আমপাতা জোড়া জোড়া

গ্রীষ্মকালে সবাই এখন আম-জনতা। তাঁদের ভাত-পাতে আম আর চায়ের কাপে আমের পাতা। কারণ স্বাদ আর স্বাস্থ্য দুই-ই চাই। শুধু আম নয়, আমের পাতার গুণমুগ্ধ সকলে। তাই এখন আম্রপল্লব মা লক্ষ্মীর ঘট থেকে সোজা জায়গা করে নিয়েছে আম-বাঙালির হেঁশেলে। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

পুরু হলদেটে কমলা, অম্লমধুর রসালো শাঁসের মোহে পড়েননি এমন মানুষ খুব কমই আছেন। আম্রফল যার নাম। মাঝে মাঝে মনে হয় আম কি রাজা? নাকি সে রূপবতী রাজকন্যা— কোনটা? আম্রফলে মুগ্ধ আসমুদ্রহিমাচল, বিদেশ-বিঁভুই। সত্যি এ-স্বাদের ভাগ হবে না। শুধু আম কেন কম যায় না আমের সঙ্গীসাথীরাও। এই বৃক্ষের ফল থেকে শুরু করে পাতা— সবকিছুর গুণ অপরিসীম। স্বাদ, গন্ধ, ওষধি গুণান্বিত আমগাছের সবচেয়ে উপকারী অংশটি হল আমপাতা।

আরও পড়ুন-উদার আকাশের দুই নক্ষত্র

আম্রপল্লব বাঙালির গৃহে এক মঙ্গল উপকরণ। প্রতি বৃহস্পতিবার ঘরে ঘরে এই পাতার সমাদর। লক্ষ্মীর ঘটে তার বসত। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না বাঙালিকে পুণ্যসঞ্চয় করানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষাতেও এক নম্বরে এই আমপাতা। এই পাতায় রয়েছে প্রচুর ওষধি গুণ। শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট-সমৃদ্ধ এই পাতা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কুইজিনের অন্যতম উপকরণ। ওখানে এই পাতা খাওয়ার চলও রয়েছে। আম পাতায় রয়েছে ভিটামিন এ, বি এবং সি, ফ্ল্যাভোনয়েড এবং ফেনল, ট্যানিন, আর রয়েছে বিভিন্ন খনিজ উপাদান এবং এনজাইম।

আরও পড়ুন-মনের ডাক্তার

বাতের ব্যথা থেকে শ্বাসকষ্ট ও উচ্চ রক্তচাপ থেকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আমপাতার জুড়ি নেই। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী এই পাতা খেলে বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এতে রয়েছে ম্যাঞ্জিফিরিন নামক একটি সক্রিয় উপাদান যা স্বাস্থ্যের জন্য খুব উপকারী।
রক্তে শর্করা এক মহাঝকমারি জিনিস। যে আম বেশি খেলে ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষতি, সেই আমের কচি আমপাতা ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে অনবদ্য ওষুধ। এতে রয়েছে ট্যানিনস ও অ্যান্থোসায়ানিন নামক দুটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা মানবদেহে বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কম করে। বিশেষ করে প্রারম্ভিক ডায়াবিটিস নিরাময়ে খুব কার্যকরী। শুধু তাই নয় ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি এবং ডায়াবেটিক অ্যা়ঞ্জিওপ্যাথির ক্ষেত্রেও আমপাতা দারুণ কার্যকরী দাওয়াই।

আরও পড়ুন-ছোট্ট-ছোট্ট গল্প থেকে ভালবাসা সৃষ্টি হয়…

আমপাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করে গরম জলে সেদ্ধ করে চায়ের মতো পান করতে পারেন অথবা তাজা পাতা জলে ভিজিয়ে সারা রাত রেখে পরের সকালে সেই জল ছেঁকে নিয়ে খেলে ডায়াবেটিস রোগীরা খুব উপকার পাবেন। শরীরে ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ও হাইপারগ্লাইসেমিয়া কমাতে সাহায্য করে কচি আমপাতা।
আমপাতায় রয়েছে হাইপোটেনসিভ প্রপার্টি। যা উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। শরীরের ব্লাড ভেসেলস বা রক্তনালিগুলি প্রসারিত হয় এবং তাদের শক্তিবৃদ্ধি করে। প্রতিদিন আমপাতার চা খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়ুন-রেলের গাফিলতির বলি ৩২৩ জন, বালেশ্বরে অসাধারণ টিম বাংলা

আমপাতার অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল প্রপার্টি যে কোনও ধরনের ব্যাক্টেরিয়াল স্কিন ইনফেকশন প্রতিরোধ করে। স্কিন বার্ন-জনিত সংক্রমণ রোধ করে। এর মধ্যে থাকা অ্যান্থোসিয়ানিন উপাদান ত্বক জ্বলে যাওয়া অনুভূতি থেকে তৎক্ষণাৎ মুক্তি দেয়।
আমপাতায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি। এই ভিটামিন বি লিভারের বড় বন্ধু। লিভার বা যকৃৎকে উজ্জীবিত করে এবং শরীরের সমস্ত টক্সিন ফ্লাশ আউট করে বের করে দেয়। শরীরে অতিরিক্ত মেদ ঝরিয়ে দেয় নিমেষেই।
স্টম্যাক বা পাকস্থলীর খুব বড় বন্ধু আমপাতা। যাকে বলে স্টমাক টনিক। স্টমাক আলসারে ভীষণভাবে কার্যকরী এই আমের পাতা। রোজ খালি পেটে আমপাতার চা খেলে খুব ভাল থাকবে পেট ও পাকস্থলী দুই-ই।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

