স্বাধীনতার গল্প শুনি

স্বাধীনতা দিবস কারও কাছে বিষাদময় স্মৃতি তো কারও কাছে অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। দেশের স্বার্থে কেউ জেল খেটেছেন তো কেউ দেশভাগে হয়েছেন বাস্তুচ্যুত। কিছু চোখে দেখা অভিজ্ঞতা তো কিছু কানে শোনা গল্পগাথা। স্বাধীনতার স্মৃতি। রোমন্থন করলেন বিশিষ্টরা। শুনলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

ওইদিন বাস্তুচ্যুত হয়েছিলাম
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
সাহিত্যিক
আমার বয়স যখন দশ কী এগারো, তখন দেশ স্বাধীন হয় ১৯৪৭-এ। আমরা অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহে থাকতাম, যেটা ছিল তখন পূর্ব পাকিস্তান। তাই বলা যেতে পারে আমার প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয়েছিল পাকিস্তানে। আর সেদিন আমি ভারতের পতাকা তুলতে পারিনি কারণ ওখানে তেরঙ্গা তোলা যাবে না, ওখানে পাকিস্তানেরই পতাকা তুলতে হবে! তো আমার দাদার এক মুসলিম বন্ধু ছিলেন, তিনি এসে বললেন, তোরা বাড়িতে ফ্ল্যাগ তুলিসনি ক্যানো। আমি বললাম ফ্ল্যাগ তো নেই বাড়িতে তো উনি তখন বললেন, ঠিক আছে, আমি একটা ফ্ল্যাগ পাঠিয়ে দিচ্ছি, তোল, কারণ এই বাড়িতে ফ্ল্যাগ ওঠেনি দেখে সবাই অসন্তুষ্ট হচ্ছে। সুতরাং দাদার বন্ধু পতাকা পাঠালেন, আমরা সেটা তুললাম। বাড়িতে তখন ঠাকুমা, আমি আর দিদি। এরপর শহরের অবস্থা দেখতে বেরলাম। সারা শহরে তখন ‘কাইঠ্যা’ বোম ফাটাচ্ছে সবাই। নলের মধ্যে বারুদ ভরে সেই বোমটা ফাটাতে হয়। সেই বোম মুহুর্মুহু ফাটছে— সে কানে তালা ধরে যাওয়ার মতো অবস্থা। ওখানকার যাঁরা মূল অধিবাসী তাঁরা নতুন জামা পরে বেরিয়ে পড়েছে, প্রচণ্ড চেঁচামেচি, হই-হুল্লোড় হচ্ছে আর আমি তা যত দেখছি তত আমার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে কারণ আমাকে তো এবার এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে, কেননা এটা তো পাকিস্তান হয়ে গেছে, এখানে আর থাকতে পারব না। কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে শহরটা এবং ওদের উৎসব দেখলাম তারপর রাতে বাড়ি ফিরে এলাম। এরপর ছাড়তে হল ভিটে-মাটি। বাবার বদলির চাকরি ছিল তাই এদেশে এসেও বিভিন্ন জায়গায় থেকেছি। স্কুলে স্বাধীনতা দিবস পালন করেছি। কিন্তু স্বাধীনতা কোনওদিন উপভোগ করিনি কারণ আমাদের দেশ চলে গেছে। আজও করি না কারণ স্বাধীনতা দিবসের দিন বাস্তুচ্যুত হয়েছিলাম, নিজের জায়গা ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল। তাই স্বাধীনতার আনন্দের চেয়ে বিষাদ অনেক বেশি।

