিনয় জীবনের শুরু
তিনি যখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র তখন ঢাকার ওয়াড়ি ক্লাবের উদ্যোগে হওয়া ‘বনবীর’ নাটকে উদয় সিংহের চরিত্রে অভিনয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। পাড়ার নাটক ‘চন্দ্রগুপ্ত’তে চাণক্যের চরিত্র অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। সাহিত্যিক হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এই নাটকে চন্দ্রগুপ্তের ভূমিকায় অভিনয় করেন। অপেশাদারি থিয়েটারে আরও অভিনয় করেছেন। তাঁর নিজেরই উত্তর-সারথি নামে একটা নাট্যদল খুলে ‘নতুন ইহুদি’ নাটক মঞ্চস্থ করেন। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে প্রথম অভিনয় জগতে নিয়ে আসেন তিনি। ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে চাণক্য চরিত্রে তাঁর অভিনয় দেখে ডক্টর ভুজঙ্গ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে নিয়ে যান প্রমথেশ বড়ুয়ার সহকারী বিভূতি চক্রবর্তীর কাছে। বিভূতি চক্রবর্তী তখন নিজে ‘জাগরণ’ নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করছিলেন। ওই ছবি থেকেই সাম্যময় নাম বদলে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নামে পরিচিত হন তিনি।
কৌতুকাভিনয় প্রতিষ্ঠা

আরও পড়ুন-সিগনাল পার করে গাড়িতে ধাক্কা ট্রেনের

এরপর দেখা গেল তিনি কৌতুক অভিনেতা হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে উঠেছেন। এ ব্যাপারে শিল্পীর স্বীকারোক্তি, ‘‘ছোটবেলা থেকেই কৌতুক অভিনয়ের মধ্যে আমি আনন্দ পেতাম। প্রফেসর সত্যেন বসুর জন্মদিনে আমি গেলে উনি আমাকে বিভিন্ন কৌতুক নকশা করতে বলতেন। তারপর অভিনয়কেই যখন পেশা হিসেবে নিলাম তখন দেখলাম আমার কৌতুক অভিনয়টাই widely accepted হয়েছে।” ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উঠলেই দর্শকদের মনে পড়ে যায় সাড়ে চুয়াত্তর, ভানু পেল লটারি, যমালয়ে জীবন্ত মানুষ, মিস প্রিয়ংবদা, ভ্রান্তিবিলাস, আশিতে আসিও না, বরযাত্রী, ওরা থাকে ওধারে, পাশের বাড়ি, জয় মা কালী বোর্ডিং, মৃতের মর্ত্যে আগমন ইত্যাদি ছবির কথা। প্রত্যেকটি দমফাটা হাসির ছবি। আর সব ছবিতেই তাঁর অভিনয় স্মরণীয়।

আরও পড়ুন-অস্ত্র জোগালে পরিণতি ভাল হবে না

সংলাপ উচ্চারণ
শুধু অভিনয় নয়, মুখের সংলাপ পর্যন্ত দর্শকদের মনে গেঁথে রয়েছে। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে কেদারবেশী ভানু নায়িকা রমলার (সুচিত্রা সেন) মাকে (পদ্মা দেবী) বলছেন ‘‘মাসিমা মালপোয়া খামু।” এ এক বিখ্যাত সংলাপ। আরেক ছবি ‘মিস প্রিয়ংবদা’। নায়িকা লিলি চক্রবর্তী। নায়িকার মামা পতিতপাবনের (হরিধন মুখোপাধ্যায়) দেখাশোনা করার জন্য এলেন নারীরূপী ভানু মিস প্রিয়ংবদা। অনবদ্য অভিনয়, অনাবিল হাসির ভাণ্ডার। যমালয়ে জীবন্ত মানুষ ছবিতে ভানু বন্দোপাধ্যায় স্বর্গের অপ্সরাদের যখন নাচ শেখাচ্ছেন ‘হামহাম গুড়ি গুড়ি ডান্স’। এই সব নানা দৃশ্যে দর্শক ফেটে পড়েন হাসিতে। ‘চৌরঙ্গী’ ছবিতে তিনি ন্যাটাহরি। স্মরণী চরিত্র। ‘স্ত্রী’ ছবিতে জমিদার মাধব দত্তের (উত্তমকুমার) তোষামোদকারী চাটুজ্যেরূপী ভানুর সংলাপে দর্শক হেসে খুন।

