হেঁশেলের মেয়েরাও এখন মাস্টারশেফ

সুনীতা উইলিয়ামস এখনও পৃথিবীতে ফেরেননি। তাঁর ঠিকানা মহাকাশের স্টেশন। মঞ্জুদেবীও স্টেশনে কুলির কাজ করছেন বহাল তবিয়তে। কেপটন শালিজা ধামি ওড়াচ্ছেন ভারতীয় এয়ারফোর্সের বিমান। কাজে মগ্ন আছেন চন্দ্রযানের বিজ্ঞানী ঋতু শ্রীবাস্তব। এঁরা সবাই ছক ভেঙেছেন কিন্তু মেয়েরা এখনও চেনা ছক ভাঙতে পারেননি রাঁধুনি পেশায়। অন্দরমহলের হেঁশেল থেকে মাস্টারশেফ, পথ পরিক্রমার ছবি তুলে ধরলেন বিশ্বজিৎ দাস

Must read

বাড়ির রান্নাঘরের অন্দরমহলে রাঁধুনি হিসেবে তাঁরা পটু। কিন্তু অনুষ্ঠান বাড়ি এবং বড় বড় হোটেলে ছক ভেঙে তেমন করে শেফের পেশায় আসতে পারছেন না মহিলারা। আবার আটপৌরে রান্নাঘরের অন্দরমহলে পুরুষও ঢুকতে পারছেনা স্বাভাবিক ছন্দে। তবে এমন অনেক পুরুষও আছেন তাঁরা এমন কাজের চর্চা করেন যা সমাজের চোখে ‘মেয়েলি’ বলে তকমা দেওয়া হয়েছে। রান্নার পেশা গত দুনিয়ায় তাই পুরুষদেরই রমরমা। কিন্তু বাড়ির হেঁশেলে রান্নাঘরে পুরুষদের লেগে যায় মেয়েলি কাজের তকমা। রান্না শুধু মেয়েদের কাজ একথা আজ একেবারেই ভুল। অন্যসব পেশার মতো রান্নাও একটা পেশা এবং পুরুষ দক্ষ এই পেশাতেও।
হেঁশেলের পরম্পরা
নারী-পুরুষের এই রান্নার পেশায় ঘরে বাইরের বৈচিত্র্য এবং বৈষম্য চোখে পড়ার মতো। এই বৈষম্যের পরম্পরা প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি পুরনো। মিশেলিন স্টার রেটিং ১৯২৬ সালে প্রথম শুরু হয়েছিল। আজও চলছে এই রেটিংয়ের পরম্পরা। বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষ শেফদের র্যাঙ্ক করার জন্য তারা তালিকা প্রকাশ করে। মিশেলিন স্টার-সহ বিশ্বের পনেরো জন শেফের যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে তাতে কেবল একজন মহিলা— অ্যান সোফি পিক। মিশেলিন স্টারের বাইরেও বিশ্ব জুড়ে মহিলা শেফের সংখ্যা পুরুষ শেফের তুলনায় উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য উন্নত রাজ্যে মাত্র সতেরো শতাংশ মহিলা শেফ।
আমাদের সমাজে রান্নার দায়িত্ব বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু রান্না তো কোনও নির্দিষ্ট লিঙ্গের জন্য বাধ্যতামূলক কাজ নয় বরং এটি একটি মৌলিক দক্ষতা, যা যেকোনও মানুষ শিখতে পারে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রান্নার কাজের ধারণাতেও এসেছে পরিবর্তন। এখন প্রশ্ন ওঠে, রান্না আসলে কার করা উচিত? যেকোনও মানুষ, নারী বা পুরুষ, রান্নার দক্ষতা আয়ত্ত করলে নিজের এবং পরিবারের খাদ্যচাহিদা মেটানো সহজ হয়। তাছাড়া রান্না করতে জানার মধ্যে রয়েছে আত্মনির্ভরশীলতার শিক্ষা। কারও ওপর নির্ভর না করে নিজের খাবার নিজে তৈরি করতে পারা একদিকে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে, অন্যদিকে পারিবারিক সম্পর্কেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে রান্নার কাজকে মূলত নারীদের জন্য নির্ধারিত কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
রান্নাঘরের দখলদারি
পুরুষদের ওপর সাধারণত বাইরের কাজ এবং আয়ের দায়িত্ব চাপানো হয়েছে। ফলে পরিবার ও সমাজে একটি ভ্রান্ত ধারণা গড়ে উঠেছে যে রান্না শুধু নারীদেরই কাজ। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুরুষরা রান্নার দায়িত্ব নিতে শুরু করেছেন যা পারিবারিক সমতার ভিত্তিকে শক্তিশালী করছে।

