শিশুকে স্নেহের চুমু! চর্মরোগের বিপত্তি

ছোট্ট শিশুকে কে না ভালবাসে! কত সোহাগ, কত আদর, স্নেহের চুম্বনে ভরিয়ে দেয় বড়রা আর সেই ভালবাসার আবরণে লুকিয়ে থাকে তীব্র সংক্রমণের ভয়— কী করে? লিখলেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

ফুলের মতো নরম গাল,
মায়ায় ভরা কচি খেয়াল—
তাকে দেখে, হৃদয় ডাকে,
চুমু খেতে ইচ্ছে জাগে। শিশুকে চুমু খাওয়া একটি স্বাভাবিক ভালবাসার প্রকাশ। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, এমনকী অপরিচিত লোকেরাও অনেক সময় শিশুদের গালে বা কপালে চুমু খেয়ে স্নেহ প্রদর্শন করেন। কিন্তু এই চুমুই কখনও কখনও মারাত্মক চর্মরোগ বা ভাইরাল সংক্রমণের কারণ হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে যখন শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকে। চলুন দেখে নিই—চুমুর মাধ্যমে কীভাবে রোগ ছড়ায়, লক্ষণ, ঝুঁকি ও তার প্রতিরোধ ও চিকিৎসার উপায়।
চুমুর মাধ্যমে ছড়াতে পারে এমন প্রধান চর্মরোগ
হার্পিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস (এইচএসভি ১)
এটি এক ধরনের ভাইরাস যা ঠোঁটের ফোসকার (কোল্ড সোর) কারণ। সাধারণত মুখে, ঠোঁটে বা নাকের আশপাশে ফোসকা সৃষ্টি করে।
ইম্পেটিগো
এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ। ছোট ছোট ফোসকা বা পুঁজযুক্ত ঘা দেখা যায়, যা কিনা ছোঁয়াচে। ফুলের মতো শিশুর জন্য অত্যন্ত মারাত্মক!

আরও পড়ুন-ধর্ষণ নিয়ে নোংরা রাজনীতি করছে বিজেপি, স্পষ্ট অভিযোগ শশী পাঁজার

রিংওয়ার্ম বা দাদ (টিনিয়া করপোরিস)
এটি সাধারণত ছত্রাক (fungus) দ্বারা সৃষ্ট সংক্রমণ। যে স্থানে চুমু খাওয়া হয় সেখানেই সংক্রমণ গোলাকার লাল চাকা বা ফোসকার আকারে প্রকাশ পায়।
হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি)
যদিও এটি মূলত যৌন সংক্রমণজনিত, তবে কিছুরকম হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস শিশুর মুখমণ্ডলে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
মোলাসকাম কন্ট্যাজিওসাম
একটি ভাইরাসঘটিত ত্বকের অসুখ যা ছোট শিশুদের বেশি আক্রমণ করে। ছোট ছোট চকচকে গুটির মতো ঘা দেখা যায়।
সংক্রমণের লক্ষণ
আলতো ঠোঁটে ছোঁয়া দিই, ভালবাসায় ভরে যাই! ফুলের মতো নরম শিশুদের ঠোঁট গাল, কপাল কিংবা মুখমণ্ডলের অন্য কোনও জায়গায় ভালবাসার বশে আমরা হামেশাই অসংখ্য চুম্বন রেখা এঁকে দিই। অজান্তেই এই আনন্দ নিরানন্দ ডেকে আনে— নানারকম ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যায়। সেইসব শিশুদের ত্বকে সংক্রমণ হলে সাধারণত যে উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে সেগুলো হল— মুখে বা গালে লালচে ফোসকা, ঠোঁটে জ্বালা বা ঘা, পুঁজযুক্ত ক্ষত বা ফাটল, ঘা থেকে তরল পদার্থ নির্গত হওয়া, চুলকানি বা ব্যথা, জ্বর (বিশেষত ভাইরাস সংক্রমণে), এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই শিশুর বিরক্তিভাব বা কান্নাকাটি বৃদ্ধি।
কেন নবজাতকরা বেশি ঝুঁকিতে?
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল: জন্মের পর প্রথম কয়েক মাসে শিশুর শরীরে নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা পুরোপুরি গড়ে ওঠে না।
নাজুক ত্বক: শিশুর ত্বক অনেক বেশি সংবেদনশীল, সহজেই আঘাতপ্রাপ্ত বা সংক্রমিত হতে পারে।
সরাসরি মুখে সংস্পর্শ: চুমুর মাধ্যমে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সহজেই মুখ ও নাকের আশপাশের অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করতে পারে।
ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি ও ব্যক্তি
বাচ্চাদের আদর করার আগে যে বিষয়গুলো আমাদের খেয়াল রাখতে হবে সেগুলো হল— যাদের ঠোঁটে ফোসকা বা মুখে কোনও সংক্রমণ আছে তারা, ঠান্ডা-জ্বর বা ফ্লুতে আক্রান্ত ব্যক্তি, ফুসকুড়ি বা ত্বকের রোগে ভোগা আত্মীয়, এবং অপরিচ্ছন্ন মুখ বা হাত নিয়ে শিশুকে আদর করা থেকে তারা যেন দূরে থাকেন। নাহলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে। মনে রাখতে হবে, ঠোঁটে বা মুখে খোলা ঘা নিয়ে শিশুর মুখে চুমু খাওয়া একেবারেই উচিত কাজ নয়।