আরও পড়ুন-৫৬ লাখ বাড়িতে নলবাহিত পানীয় জল

ভানু লিপের গান
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিপে অনেক গান আজও জনপ্রিয় হয়ে আছে। ‘ভানু পেল লটারি’ ছবিতে তাঁর লিপের গান— ‘‘আমার এই ছোট্ট ঝুড়ি, এতে রাম রাবণ আছে”(নেপথ্য কণ্ঠে শ্যামল মিত্র) আজও জনপ্রিয়। ‘আশিতে আসিও না’ ছবিতে যুবক ভানু যুবতী স্ত্রী রুমাকে নিয়ে গাইছেন— ‘‘তুমি আকাশ এখন যদি হতে আমি বলাকার মতো পাখা মেলতাম” (নেপথ্য কণ্ঠে মান্না দে) সারা প্রেক্ষাগৃহ তখন সরগরম। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে সব অকৃতদার বোর্ডাররা মিলে গাইছেন— ‘‘আমার এই যৌবন চম্পা চামেলি বনে” তখন কেদাররূপী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিপ মুভমেন্ট দেখার মতো। ‘দাদা ঠাকুর’ ছবিতে ‘‘ভোট দিয়ে যা”(নেপথ্য কণ্ঠে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) গানটিতে তিনি দারুণ লিপ দিয়েছিলেন।
ভানুর সিরিয়াস অভিনয়
সিরিয়াস চরিত্রেও অভিনয় করেছেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। যার মধ্যে আছে নির্মল দে পরিচালিত ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ ছবিটিতে দর্শকদের কাঁদিয়ে ছেড়েছেন। এ ছাড়াও জ্যোতির্ময় রায়ের ‘টাকা আনা পাই’, বিকাশ রায়ের ‘নতুন প্রভাত’, দিলীপ রায়ের ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ ছবিতে তাঁকে অন্যরকম ভূমিকায় দেখা গেছে। ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ তাঁর চরিত্রটি অন্ধের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে তাঁর হারানো মেয়েকে অথচ বাইরে থেকে দেখে মনে হবে লোকটা বুঝি লম্পট। তাঁর সংলাপে দর্শকরা চোখের জল ফেলেন। তবু তিনি কমেডি চরিত্রই করে গেছেন।

আরও পড়ুন-ঘুষ নিতে গিয়ে ৪০ লক্ষ সমেত গ্রেফতার, বিজেপি বিধায়ক-পুত্রের বাড়িতে রাশি-রাশি টাকা

হিন্দি ছবিতে অভিনয়
তিনি তাঁর শিল্পী জীবনে তিনটি হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন। সত্যেন বসু পরিচালিত ‘বন্দিশ’, দুলাল গুহ পরিচালিত ‘এক গাঁও কি কাহানি’, তপন সিংহ পরিচালিত ‘সাগিনা মাহাতো’।
পুরস্কার
সেই সময় মাসিক ‘উল্টোরথ’ পত্রিকার তরফ থেকে প্রতি বছর ‘উল্টোরথ পুরস্কার’ দেওয়া হত। এই সম্মাননা পুরস্কার ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত টানা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ চরিত্রাভিনেতা হিসেবে। শুধু ১৯৬০ সালে জহর রায় পেয়েছিলেন এই পুরস্কার। জনপ্রিয়তায় কোনও অংশে কম ছিল না ভানু-জহর জুটি। সুচিত্রা-উত্তম জুটির পাশে ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল বা কমল মিত্র যেমন আসর জমিয়েছিলেন, ভানু-জহরও নির্ভেজাল হাস্যরসের মাধ্যমে সেই কাজটাই চুটিয়ে করেছেন। এই দু’জনের নামের সঙ্গে মিল রেখে ছবি হয়েছিল ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’। ‘কাঞ্চনমূল্য’ ছবি তিনি প্রযোজনা করেছিলেন। এই ছবিতে তাঁর ছেলে গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মেয়ে বাসবী বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয় করেছিলেন ।