আরও পড়ুন-জঙ্গলমহলের সবুজদ্বীপে ইকো পার্ক নয়া রূপে

আধুনিক সমাজ ও পরিবর্তনশীল ভূমিকা
বর্তমানে অনেক পুরুষ রান্নাকে নিজের দক্ষতার অংশ হিসেবে দেখছেন। বিশেষত চাকরিজীবী নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে রান্নার কাজ ভাগাভাগি করা একটি সময়োপযোগী ও সুষ্ঠু সমাধান। এতে দু’জনই তাঁদের কর্মজীবন এবং পারিবারিক জীবনে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন। রান্না শিখে নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর মাধ্যমে পুরুষরা সম্পর্কের প্রতি আরও গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পারেন এবং পরিবারের প্রতিটি সদস্যই সমান মর্যাদা ও মূল্যায়ন পায়। রান্না নিয়ে সমাজের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। আধুনিক সময়ের রান্না আর শুধুই প্রয়োজনীয় নয়; এটি একটি শিল্প ও সৃজনশীলতার মাধ্যমও হয়ে উঠেছে। অনেক পুরুষ রান্না করে নিজেদের সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটান এবং রান্নায় নিজেদের দক্ষতা অর্জন করে থাকেন। পেশাদার রাঁধুনি বা শেফদের মধ্যে অনেক পুরুষই বর্তমানে সাফল্যের সঙ্গে রান্নার জগতে অবস্থান করছেন, যা প্রমাণ করে যে রান্নার কাজ শুধু নারীর জন্য সীমাবদ্ধ নয়।

আরও পড়ুন-আসানসোলে নাইট সার্ভিস বাস চালু করতে উদ্যোগী পুরনিগম

হেঁশেলের সমানাধিকার
রান্না করা কারও একক দায়িত্ব নয়, এটি একটি সম্মিলিত দায়িত্ব। নারী বা পুরুষ উভয়েরই রান্না শেখা উচিত এবং সময়-সুযোগমতো এই কাজ ভাগাভাগি করা উচিত। পারিবারিক দায়িত্ব ভাগাভাগির মাধ্যমে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সম্পর্ক উন্নত হয়। রান্না শেখার মাধ্যমে নারী ও পুরুষ উভয়েই হতে পারেন আরও দায়িত্বশীল ও আত্মনির্ভরশীল। অতএব রান্না করার কোনও বাধ্যতামূলক লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন থাকা উচিত নয়। বরং পরিবারে উভয়েরই রান্নার দায়িত্ব নেওয়া একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, যা সম্পর্ককে আরও দৃঢ় ও সমতার ভিত্তিতে গড়ে তোলে। এটা মনে করা হয় যে রান্নাঘর এবং বাড়ি নারীর কর্মক্ষেত্র এবং বাইরের জগৎ— এবং রান্নাঘর— পুরুষদের কর্মক্ষেত্র। যে কয়েকজন মহিলা হাই-এন্ড ভারতীয় রেস্তোরাঁ এবং ক্যাফেগুলির রান্নাঘরে শেফ হিসাবে আছেন তাঁদের গল্প অনুপ্রেরণার। ভারতবর্ষের বিভিন্ন পেশাগত রেস্তোরাঁয় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ শেফ পুরুষ।
মহাভারতের পুরুষ রাঁধুনি
একটা সময় ছিল একান্নবর্তী পরিবারের অনুষ্ঠানে রান্নার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতেন মা-মাসিরাই অথচ কোনও পারিশ্রমিক পেতেন না। এখন অবশ্য অনুষ্ঠান বাড়ি বা হোটেল সব জায়গাতেই রান্নার হেঁশেলে পুরুষদের প্রাধান্য। তবে এই ট্র্যাডিশন মহাভারতের যুগ থেকে চলছে। তখন সবেমাত্র পাণ্ডবদের বনবাস শেষ হয়েছে। এবার একবছরের অজ্ঞাতবাসের পালা। ঠিক হল বিরাট রাজ্যে তাঁরা অজ্ঞাতবাসে যাবেন। বিরাটের রাজসভায় ছদ্মবেশে পাঁচ পাণ্ডব প্রবেশ করলেন। যুধিষ্ঠিরের পরে এলেন ভীম। ভীম তখন গদাধারী নন, খুন্তিধারী পাচক। রাজশেখর বসু তাঁর মহাভারতে বলছেন— ‘তারপর সিংহবিক্রম ভীম এলেন, তাঁর পরিধানে কৃষ্ণ বস্ত্র, হাতে খন্তি হাতা ও কোষমুক্ত কৃষ্ণবর্ণ অসি। বিরাট সভাস্থ লোকদের জিজ্ঞাসা করলেন, সিংহের ন্যায় উন্নতস্কন্ধ অতি রূপবান কে এই যুবা? ভীম কাছে এসে বিনীতবাক্যে বললেন, মহারাজ, আমি পাচক, আমার নাম বল্লব, আমি উত্তম ব্যঞ্জন রাঁধতে পারি, পূর্বে রাজা যুধিষ্ঠির আমার প্রস্তুত স্যুপ প্রভৃতি ভোজন করতেন।’

