থাইরয়েড ক্যানসার

গতকাল ছিল জাতীয় ক্যানসার সচেতনতা দিবস। সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী ক্যানসারে আক্রান্ত পুরুষদের মধ্যে প্রায় ৫.৪ শতাংশ এবং মহিলাদের মধ্যে ৬.৫ শতাংশই থাইরয়েড ক্যানসারে আক্রান্ত। যে ক্যানসারটি নিয়ে এতদিন পর্যন্ত বিশেষ দুশ্চিন্তা ছিল না বর্তমানে তার গ্রাফও ঊর্ধ্বগামী। বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে। কেন হয় থাইরয়েড ক্যানসার? লক্ষণ কী? চিকিৎসাই বা কী? জানাচ্ছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

থাইরয়েড গ্রন্থিটি একজন ব্যক্তির ঘাড়ের গোড়ায় অ্যাডামস আপেলের ঠিক নিচে থাকে, একটি ছোট প্রজাপতির মতো আকৃতির গ্রন্থি যা গলার মাঝখানে অর্থাৎ ভয়েস বক্সের নিচে এবং শ্বাসনালির(ট্রাকিয়া) চারপাশে আবৃত। এটি একটি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি। থাইরয়েড গ্রন্থি এমন একটি হরমোন তৈরি করে যা আমাদের হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ, রক্তচাপ, শরীরের ওজন এবং তাপমাত্রাকে প্রভাবিত করে।
এই থাইরয়েড গ্রন্থিতে খুব বেশি থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন হলে এই অবস্থায় শরীর খুব দ্রুত শক্তি ব্যবহার করতে শুরু করে। একে হাইপারথাইরয়েডিজম বলে। হাইপারথাইরয়েডিজমে শরীরে ক্লান্তি অনুভূত হয়। এছাড়াও হৃৎস্পন্দনের হার বেড়ে যাওয়া, ওজন নিয়ন্ত্রণে না থাকা, নার্ভাস লাগা, চুল ঝরে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়।

আরও পড়ুন-সাপের বিষ সরবরাহের মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এলভিশ যাদবকে সমন

থাইরয়েড ক্যানসার কী
থাইরয়েড গ্রন্থিতে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়াই হল থাইরয়েড ক্যানসার। থাইরয়েড গ্রন্থির কলা থেকে এই ক্যানসার বৃদ্ধি পায়। ঘাড়ের কাছে ফোলা ভাব দেখা দেয় যাকে নডিউলস বা পিণ্ড বলা হয়। প্রথম ধাপেই এটা বোঝা যায় না। ম্যালিগন্যান্সির ক্ষেত্রে এই নডিউলস পার্শ্ববর্তী লিম্ফ নোডগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে থাইরয়েডের সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের কিন্তু এই টিউমারের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। থাইরয়েড গ্রন্থির আশপাশে একটি বা একাধিক টিউমার হতে পারে। আবার দু’দিকেও টিউমার হতে পারে। গ্রন্থির পার্শ্ববর্তী লিম্ফ নোডগুলো ফুলে উঠতে পারে। তবে নডিউলের আকার বড় না হওয়া পর্যন্ত কোনও উপসর্গ দেখা দেয় না এটাই বিপদের কারণ। গত তিরিশ বছরে থাইরয়েড ক্যানসার অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি এখন মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি করে দেখা যাচ্ছে। ক্যানসারে আক্রান্ত পুরুষদের মধ্যে প্রায় ৫.৪ শতাংশ এবং মহিলাদের মধ্যে ৬.৫ শতাংশ থাইরয়েড ক্যানসারে আক্রান্ত।