আরও পড়ুন-এই যে অধীর আপনাকে বলছি শুনুন

পেশাদারি মঞ্চ এবং অন্যান্য
পেশাদারি মঞ্চে প্রথম আসেন ১৯৫০ সালে ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ নাটকে। রঙমহলে। এই নাটকে তাঁর সঙ্গে ছিলেন ধীরাজ ভট্টাচার্য ও সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। তাঁর অভিনয় করা চরিত্রের নাম ছিল নটিলাল। স্টার থিয়েটারে তিনি পরপর অভিনয় করলেন শ্যামলী, অভয়া শ্রীকান্ত, ডাকবাংলো প্রভৃতি নাটকে সবার উপরে ছিল রঙ্গনা থিয়েটারে ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’ নাটকটি। এই নাটক সপ্তাহের পর সপ্তাহ হাউসফুল হয়েছে। বাঙাল ভাষায় তাঁর সংলাপ দর্শক ভুলবে না কখনও। এই নাটকটি ভানু যাত্রাতেও করেছেন সুশীল নাট্য কোম্পানির ব্যানারে। এছাড়াও যাত্রায় তিনি করেছেন শ্রীযুক্ত আলিবাবা, বিবাহ বিভ্রাট, যমালয়ে জীবন্ত মানুষ, গোপাল ভাঁড় যাত্রাপালাগুলি। রেডিও নাটকে একসময় নিয়মিত অংশ নিয়েছিলেন। সেই সব নাটকের মধ্যে রয়েছে অলীকবাবু, পদ্মা নদীর মাঝি, বাঘ শিকার, চোখে আঙুল দাদা, ডাকঘর প্রভৃতি। কৌতুক নকশা রেকর্ডে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় চুটিয়ে যা করে গেছেন তা নজিরবিহীন। এমন কয়েকটি রেকর্ড হল ঢাকার গাড়োয়ান, লর্ড ভানু, কর্তা বনাম গিন্নি, ঘটক সংবাদ, ইলেকশন, রাজযোটক, হরিদাস পালের গুপ্ত প্রভৃতি।

আরও পড়ুন-সূর্যর স্ট্র‍্যাটেজি সভায় বিজেপির সহসভাপতি, ফের বাম-বিজেপি আঁতাঁত এল প্রকাশ্যে

শিল্পীদের সংগঠন করা
শিল্পীদের একটি সংগঠন থাকা দরকার, এ কথা মাথায় রেখে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিকাশ রায় একদিন দ্বারস্থ হলেন ছবি বিশ্বাসের কাছে। এই সুবাদে প্রতিষ্ঠিত হল ‘অভিনেতৃ সংঘ’। গত শতকের ছয়ের দশকের শেষের দিকে উত্তমকুমার-সহ অনেক শিল্পী অভিনেতৃ সংঘ থেকে বেরিয়ে এলেন। ১৯৬৮ সালে মহানায়কের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হল ‘শিল্পী সংসদ’ নামে নতুন এক সংগঠন। স্বাভাবিকভাবেই উত্তমকুমার সভাপতি। বিকাশ রায়, সুপ্রিয়া দেবী, জহর রায়, অনিল চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায় সহ তাবড় তাবড় শিল্পী যোগ দিলেন শিল্পী সংসদে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু রয়ে গেলেন অভিনেতৃ সংঘে। আমৃত্যু এই সংঘের তিনি সভ্য ছিলেন। সেই তালিকায় রয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনুপ কুমার, দিলীপ রায়।

আরও পড়ুন-বনগাঁয় বিজেপির গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে

শেষ কথা
১৯৮৩ সালের ৪ মার্চ তিনি অনন্তলোকে পাড়ি দেন। বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের পরম সৌভাগ্য যে তখন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো একজন অভিনেতা পাওয়া গিয়েছিল। সামান্য দু-চারটি সংলাপ, একটুখানি উপস্থিতি আর তাতেই প্রেক্ষাগৃহে তোলপাড় করার ক্ষমতা তিনি রাখতেন।

Latest article