আরও পড়ুন-দুর্গাপুরে সরকারি পরিবেশবান্ধব এসি বাসের সূচনা করলেন মন্ত্রী

বাবার স্বদেশিয়ানা প্রভাবিত করেছে
আবুল বাশার
সাহিত্যিক
আমার জন্ম স্বাধীনতার পরে ঊনপঞ্চাশ সালে। আমার বাবা কাজী নজরুল ইসলামের মতোই এখনকার পাকিস্তান অর্থাৎ তখনকার অবিভক্ত ভারতের করাচি সেনানিবাসে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামের সমসাময়িক ছিলেন না তবে তার কিছু পরের জেনারেশন ছিলেন আমার বাবা। তিনি ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্ট-এর সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। কাজী নজরুল ইসলামও ওই দলেই ছিলেন। সেই ঘটনাটা উনি খুব বলতেন। উনি এটাকে স্বাধীনতায় অংশগ্রহণ বলেই মনে করতেন। কিন্তু যুদ্ধে অংশ নেওয়া হয়নি কারণ এই রেজিমেন্ট পরবর্তীতে ভেঙে যায় ফলে বাবা ফিরে আসেন। বাবা যখন ফিরেছিলেন সেই পোশাকটা আজও মনে আছে আমার। উনি নিচে ধুতি পরে আছেন, ওপরের পোশাকটা সৈনিকের। এই ছবিটাই বহুকাল আমার চোখের সামনে ছিল। কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে অনেক মিল ছিল বাবার। বাবাও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের লোক ছিলেন। পরের জীবনটা তাঁর সঙ্গীতময় ছিল। নজরুলের আদর্শ বাবাকে প্রভাবিত করেছিল। আমার বাবার নাম ছিল কলিমউদ্দিন আহমেদ। বাবা আরও বলেছিলেন, একবার আফগানিস্তান সীমান্তে রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, তখন তিনি সৈনিক। পায়ের বুটজুতোটা হঠাৎ ছিঁড়ে গেছে তো দেখলেন একটা মুচি বসে রয়েছে, ওঁর কাছে জুতো মেরামত করতে দিলেন এবং জানতে পারলেন ওই মুচি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। সাধারণত আমাদের যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাতে জেনেছিলাম মুচিরা আলাদা জাতের হয়, মুসলিম বা হিন্দু হয় না। কিন্তু ওটা দেখে বাবা অবাক হয়েছিলেন। বাবার এই স্বদেশিয়ানা আমাকে আজীবন প্রভাবিত করেছে।

আরও পড়ুন-প্রতি ব্লকে আদিবাসী সাংস্কৃতিক দল হোক আর্জি মুখ্যমন্ত্রীকে

খুব সমারোহে পালিত হয়েছিল
লিলি চক্রবর্তী
অভিনেত্রী
যখন ভারত স্বাধীন হল আমি তখন খুব ছোট, ছ’বছর বয়স। মধ্যপ্রদেশেই থাকতাম। ওখানেই কেটেছে ছোটবেলা। দেশ স্বাধীন হওয়ার একবছর আগে মধ্যপ্রদেশে চলে এসেছিলাম। বাবা ঢাকা থেকে রাতারাতি কলকাতা চলে আসেন কিন্তু তেমন পশার জমাতে পারেননি, ফলে মধ্যপ্রদেশে চলে যান। ওখানে আমার বড়মামা থাকতেন। এর ঠিক এক বছর পর দেশ স্বাধীন হল। সেদিন সবাই খুব আনন্দ করছিল। সেদিন মা বাড়িতেই মিষ্টি তৈরি করেছিল। স্বাধীনতার দিনটা শঙ্খ বাজিয়ে, পতাকা উত্তোলন করে খুব সমারোহে পালিত হয়েছিল।