আরও পড়ুন-অশান্ত ছত্তিশগড়, বিস্ফোরণে আহত এক বিএসএফ জওয়ান সহ দুই ভোটকর্মী

থাইরয়েড ক্যানসারের ধরন
প্যাপিলারি থাইরয়েড ক্যানসার : এই ক্যানসার ধীরে ধীরে বাড়ে, দ্রুত গলার লিম্ফ নোড বা লসিকাগ্রন্থিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ফলিকিউলার থাইরয়েড ক্যানসার : এই ক্যানসার লিম্ফ নোড এবং রক্তজালিকাতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
মেডুলারি ক্যানসার : এই ক্যানসার সাধারণত প্রাথমিক স্তরেই ধরা পড়ে।
অ্যানাপ্লাস্টিক ক্যানসার : এই ক্যানসার সবচেয়ে দ্রুত ছড়ায় এবং এর চিকিৎসা করাও সবচেয়ে কঠিন।
উপসর্গ
ঘাড়ের সামনে বা নিচের দিকে মাংসল শক্ত পিণ্ড বা নডিউল দেখা দিতে পারে, যা খালি হাতে অনুভব করা যায়। ব্যথাহীন হয় এবং বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে।
কণ্ঠস্বর পরিবর্তন, আওয়াজ কর্কশ হয়ে যায়। গলা সবসময় ধরে থাকে।
শ্বাস নিতে, খাবার গিলতে অসুবিধা হয়।
সারাক্ষণ খুসখুসে কাশি হতে পারে।
গলার চারপাশে ফোলাভাব, ঘাড়ের চারপাশ এবং কণ্ঠনালিতে ব্যথা হয়।
অনিয়ন্ত্রিত ওজন।
খুব ঘাম হয়।
গরম আবহাওয়া সহ্যের অক্ষমতা।
ঋতুচক্রে অনিয়ম।
থাইরয়েড ক্যানসারের কারণ
থাইরয়েড ক্যানসারের কারণ বেশিটাই অজানা।
একটি প্রধান কারণ হল অঙ্কোজেন এবং টিউমার দমনকারী জিনের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা। কারণ অঙ্কোজেন মানব দেহে ক্যানসার কোষের বৃদ্ধির জন্য দায়ী এবং টিউমার দমনকারী জিন এই বৃদ্ধি কমিয়ে দেয় বা সঠিক সময় ক্যানসার কোষের মৃত্যু ঘটানোর ফলে টিউমারের বৃদ্ধি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
অতিরিক্ত মোটা হয়ে যাওয়া।
থাইরয়েড ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস থাকলে আবার অন্য কারও হতে পারে অর্থাৎ জেনেটিক।
উচ্চমাত্রার বিকিরণের প্রভাব।
উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া পারিবারিক অ্যাডেনোমেটাস পলিপোসিস।

আরও পড়ুন-প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের বিপুল অঙ্কের প্রসঙ্গ তুলে বিরোধী দলনেতার বিরুদ্ধে দ্বিচারিতার অভিযোগ করলেন কুণাল ঘোষ

