হাঁটুব্যথা ও অস্টিওআর্থ্রাইটিস

Must read

অস্টিওআর্থ্রাইটিসের নানা কারণ নিয়ে কথা বললেন মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতা হাসপাতালের ডিপার্টমেন্ট অফ মেডিসিন ও রিউমাটোলজি ইউনিটের ডাঃ উদাস ঘোষ। লিখেছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী।

অস্টিওআর্থ্রাইটিস কী?
অস্টিওআথ্রাইটিস হল ডিজেনারেটিভ জয়েন্ট ডিজিজ, ক্ষয়জনিত জয়েন্টের অসুখ।জয়েন্টে দুটো হাড়ের মধ্যবর্তী স্হানে কার্টিলেজ থাকে।এই কার্টিলেজের ক্ষয় হয় এবং নতুন হাড় (অস্টিওফাইট) ফরমেশন হয়।পাশাপাশি জয়েন্টের হাড়ে নীচের অংশে ও আর্টিকুলার কার্টিলেজের ইরোশন হয়। এর ফলে জয়েন্টে কিছু বায়োকেমিক্যাল মরফোলজিক অল্টারেশন হয়। সাইনোভিয়াল মেমব্রেন যেটা জয়েন্টের মধ্যে আছে তাঁর একটা প্রদাহ হয় ,জয়েন্ট ক্যাপসুলও ফুলে যায়, ফলে ব্যথা অনেক ক্ষেত্রে ফোলা ও চলা ফেরাতে অসুবিধা হয়।

আরও পড়ুন-রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার আসছে শুনেই ভয়ে ওরা কাঁপছে

অস্টিওআর্থ্রাইটিসের কারণ-
প্রাথমিক ভাবে এর কোনও কারণ জানা যায়নি। যে কারণে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হয় সেই রিস্ক ফ্যাক্টর গুলোর মধ্যে প্রথম হলো বয়স । যত বয়স বাড়ে তত এই রোগ বাড়ে। চল্লিশোর্ধে এই রোগের প্রবণতা বেশি। মানুষের দেহে যে যে জয়েন্টে বেশি লোড পড়ে সেই জয়েন্টে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হতে পারে। যেমন হাঁটুতে সবচেয়ে বেশি লোড পড়ে, তাই হাঁটুতে বেশি। এছাড়াও হিপ জয়েন্ট, আঙুলে হতে পারে। অপর কারণ হল ওবেসিটি। যাঁর ওজন বেশি তাঁরও এই ক্ষয়জনিত রোগও বেশি । দেহের এক কেজি ওজন কমালে প্রায় পাঁচগুণ লোড কমে যায় হাঁটুর জয়েন্টে। বংশগত কারণেও হয়। কোমরে ব্যথা রয়েছে ঠিকমত হাঁটতে পারছেন না এক পায়ে লোড পড়ছে অন্য পায়ে পড়ছে না। অর্থাৎ জয়েন্টের অ্যালাইনমেন্ট ঠিক নেই। সেক্ষেত্রে ধীরে ধীরে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হতে পারে। ট্রমা বা আঘাতজনিত কারণে দুটো জয়েন্টের মাঝখানে যে কার্টিলেজ থাকে সেটা ছিড়ে গেলে পরে ঠিকমত চিকিৎসা না হলে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হতে পারে। চল্লিশোর্ধ মহিলাদের বেশি হয় এর প্রধান কারণ মেনোপজ । মেনোপজ হলে মেয়েদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের ঘাটতি হয় ফলে অস্টিওআর্থ্রাইটিসের সম্ভাবনা বেশি থাকে। চল্লিশের নীচে মেয়েদের তুলনায় পুরুষদের বেশি সম্ভাবনা রয়েছে।প্রাথমিক কারণ ছাড়া অন্যান্য গৌন কারণগুলো হল আঘাত, বাতজনিত অসুখ, হরমোনের অভাবজনিত অসুখ ও অন্যান্য। এখন অবশ্য অস্টিওআর্থ্রাইটিসের কারণ হিসেবে ওভারল্যাপ সিনড্রোম অর্থাৎ ক্ষয়জনিত ও প্রদাহজনিত কারণের সংমিশ্রণের কথা বলা হচ্ছে।

আরও পড়ুন-বাবুলই শেষ নয়, আরও বড় নেতা আসছে! ফিরহাদের মন্তব্যে বঙ্গ বিজেপির বাড়ল চিন্তা