সে এক অবর্ণনীয় অনুভূতি
মিতা চট্টোপাধ্যায়
অভিনেত্রী
আমার জীবনে স্বাধীনতা দিবস এক অভিনব ব্যাপার, এক অভিনব অনুভূতি। আমরা যে কতটা শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিলাম তা বোঝার মতো মানসিকতা সাধারণ বাঙালি মেয়েদের মধ্যে তেমন ছিল না। আমি কিন্তু আমার মতো সাধারণ একটা মেয়ের কথা বলছি— প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের কথা বলছি না, আমি প্রীতিলতা নই, প্রীতিলতা হলে হয়তো আমার উপলব্ধি অন্যরকম হত। আমার বাবা শহিদ যতীন দাসের শিষ্য ছিলেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সদস্য ছিলেন। ফলে বাবার মধ্যে স্বদেশি মনো-ভাবনার প্রভাব আমার মধ্যেও প্রবল ছিল। ১৯৪৭-এর সেই দিন রাত বারোটার সেই অপেক্ষা মুখে ব্যাখ্যা করার মতো নয়। তখনকার রাত বারোটা এখনকার মতো ছিল না। সত্যি যাকে বলে মধ্যরাত। যত দেরিই হোক সেদিন বাবার নির্দেশ ছিল কাচা কাপড় পরে অপেক্ষা করতে হবে সবাইকে। মা প্রদীপ জ্বালিয়েছেন, ধূপ দিয়েছেন, হাতে শাঁখ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। তখন তো আর টিভি ছিল না যে দেখতে পাব। কিন্তু রেডিও ছিল, বাবা রেডিওর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। যে-মুহূর্তে রাত বারোটার ঘণ্টা বাজল চতুর্দিক থেকে হইহই করে ঢাকের আওয়াজ, ঘড়ির ঘণ্টা— সে এক উন্মাদনা। ছাদের ওপর থেকে সবাই চিৎকার করছে— আর আমরা শৃঙ্খলিত নই। সবাই উলু দাও, শাঁখ বাজাও। আমি সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারিনি কারণ খুব ছোট ছিলাম কিন্তু এটা বুঝেছি এতদিন যে শৃঙ্খলে আবদ্ধ আমরা ছিলাম এবং আজ তার থেকে স্বাধীন হয়েছি। এই যে আনন্দ, এই যে অনুভূতি এটা সত্যি অবর্ণনীয় এবং আমাদের মনকে এক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করেছিল।