ডায়াগনোসিস
ঘাড়ের ওই অংশে একটি পিণ্ড বা ক্ষত লক্ষ্য করলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। প্রথম তিনটে স্টেজে এই ক্যানসার বোঝা যায় না কিন্তু স্টেজ ফোরে এই ক্যানসারাস টিউমারটি খুব বড় হয়ে যায়। কাছের নরম টিস্যু, স্বরযন্ত্র, শ্বাসনালি, খাদ্যনালি এমনকী রেকারেন্ট ল্যারিনজিয়াল নার্ভ পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়।
সিটি স্ক্যান বা এক্স-রে এবং আল্ট্রাসাউন্ড করলে ধরা পড়ে।
কখনও কখনও ছোট মাপের নডিউলস বা পিণ্ড দেখা দিলে চিকিৎসক অনেক সময়ই পরীক্ষা করার আগে খুব ভাল করে লক্ষ্য রাখতে বলেন। নডিউল বা পিণ্ড থেকে সুচের সাহায্যে কোষের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে মাইক্রোস্কোপের নিচে পরীক্ষা করা হয়।
চিকিৎসা
থাইরয়েড ক্যানসার ধরা পড়লে অস্ত্রোপচারই মূল চিকিৎসা৷ আক্রান্ত লিম্ফ নোডগুলি সাধারণত অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা হয় যাতে শরীর ক্যানসার কোষ থেকে মুক্তি পায়।
থাইরয়েডক্টমি
এই অপারেশনের মাধ্যমে থাইরয়েড গ্রন্থিটি সম্পূর্ণ বা আংশিক কেটে বাদ দেওয়া হয়।
থাইরয়েড লোবোক্টমি
ক্যানসার যদি প্রাথমিক অবস্থায় এবং থাইরয়েড গ্রন্থির অর্ধেক অংশ জুড়ে থাকে, তাহলে থাইরয়েড লোবোক্টমি অপারেশন করা হয়। এই অপারেশনে কেবলমাত্র অর্ধেক থাইরয়েড গ্রন্থিই বাদ দেওয়া হয়।
লিম্ফ নোড ডিসেকশন
সাধারণত লিম্ফ নোড বা লসিকাগ্রন্থির মাধ্যমেই ক্যানসার এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছড়ায়। এই কারণে, যদি আপনার চিকিৎসক যদি মনে করেন যে ক্যানসার লিম্ফ নোডে ছড়িয়েছে, তবে তিনি লিম্ফ নোড অপারেশন করে বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন, যাতে ক্যানসার আর ছড়িয়ে পড়তে না পারে।
থাইরয়েড হরমোন থেরাপি
থাইরয়েডেক্টমি অপারেশনের পর আজীবন থাইরয়েডের ওষুধ খেয়ে যেতে হয়, কারণ এই ওষুধগুলি শরীরে থাইরয়েড হরমোনের জোগান দেয়, কারণ থাইরয়েড গ্রন্থির অপারেশনের পর শরীরে তা নিজে থেকে তৈরি হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এই অপারেশনের ফলে পিটুইটারি থেকে উৎপন্ন টিএসএইচ হরমোনের উৎপাদনও নিয়ন্ত্রিত হয়, যা সাধারণত ক্যানসার কোষগুলির বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

আরও পড়ুন-ফের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে শীর্ষ আদালতের স্থগিতাদেশ

রেডিওঅ্যাকটিভ আয়োডিন
এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে বিশেষ ধরনের রেডিওঅ্যাকটিভ আয়োডিনের প্রয়োগ করা হয়। এই চিকিৎসা থায়রয়েডেক্টমি অপারেশনের পর করা হয়। এর মূল লক্ষ্য হল অবশিষ্ট থাইরয়েড টিস্যু এবং ক্যানসার কোষগুলি ধ্বংস করা, যা অপারেশনের পরও বাকি রয়ে যায়। এই রেডিওঅ্যাকটিভ আয়োডিন ট্যাবলেট এবং তরল ওষুধের আকারে দেওয়া হয়।
কেমো ও রেডিয়েশন থেরাপি
এটি ক্যানসার প্রতিরোধক সর্বাধিক প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা, যা শরীরের অভ্যন্তরে অতি দ্রুতহারে বাড়তে থাকা ক্যানসার সেল বা কোষগুলির বৃদ্ধি রোধ করতে সহায়তা করে এবং তাদের নির্মূল করে। যদিও কেমোথেরাপির বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। এই চিকিৎসা পদ্ধতি রেডিয়েশন বা ক্যানসারের অপারেশনের চাইতে আলাদা। কারণ, রেডিয়েশন থেরাপি বা অপারেশন ক্যানসারে আক্রান্ত কোষগুলিকে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে লক্ষ্য করে চিকিৎসা করে।
অস্ত্রোপচারের পরে কোনও সংক্রমণ এড়াতে মহিলাদের প্রচুর বিশ্রাম এবং মেডিকেশনের মধ্যে থাকতে হয়।

Latest article