যে কোনও ধরনের শ্বাসকষ্ট বা শ্বাসযন্ত্রজনিত কষ্ট থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হল আমের পাতা। আমের পাতা জলে ভাল করে ফুটিয়ে সেই জলটা ঠান্ডা করে এক চামচ মধু দিয়ে দিনে একবার খেলেই যে কোনও ধরনের ঠান্ডা লাগা, বুকে কফ, শ্বাসের কষ্ট, ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানি থেকে ধীরে ধীরে মিলবে রেহাই।
কিডনির চারপাশে এক শক্তপোক্ত সুরক্ষা বলয় হল আমপাতা। আমের পাতা কিডনিতে স্টোন হতে দেয় না এবং গল ব্লাডারের পাথর দূর করতেও সাহায্য করে। এই পাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করে সারা রাত ভিজিয়ে রেখে সেই জলটা খান নিয়মিত— তাহলেই পাথর দূর করা সম্ভব হবে।
আপনি কি সারাদিন পরিশ্রম করেন, রাত জাগেন, খুব ক্লান্তি থাকে শরীরে? বিষণ্ণতায় ভুগছেন? রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে নিয়মিত? ঘুমের ওষুধ খেতে হয়? তাহলে সেই ক্লান্তি, বিষণ্ণতা এবং অনিদ্রা দূর করতে স্নানের জলে রোজ আমপাতা ভিজিয়ে রাখুন। ওই জলে স্নান করুন— এতে শরীর শান্ত এবং সতেজ হবে। খুব রিল্যাক্স অনুভব করবেন। ভাল ঘুম হবে।

আরও পড়ুন-হাওড়ায় যাত্রীরা পেলেন শুশ্রূষা, রাজ্যের সহায়তা

আর্থ্রাইটিসে ভোগেন না এমন ব্যক্তি এখন কমই আছেন। হাঁটুর যন্ত্রণা কোমরের ব্যথা, হাঁটতে চলতে কষ্ট— এই সব সমস্যায় কচি আমপাতা দারুণ উপকারী। কচি আমপাতা জলে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে ছেঁকে একটু লেবুর রস দিয়ে খান প্রতিদিন।
আমপাতায় রয়েছে পলিফেনোলিক ফ্ল্যাভানয়েডসের মতো গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। রয়েছে ভিটামিন এ, যা ক্যানসার প্রতিরোধ করে। শরীরে প্রতিষেধকের কাজ করে।
চুলের বাড়-বৃদ্ধিতে আম গাছের পাতার জুড়ি মেলা ভার। এটি চুলে প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতাও দেয়। এই পাতায় রয়েছে ভিটামিন সি যা কোলাজেন গঠন বাড়ায়। এই কোলাজেন শুধু চুল নয়, ত্বকের জন্যও জরুরি। আম গাছের পাতা রাসায়নিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত চুল মেরামত করতে সাহায্য করে। এতে ফ্ল্যাভোনয়েড রয়েছে যা প্রাকৃতিকভাবে চুল কালো করতে পারে। আপনি তাজা আমের পাতার পেস্ট তৈরি করে সেটা চুলে লাগিয়ে ১৫ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে দু’দিন করলেই তফাত বুঝতে পারবেন।

আরও পড়ুন-রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত! ট্রেনে কবজ সিস্টেম ছিল না কেন? প্রশ্ন অভিষেকের

গবেষণা অনুযায়ী আম পাতায় রয়েছে প্রদাহনাশক গুণ। শরীরে ব্যথা-বেদনার নাশ তো করেই পাশাপাশি মস্তিষ্ককে অ্যালঝাইমার এবং পারকিনসনের মতো অবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আম পাতার নির্যাস চায়ে ব্যবহার করলে স্মৃতিশক্তি তো বাড়েই, নার্ভজনিত সমস্যা কমে, প্রদাহ কমাতেও সাহায্য করে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে আম গাছের পাতা শরীরের চর্বি জমার মাত্রা কমিয়ে স্থূলতা কমাতে সাহায্য করে। এটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, যার ফলে বিপাকীয় হার বা যাকে বলে মেটাবলিজম বাড়িয়ে দেয় যা ওজন বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। ওজন কমানোর জন্য আমপাতার চা আপনার ডায়েটে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। একমুঠো আম পাতা দিয়ে ১৫০ মিলি জল ফুটিয়ে নিন। প্রতিদিন এই চা পান করুন। যদি তাজা পাতা পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়, আপনি আম পাতার গুঁড়ো বা নির্যাস ব্যবহার করতে পারেন।

আরও পড়ুন-তাপপ্রবাহ কমবে না

অনেকেই খুব হেঁচকির সমস্যায় ভোগেন। কী করবেন ভেবে পান না। হেঁচকি নিরাময়ে আমপাতা বহুযুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কখনও কখনও হেঁচকি অনমনীয় হয় এবং থামানো কঠিন। এই ধরনের ক্ষেত্রে, এই পাতাগুলি দারুণ কাজ করে।

Latest article