আরও পড়ুন-তিন প্রকল্পের সূচনা করলেন এসডিও

গল্প হলেও মিথ্যে নয়
পাচক ভীম এমনভাবে রাজসভায় প্রবেশ করেছেন যা দেখে তপন সিংহের ‘গল্প হলেও সত্যি’ সিনেমার কথা মনে পড়ে যাবে। রাঁধুনি ধনঞ্জয়, বাক্স ভর্তি করে তাঁর রান্নার অস্ত্র নিয়ে বাড়িতে ঢুকছেন। রাঁধুনি ধনঞ্জয় (রবি ঘোষ) তাঁর হাতা-খুন্তির সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ে প্রায়-মহাকাব্যিক গল্প ফাঁদেন। কৈলাসের পথে চলেছেন, চারিদিকে ধু-ধু করছে বরফ। মাঝখানে কুলকুল করছে মানস সরোবর। সেখানে এক মায়ের সঙ্গে দেখা। সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। মায়ের আদেশে সরোবর থেকে ব্রহ্মকমল নিয়ে এলেন। সেই ব্রহ্মকমলের রেণু আর চমরি গাইয়ের দুধ দিয়ে মা পায়েস রান্না করে খাওয়ালেন— অপূর্ব সে অমৃতময় পায়েস। পায়েস খেয়ে ছেলে আবদার করলেন, যে হাতায় এমন পায়েস রান্না করেছেন সেই হাতাটি চাই। ছেলের আবদার কি মা ফেলতে পারেন? সেই এক কৈলাসের অন্নপূর্ণার হাতা ভেঙে এইসব হাতা-খুন্তি তৈরি। এক অনেক হয়েছে। এমন হাতা-খুন্তির অধিকারী যে, তারই তো বারযোগে রান্না করা সাজে। তপন সিংহ বাস্তবের রাঁধুনিকে মহাকাব্যে এনেছেন।
বিরাট রাজা ভীমকে দেখে খুশি হয়ে সেদিন বলেছিলেন, ‘তোমাকে আমি পাকশালার কর্মে নিযুক্ত করলাম, সেখানে যেসব পাচক আছে তুমি তাদের অধ্যক্ষ হবে।’ বিরাট রাজার পাকশালায় পাচকদের প্রধান হিসেবে তাঁর চাকরি পাকা হয়ে গেল। হেডকুক ভীম!
মঙ্গলকাব্যের শেফ ধর্মকেতু
কালকেতু-ফুল্লরার অবলম্বনে আমরা ধর্মকেতুকেও পাচক হিসেবে পেয়েছি। নিদয়ার পেটে তখন কালকেতু ন’মাসের। ধর্মকেতুকে নিদয়া বলেছে, কী তার খাবার সাধ। দীর্ঘ সে তালিকা। আমিষ-নিরামিষ দুয়ের কথাই আছে। পোড়া মীনে জামিরের রস, খই সঙ্গে মহিষের দই, মিঠা ঘোল, পাকা চালিতার ঝোল, চিঙ্গড়ির বড়া, নেউল গোধিকা পোড়া, হাঁসের ডিমের বড়া— পড়তে পড়তে মনে হয় এসব রান্না করা খুব সোজা কথা নয়। আমিষের চাইতে নিরামিষ রান্না আরও কঠিন। নিদয়া তাই নিরামিষ রান্নার নামই কেবল বলেনি, কীভাবে রান্না করতে হয় তাও বলে দিয়েছে।
আমার সাধের সীমা ইঙ্গিচা পলতা গিমা
বোয়ালি ঘাঁটিয়া কর পাক
ঘন কাঠি খর জ্বালে সান্তলিবে কটু তৈলে
দিবে তায় পলতার শাক।
পুঁই ডগি থুপি কচু ফুলবড়ি দিবে কীছু
দিবে তায় মরিচের ঝাল।