আরও পড়ুন-কলকাতা থেকে জেলা, রাখি-উৎসবে বাংলা

স্বাধীনতা দিবসে বাবার কথাই মনে পড়ে
হৈমন্তী শুক্লা
সঙ্গীত শিল্পী
স্বাধীনতা দিবসের দিনটা সামনে এলে আমার একটা অন্যরকম অনুভূতি হয় কারণ আমার বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। বহুদিন দেশের কাজ করেছেন, অনেকবার জেলে গেছেন। বাবা গল্প বলতেন, জেলে থাকার সময় একজন কয়েদি বাবাকে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলেছিল, তখন নাকি বাবা তাকে গরম ডালের হাতা ছুঁড়ে মেরেছিলেন। আমি ভাবতেই পারি না কারণ বাবাকে তো আমি মাটির মানুষ দেখেছি, তিনি যখন গান গাইতেন তখন অন্যরকম চেহারা। বাবা সালকিয়াতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে যে বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন তার পাশাপাশি বাড়িতেই কাননদেবী থাকতেন। সেই সময় গান রেকর্ডের জন্য একটি গানের কোম্পানি বাবাকে নিতে এসেছে ঠিক তখনই পুলিশ আসে তাঁকে অ্যারেস্ট করতে। ওই সময় বাবা পালিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। সেখানে জিপিওর সামনে একজনের ওপর গুলিও চালিয়েছিলেন। বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরপরে ধরা পড়েন ফলে বাবার আর গান রেকর্ড করতে যাওয়া হল না, চলে গেলেন জেলে। তার বহুদিন পরে ছাড়া পেয়েছিলেন। বাবা যে দেশের কাজ করতেন সেটা আমাদের কাছে একটা গর্বের বিষয় ছিল। তাই স্বাধীনতা দিবস এলেই আমার এই ঘটনাগুলো আর বাবার কথা আরও বেশি করে মনে পড়ে। আর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বাবার জীবনের মোড়টাই ঘুরে গেল। এরপর তিনি লখনউয়ে চলে যান। ওখান থেকে বাবা, ঠাকুমা, ঠাকুরদাদা চলে আসেন এখনকার বাংলাদেশের পাবনার সিরাজগঞ্জে। আমার ঠাকুরদা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের দারোগা আর তাঁর ছেলে এরকম দুঃসাহসী। এর অনেক পরে পাবনাতেই বাবার বিয়ে হয়, সেখানে দাদার জন্ম হয় এবং বাবা আবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং এখানে আমার জন্ম হয়।
স্বাধীনতা দিবসের দিনটা সামনে এলে আমার একটা অন্যরকম অনুভূতি হয় কারণ আমার বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। বহুদিন দেশের কাজ করেছেন, অনেকবার জেলে গেছেন। বাবা গল্প বলতেন, জেলে থাকার সময় একজন কয়েদি বাবাকে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলেছিল, তখন নাকি বাবা তাকে গরম ডালের হাতা ছুঁড়ে মেরেছিলেন। আমি ভাবতেই পারি না কারণ বাবাকে তো আমি মাটির মানুষ দেখেছি, তিনি যখন গান গাইতেন তখন অন্যরকম চেহারা। বাবা সালকিয়াতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে যে বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন তার পাশাপাশি বাড়িতেই কাননদেবী থাকতেন। সেই সময় গান রেকর্ডের জন্য একটি গানের কোম্পানি বাবাকে নিতে এসেছে ঠিক তখনই পুলিশ আসে তাঁকে অ্যারেস্ট করতে। ওই সময় বাবা পালিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। সেখানে জিপিওর সামনে একজনের ওপর গুলিও চালিয়েছিলেন। বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরপরে ধরা পড়েন ফলে বাবার আর গান রেকর্ড করতে যাওয়া হল না, চলে গেলেন জেলে। তার বহুদিন পরে ছাড়া পেয়েছিলেন। বাবা যে দেশের কাজ করতেন সেটা আমাদের কাছে একটা গর্বের বিষয় ছিল। তাই স্বাধীনতা দিবস এলেই আমার এই ঘটনাগুলো আর বাবার কথা আরও বেশি করে মনে পড়ে। আর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বাবার জীবনের মোড়টাই ঘুরে গেল। এরপর তিনি লখনউয়ে চলে যান। ওখান থেকে বাবা, ঠাকুমা, ঠাকুরদাদা চলে আসেন এখনকার বাংলাদেশের পাবনার সিরাজগঞ্জে। আমার ঠাকুরদা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের দারোগা আর তাঁর ছেলে এরকম দুঃসাহসী। এর অনেক পরে পাবনাতেই বাবার বিয়ে হয়, সেখানে দাদার জন্ম হয় এবং বাবা আবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং এখানে আমার জন্ম হয়।
স্বাধীনতা দিবসের দিনটা সামনে এলে আমার একটা অন্যরকম অনুভূতি হয় কারণ আমার বাবা স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। বহুদিন দেশের কাজ করেছেন, অনেকবার জেলে গেছেন। বাবা গল্প বলতেন, জেলে থাকার সময় একজন কয়েদি বাবাকে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলেছিল, তখন নাকি বাবা তাকে গরম ডালের হাতা ছুঁড়ে মেরেছিলেন। আমি ভাবতেই পারি না কারণ বাবাকে তো আমি মাটির মানুষ দেখেছি, তিনি যখন গান গাইতেন তখন অন্যরকম চেহারা। বাবা সালকিয়াতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে যে বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন তার পাশাপাশি বাড়িতেই কাননদেবী থাকতেন। সেই সময় গান রেকর্ডের জন্য একটি গানের কোম্পানি বাবাকে নিতে এসেছে ঠিক তখনই পুলিশ আসে তাঁকে অ্যারেস্ট করতে। ওই সময় বাবা পালিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। সেখানে জিপিওর সামনে একজনের ওপর গুলিও চালিয়েছিলেন। বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরপরে ধরা পড়েন ফলে বাবার আর গান রেকর্ড করতে যাওয়া হল না, চলে গেলেন জেলে। তার বহুদিন পরে ছাড়া পেয়েছিলেন। বাবা যে দেশের কাজ করতেন সেটা আমাদের কাছে একটা গর্বের বিষয় ছিল। তাই স্বাধীনতা দিবস এলেই আমার এই ঘটনাগুলো আর বাবার কথা আরও বেশি করে মনে পড়ে। আর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বাবার জীবনের মোড়টাই ঘুরে গেল। এরপর তিনি লখনউয়ে চলে যান। ওখান থেকে বাবা, ঠাকুমা, ঠাকুরদাদা চলে আসেন এখনকার বাংলাদেশের পাবনার সিরাজগঞ্জে। আমার ঠাকুরদা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের দারোগা আর তাঁর ছেলে এরকম দুঃসাহসী। এর অনেক পরে পাবনাতেই বাবার বিয়ে হয়, সেখানে দাদার জন্ম হয় এবং বাবা আবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং এখানে আমার জন্ম হয়।

