নতজানু হই ছন্দের কাছে

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে প্রবীর ঘোষ রায়ের ‘আজেবাজে পদ্য’ এবং অপূর্ব কোলের ‘ছড়ায় ছন্দে বাংলা বানান’। অনবদ্য দুটি বই। আলোকপাত করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

মাইক্রো ক্রিয়েটিভ পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে প্রবীর ঘোষ রায়ের ‘আজেবাজে পদ্য’। লেখাগুলো গভীর, অর্থবহ। সহজ সরল ভাষায় লেখা। ধরা পড়েছে সময়ের ছবি, সমাজের ছবি। বইটিতে আছে নানা রঙের ১০৮টি কবিতা। প্রকাশ ঘটেছে প্রতিবাদী সত্তার। কবি সোচ্চার হয়েছেন সমস্ত রকমের অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ভণ্ডামির বিরুদ্ধে। সাম্প্রদায়িকতার প্রতিরোধ এবং ফ্যাসিবাদের বিরোধ এই বইয়ের মূল স্পন্দন। সেইসঙ্গে জীবনের নিয়মেই জায়গা করে নিয়েছে ভালবাসার স্বর, যাপনের নানান হাসি-কান্নার হীরাপান্না বা দৈনন্দিনের হালকা রসিকতার মজা।

আরও পড়ুন-জনসংযোগ, রোড শো, পথসভা

কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েনি কবিতাগুলো। ফুটে উঠেছে স্পষ্ট উচ্চারণ। প্রতিটি শিরোনামহীন। প্রথম কবিতায় বলছেন, ‘যদিও তোমার নাগরিকত্ব নাই/ তবুও তোমার ভোটটি আমার চাই।’ এনআরসির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছে। ঝরে পড়েছে তীব্র শ্লেষ, বিদ্রুপ। প্রথম লেখা থেকেই পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। ১১ সংখ্যক কবিতায় লিখেছেন, ‘হেলে হবার ক্ষমতা নাই/ কেউটে হতে চায়।/ মাঝে-সাঝে কুঁজোটারও/ চিত হতে সাধ যায়।’ নির্ভেজাল রাজনৈতিক কবিতা। পালাবদলের দিনটি স্মরণ করায়। যদিও এর আবেদন বহুমুখী।
রাজনৈতিক কবিতার পাশাপাশি আছে জীবনবোধের কবিতা।
৩০ সংখ্যক কবিতায় লিখেছেন, ‘ক্ষত উপশম হয়,/ তবু থেকে যায় দাগ।/ অনেক সুখের স্মৃতি,/ দুঃখেও চায় ভাগ।’ চার পঙক্তির মধ্যে রয়েছে গভীর ব্যঞ্জনা। ঘটেছে অসাধারণ অনুভূতির প্রকাশ। এই অনুভূতি সর্বজনীন। মন ছুঁয়ে যায়। মনে থেকে যায়।
৯৪ সংখ্যক কবিতায় লিখেছেন, ‘এখন বৃষ্টি-দিন,/ আকাশে প্রিয়ার ছায়া ভাসে।/ এমন বৃষ্টি-দিন/ আমার জন্মদিন মনে আসে।’ প্রেম এবং মৃত্যু মিলেমিশে একাকার। কোথায় সেই প্রিয়া? তিনি বুঝি মেঘ হয়ে গেছেন? একলা তরীর গোপন অভিসার দেখে মৃত্যু বাসনা জাগে। এই মৃত্যু আসলে এক মহামিলন।
প্রায় প্রতিটি কবিতাই ছন্দবদ্ধ, নাতিদীর্ঘ। ঠিকরে বেরোচ্ছে মেধার বিচ্ছুরণ। সবমিলিয়ে কাব্যগ্রন্থটি অসাধারণ। কবির অন্যান্য বইগুলোর প্রতি আগ্রহী করে তোলে। প্রচ্ছদ রূপায়ণ শ্যামল মজুমদার। দাম ২৫০ টাকা।
দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত হয়েছে অপূর্ব কোলের বই ‘ছড়ায় ছন্দে বাংলা বানান’। সকলের জানা, যে কোনও ভাষার ক্ষেত্রেই মেরুদণ্ড হল বানান। নির্ভুল বানানের উপস্থিতি স্বচ্ছতা দান করে একটি ভাষার অবয়বকে। এটাও সত্য, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে বানানের ধারা। বাংলা বানান নিয়ে প্রচুর বই লেখা হয়েছে। সেই ধারার অন্যতম সংযোজন এই বইটি।

আরও পড়ুন-কেরলে কংগ্রেস বলছে বাম-বিজেপি ভাই-ভাই

এর বিশেষত্ব হল— গদ্যে যা বলা যায়, সেটা ছড়ার ছন্দে বলেছেন লেখক। এতে আছে তিনটি ভাগ এবং একটি পরিশিষ্ট। ‘প্রবেশ পথ’-এ আছে কথামুখ, বাংলার বর্ণমালার ইতিহাস, বিদ্যাসাগরের বর্ণমালা, ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যকরণ গ্রন্থে বাংলা বর্ণমালা, বর্ণের মাত্রা ও মাত্রাহীনতা, সহবর্ণ ও কার-চিহ্ন, ফলার কথা, যুক্ত বা সংযুক্ত ব্যঞ্জন, যুগ্ম ব্যঞ্জন, ধ্বনি পরিচয়, বাংলা শব্দ ভাণ্ডার, বাংলা ভাষার জন্ম ইতিহাস, বানান ভুল কেন হয়, বানান বিতর্ক : বানান চর্চার ইতিহাস, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত বাংলা বানান বিধি ১৯৩৬ রচনাগুলো। এছাড়াও আছে ‘ঘর’, ‘মুখপাত’, ‘বাগান : ছড়ায় ছন্দে বাংলা বানান’।
উদাহরণ দেওয়া যাক। ‘যুক্ত ও সংযুক্ত ব্যঞ্জন’-এ লেখা হয়েছে, ‘তোমরা যখন দল বেঁধে যাও ইস্কুলে কী বাজারে/ জোড়ায় জোড়ায় ফুলের শোভা মন কেড়ে নেয় বাহারে।/ ব্যঞ্জনেরাও এমনিভাবে/ হাতটি ছুঁয়ে অন্য কাঁধে/ সংযোগেরই জোড় বেঁধেছে বর্ণমালায়, আহারে।’
দেওয়া যাক আরেকটি উদাহরণ। ‘বাংলা ভাষার জন্ম ইতিহাস’-এ লেখা হয়েছে, ‘ভাষা হচ্ছে নদীর মতন কালান্তরে যাত্রা তার/ চলার পথে আপন মনে করিয়ে চলে সময় ভার/ নতুন নতুন শব্দ ধ্বনি ঋদ্ধ করে শরীর তার/ নকশি কাঁথায় উছলে ওঠে নানা মনের রং বাহার।’
উদাহরণ এইটুকুই। শুধুমাত্র বোঝানোর জন্য। এক-একটি বিষয়কে ধরা হয়েছে ছড়ায়। কে না জানে— ছড়ার ছন্দ বরাবরই পাঠককে আকৃষ্ট করে। সহজেই মনে থেকে যায়। ছড়ার পাশাপাশি ছক কেটে কিছু কিছু বিষয়কে আলাদাভাবে বোঝানো হয়েছে। আশা করি ছাত্রছাত্রীদের বিশেষভাবে কাজে লাগবে। প্রচ্ছদশিল্পী রঞ্জন দত্ত। দাম ২৫০ টাকা।

Latest article