অরুচি মুখে পোয়াতি মেয়েটির টক-ঝাল খাওয়ার সাধ হয়েছে। বর ধর্মকেতু সেই সাধ পূর্ণ করেছে। মুকুন্দ লিখেছেন—
নিদয়ার সাধ হেতু ঘরে জায় ধর্মকেতু
চাহিয়া আনিল আয়োজন
আপনি রাঁধিয়া ব্যাধ নিদয়ারে দিল সাধ
বিরচিল শ্রীকবিকঙ্কণ।।

সেকালের বাংলাসাহিত্যে ধর্মকেতুর মতো রন্ধনপটু পুরুষ দ্বিতীয়টি চোখে পড়বে না। সেকালের খাই-খাই পুরুষের দলে ধর্মকেতুই কেবল আদর করে রান্নাবান্না করা পুরুষ।
আদর্শ হিন্দু হোটেল
হাজারি চক্রবর্তী বাঙালি পাচকদের এবং হোটেল মালিকদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন কারণ স্বপ্ন দেখত হাজারি নিজেও, তার হোটেলের বাইরে লেখা থাকবে, ‘হাজারি চক্রবর্তীর হিন্দু হোটেল/ রাণাঘাট/ ভদ্রলোকের সস্তায় আহার ও বিশ্রামের স্থান।’ পথে নানা কাজে বেরিয়েছে যারা, তাদের যত্ন করে খাইয়ে-দাইয়ে বিশ্রাম করার পরিসরটুকু দিতে চেয়েছিল হাজারি। এ তো কেবল তার বারযোগের রান্না কিংবা ব্যবসা নয়, এর মধ্যে মায়েদের ঘরযোগের সেবাধর্ম আর দয়াব্রত মিলেমিশে আছে। ঘর আর বার, দুয়ের সহযোগেই গড়ে উঠেছিল হাজারি ঠাকুরের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। বাঙালি পুরুষের রান্নার মাধ্যমে হোটেল ব্যবসায় তৈরি হল নতুন ইতিহাস।

আরও পড়ুন-দিঘার জগন্নাথ মন্দির মুখ্যমন্ত্রীর প্রতীক্ষায়

রান্নাঘর— মেয়েদের কমফোর্টজোন
এটা সত্য যে রান্নাঘর সত্যিই মহিলাদের কমফোর্টজোন। অন্যান্য শিল্পের মতোই রান্না করাটা একটা শিল্প হয়ে উঠেছে। আর এই শিল্পে উপেক্ষিত হচ্ছে নারীরা। তাঁদের অবমূল্যায়নও করা হচ্ছে। তবে আশার ছবি ফুটে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মাস্টারশেফ রন্ধন প্রতিযোগিতায়। যেসব দেশে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে পুরুষদের থেকে মহিলারাই বেশি জয়ী হচ্ছেন। বাণিজ্য রান্নাঘরে কাজ করা কঠিন কিন্তু একজন শেফ হিসাবে যদিও মহিলারা রান্নাঘরে অন্যদের তত্ত্বাবধান করেন, দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, উচ্চ তাপমাত্রার সংস্পর্শে থাকতে হয় এবং চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। মাস্টারশেফ হল এমন প্রতিযোগিতা সেখানে নারীরা কতটা দক্ষ তা পর্যবেক্ষণ করা হয়। এখনও পেশাদারি রান্নাঘরে মহিলা-পুরুষ ৫০-৫০ রেশিও হয়নি। তবুও আগামী দিনে ঘরের হেঁশেল থেকে পেরিয়ে বহুজাতিক সংস্থার স্মার্ট হেঁশেলে মহিলারা দখল নেবে এই আশা জাগাচ্ছে ভারত ও বিশ্ব।

Latest article