আরও পড়ুন-বিজেপির বিশৃঙ্খলার মধ্যেও সংসদীয় সক্রিয়তা তৃণমূলের, ৫ বছরে বিজ্ঞাপনে খরচ কত? প্রশ্ন ডেরেকের

বিপ্লবীদের নিয়ে আলোচনা হত
শিবাজী চট্টোপাধ্যায়
সঙ্গীত শিল্পী
স্বাধীনতার অনেক গল্প শুনেছি বাবা-মার কাছে। শ্যামবাজারে থাকতাম আমরা। তখন বাড়িতে বিপ্লবীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়ে আলোচনা হত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, চিত্তরঞ্জন দাস, বাঘাযতীনকে নিয়ে। বাবা খুব দেশভাগ আর ৪৬-এর দাঙ্গার গল্প বলতেন। গোপালচন্দ্র মুখার্জি, যিনি ‘গোপাল পাঁঠা’ নামে পরিচিত ছিলএন তাঁর কথা শুনেছি তখন। ওই দাঙ্গার সময় বিধানচন্দ্র রায় গোপাল পাঁঠাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন পরিস্থিতি সামলাতে, তখন নাকি ওই গোপাল পাঁঠা দাঙ্গা অনেকটা রুখে দিতে সক্ষম হন। বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে নেহরুর সম্পর্ক তখন বেশ ভাল ছিল। শুনেছি সেই সময় নেহরুর ওপর মানুষ খুব ক্ষিপ্ত ছিল। আন্দোলন চলছিল এবং শুনেছিলাম তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়েছিল। মনে আছে স্বাধীনতা দিবসে পতাকা দিয়ে মুড়ে ফেলা হত গোটা পাড়া, খুব সমারোহে এই স্বাধীনতা পালন করা হত, আমরা সবাই অংশ নিতাম। খুব দেশাত্মবোধ ছিল আমাদের মধ্যে। এখন স্বাধীনতা উৎসব কেমন যেন ম্রিয়মাণ লাগে। দেশাত্মবোধের সেই জোরটা কারও মধ্যে তেমন দেখতে পাই না। উৎসাহ, উদ্দীপনাটা এখন কমই মনে হয় আমার।