আরও পড়ুন-দুর্গাপুরে বহিরাগত নয়! কড়া নির্দেশ হাইকোর্টের

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
এই ধরনের মারাত্মক সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচার সবচেয়ে বড় উপায় হল সাবধানতা অবলম্বন করা। এই যেমন, অকারণে কাউকে চুমু খেতে না দেওয়া, জন্মের পর প্রথম ২–৩ মাসে অপরিচিত বা অল্পপরিচিত লোককে শিশুকে চুমু খেতে নিরুৎসাহিত করুন। মুখে ফোসকা, ফ্লু বা চর্মরোগ থাকলে শিশুকে চুমু না খাওয়াই শ্রেয়। নবজাতক শিশুদের ক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজনের মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে উৎসাহিত করুন। শিশুর ত্বক পরিষ্কার ও শুকনো রাখুন। শিশুদের ব্যবহার্য জিনিস (তোয়ালে, গামছা, বালিশ) আলাদা করে রাখুন। শিশুর ত্বকে নতুন দাগ বা ফোসকা দেখলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

এর পরেও চর্মরোগ দেখা দিলে করণীয়
দাগ বা ফোসকা দেখা দিলেই তাড়াতাড়ি শিশু বিশেষজ্ঞ বা চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। চুলকানির জন্য ঘরে বসে ওষুধ না দিয়ে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মলম বা ক্রিম প্রয়োগ করাই ভাল। শিশুকে পরিষ্কার ও নরম জামা-কাপড় পরান। সংক্রমণ ছড়ানো আটকাতে আক্রান্ত স্থানে শিশুকে ঘষাঘষি করতে দেবেন না। ঘরে অন্য কেউ আক্রান্ত থাকলে শিশুকে কিছুদিন আলাদা করে রাখুন।
সম্ভাব্য চিকিৎসা
চিকিৎসা নির্ভর করে রোগের ধরন ও তীব্রতার উপর। যেমন: হার্পিস ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে বেশকিছু অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ডাক্তারবাবুরা প্রেসক্রাইব করে থাকেন। আবার ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণের (ইম্পেটিগো) ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক মলম, ও এমনকী প্রয়োজনে মুখে খাওয়ার অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও ছত্রাক জাতীয় বা ফাঙ্গাল সংক্রমণের ক্ষেত্রে ফাঙ্গাল মলম রয়েছে; তবে সবকিছুই বিশেষজ্ঞ কিংবা সুচিকিৎসকের সুপরামর্শ ছাড়া একেবারেই নয়। ঘন ঘন ধোয়া ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের উচিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
জনসচেতনতা জরুরি
শিশুদের প্রতি ভালবাসা দেখানোর নানা উপায় আছে—চুমু সবসময় একমাত্র পথ নয়। বাবা-মা, অভিভাবক ও সমাজকে সচেতন হতে হবে যে নবজাতক বা শিশুদের আদরের ক্ষেত্রেও কিছু স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা আবশ্যক। গণমাধ্যম, স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকদের উদ্যোগে এই বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা ছড়ানো দরকার। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মা, শিশু ও জনস্বাস্থ্যের উপর সচেতনতা, পরিষেবা প্রদান ও পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে আশা দিদিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রসবের পর তাঁরা ‘পোস্ট ন্যাটাল ভিজিটে’র সময় মা ও শিশুর উদ্দেশ্যে যে হেল্থ টক দিয়ে থাকেন, তার ফলে তৃণমূল স্তরে ‘ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ারে’র সংজ্ঞাটাই আজ বদলে গেছে। কথায় বলে, ছোঁয়া হোক নরম এক বায়ু, ভালবাসা হোক নিরাপদ আয়ু।
ভালবাসা যেমন আবেগের অভিব্যক্তি, তেমনই তা সুরক্ষার মাধ্যমও হওয়া উচিত। শিশুকে চুমু খাওয়ার আগে আমাদের ভাবা উচিত—আমার আদর যদি তার অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা ভালবাসা নয়, অজ্ঞতার পরিচয়। শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে হলে আমাদের সচেতন হতে হবে, সতর্ক হতে হবে—কারণ একটি ছোট ভুল ভবিষ্যতে বড় বিপদের জন্ম দিতে পারে। কবির ভাষায়, চুমুতে লুকিয়ে রোগের ছায়া, না জানি কী ক্ষতি হয় তার হায়! ভালবাসা যদি নিঃস্বার্থ হয়, তবে সুরক্ষা সবার আগে রয়।

Latest article