মাকে দেখেছি অনেক কিছু করতে
মাধবী মুখোপাধ্যায়
অভিনেত্রী
স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আমার মা। খুব স্বাধীনচেতা এবং সক্রিয় মানুষ ছিলেন। আমরা তখন আপার সার্কুলার রোডে থাকতাম একটা আপার্টমেন্টে। মাকে অনেক বক্তৃতা দিতে দেখেছি, শুনেছি। মা খুব সাহসী ছিলেন। দাঙ্গা বাধল যখন তখন দেখেছি মাকে কীভাবে সব সামাল দিত। মা এমনিতেই মাসকাবারের সময় বাড়িতে প্রচুর খাবার মজুত রাখতেন। ওই দাঙ্গার সময় আমরা ফ্ল্যাটের সবাই পুরো তিনদিন আটকে ছিলাম তখন মা সবার জন্য ওই মজুত খাবার থেকে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। যখন দাঙ্গাকারীরা হানা দিত তখন সবাই ছাদে চলে যেত। সেখানে ইট জমিয়ে রাখা হত, ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারা হত। তিনদিন আটকে থাকার পর একটা গাড়ি নিতে আসে আমাদের তখন আমরা একবস্ত্রে বেরিয়ে পড়ি এরপর আমরা তখন বাগবাজার স্ট্রিটে একটা বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ওখানে ছিলাম অনেকদিন। দেশ স্বাধীন হওয়ার দিনটা স্মরণীয় হয়ে আছে। ওই সময় আমরা যে আবাসনে থাকতাম, আমার মা তখন সেখানকার সবাইকে নিয়ে একটা বড় পতাকা উত্তোলন করলেন। সবাই মিলে হইহই আনন্দ, শঙ্খ বাজছিল। দেশ স্বাধীন হল, সেই উৎসব আমি বিস্ময়ে শুধু দেখছিলাম।

আরও পড়ুন-কলকাতা থেকে জেলা, রাখি-উৎসবে বাংলা

আমি শুনেছি খিদের গল্প
সুবোধ সরকার
কবি
আমার বাবা এবং মা ওপার থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। কৃষ্ণনগরে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সুতরাং আমি হচ্ছি মূলত শরণার্থী পরিবারের ছেলে। আমার কাছে হয়তো শরণার্থী শিবিরটা অতটা সাঙ্ঘাতিক নয়। কিন্তু স্বাধীনতার গল্পও আমার কাছে রোম্যান্টিক নয়। বিপ্লবের গল্প, মানে বোমা নিয়ে, অস্ত্র নিয়ে লড়াইয়ের যে গল্প, সেগুলো আমি শুনিনি। আমি শুনেছি খিদের গল্প। আমি শুনেছি দু’দিন-তিনদিন না খেয়ে বসে থাকার গল্প। সেইসব গল্প এখন আর মানুষ বড় একটা শুনতে চান না। আমারও বলতে বিশেষ ইচ্ছে করে না। সেই স্মৃতি খুব সুখকর নয়। স্বাধীনতা সম্পর্কে কিছু গল্প শুনেছি। বর্তমান যে ভাবনা সেটা হল, আমার কাছে স্বাধীনতা কথাটার মানে কী। দেশের স্বাধীনতা মানে তো ঘটি-বাটি, বাড়ি, ঘর-সংসার এগুলো নয়। স্বাধীনতা শুধু একটা সংবিধান বা অশোক স্তম্ভ নয়। এগুলো আছে, এগুলো সবই প্রতীক।
আমার কাছে স্বাধীনতা হল ভিতরের স্বাধীনতা। আমি যদি আমার বাংলা ভাষা বলতে না পারি, সেই ভাষা যদি আক্রান্ত হয়, তাহলে স্বাধীনতা কোথায়! ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে আমাদের বাংলা তথা বাংলা ভাষা খুব বড় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। বাংলা ভাষার গান, স্বদেশি গান, রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান থেকে শুরু করে আরও অনেক গান গাইতে গাইতে আমার মা-বাবা রাস্তায় নেমেছিলেন। সেই গান গাইবার অপরাধে পাড়ার বেশ কয়েকজন লোকের কাছে মারধর খেয়েছিলেন আমার বাবা। সেই লোকেরা ছিলেন ব্রিটিশদের দালাল। বাবার কাছেই গল্প শুনেছি এই অভিজ্ঞতা তাঁদের হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। আজকে স্বাধীন ভারতে সেই বাংলা ভাষায় কথা বলতে গেলে বাঙালি অপদস্থ হচ্ছে। এ তো ভয়ঙ্কর! আমাদের সংবিধান আছে, ভাষা রক্ষক আছে কিন্তু বাংলা ভাষা ও বাঙালি যেভাবে নিপীড়নের এবং অপমানের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে সেটা এই স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে আমার কাছে খুব মর্মান্তিক।

Latest article