বাত ও অস্টিওআর্থ্রাইটিসের তফাত –
বাত একটি অটোইমিউন ডিজিজ অর্থাৎ শরীর তাঁর নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে একটা অ্যান্টিবডি তৈরি করে এবং তাঁর বিভিন্ন কার্টিলেজগুলোকে নষ্ট করতে থাকে। তখন জয়েন্টের মধ্যে যে পর্দা ( সাইনোভিয়াম )সেই পর্দায় প্রদাহ হয়। বাত হল জয়েন্টের প্রদাহ জনিত রোগ বা ইনফ্লামেটরি ডিজিজ। আর অস্টিওআর্থ্রাইটিস হল জয়েন্টের ক্ষয়জনিত রোগ। তবে কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে জয়েন্টে কিছু কোলাজেন ফাইবার রয়েছে তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে এবং ফাইবারটা নষ্ট হয়ে যায়, ফলে প্রদাহ হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রদাহজনিত কারণেও অস্টিওআর্থ্রাইটিস হতে দেখা যায়। হাঁটুতে বাত হলে সেটা ফুলে থাকে বা গরম থাকে। কিন্তু অস্টিআর্থ্রাইটিস হাঁটুতে হলে সাধারণভাবে ফুলে থাকেনা বা গরমও থাকেনা। প্রদাহজনিত কারণে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হলেই তবে ফোলা থাকতে পারে।বাতে মর্নিংস্টিফনেস হয়। অর্থাৎ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ব্যথা অনেকক্ষণ থাকে। প্রায় একঘন্টার কাছাকাছি । কিন্তু অস্টিওআর্থ্রাইটিসের মর্নিং স্টিফনেস থাকে আধঘন্টা ও সারাদিন অল্প স্টিফনেস থেকেই যায়। যখনই আমরা বিশ্রাম নেব দেখা যায় জয়েন্ট স্টিফ হয়ে যাচ্ছে সেটা কাটতে সময় লাগে। প্রায় সারাদিন কম বেশি ব্যথা থাকে।

আরও পড়ুন-অভিষেক, কুণাল সহ আার কাউকেই ডাকতে পারবে না ত্রিপুরা পুলিশ, নির্দেশ হাইকোর্টের

হাঁটু ব্যথা
সাধারণত চল্লিশের নীচে ও চল্লিশের উর্ধ্বে হাঁটু ব্যথার কারণ আলাদা। চল্লিশে নীচে যে কারণগুলো পাই সেগুলো লিগামেন্টে ইনজুরি ও তাঁর কোনও চিকিৎসা হল না সেই ইনজুরি থেকে হতে পারে। ফুটবল খেলতে গিয়ে বা দৌড় করতে গিয়ে হাঁটুর টুইস্ট হলো বা অন্য কোনও কারণে হাঁটু ব্যথা হয়ে ম্যাল অ্যালাইনমেন্ট হওয়াতে জয়েন্টে প্রদাহ হওয়ার ফলে এটা হতে পারে। আর বাতজনিত কারণে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা স্পনডাইলোআর্থোপ্যাথী জাতীয় অসুখে হাঁটু ব্যথা হতে পারে। যদি একটি হাঁটুতে ব্যথা হয় তাহলে সংক্রমণ বা ইনফেকশন জনিত কারণকে ভাবতে হবে।বাচ্চা বা বয়স্কদের হাঁটু ব্যথার কারণ ক্যানসার জনিত অসুখও হতে পারে। হরমোনের গোলমাল জনিত কারণে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হতে পারে সেক্ষেত্রে ক্ষেত্র বুঝে হরমোন পরীক্ষা করতে হবে ।

কী করে বুঝবেন অস্টিওআর্থ্রাইটিস?
অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। জয়েন্ট মুভমেন্ট বা হাঁটাচলা করতে গেলে খড়মড়ে আওয়াজ হয় একে চিকিৎসার পরিভাষায় বলে ক্রেপিটাস। তাহলে ধরে নিতে হবে অস্টিআর্থ্রাইটিস। যদি দেখা যায় হাঁটুর হাড় বেড়ে গেছে তাহলে ও ধরে নিতে হবে অস্টিওআর্থ্রাইটিস। তখন এক্সরে করে দেখা হয় যদি দেখা যায় জয়েন্ট স্পেস কমে যাওয়া, কাটিলেজের khoy বা নতুন বোন ফরমেশন হয়েছে তাহলে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হয়েছে ধরে নিতে হবে। হাঁটু ফুলে জল জমে গেলে বাত না অস্টিওআর্থ্রাইটিস বুঝতে হলে ওই জমে থাকা জল পরীক্ষা করে দেখা হয় এতে ডব্লিউবিসি কাউন্টিং যদি দুহাজারের নীচে হয় তাহলে ধরে নিতে হবে অস্টিওআর্থ্রাইটিস হয়েছে।

আরও পড়ুন-অভিষেক, কুণাল সহ আার কাউকেই ডাকতে পারবে না ত্রিপুরা পুলিশ, নির্দেশ হাইকোর্টের

চিকিৎসা
অস্টিওআর্থ্রাইটিস এর চিকিৎসা হল প্যালিয়েটিভ চিকিৎসা। অর্থাৎ রোগের কারণ,উপসর্গ জেনে নিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হয়। প্রাইমারি না সেকেন্ডারি অস্টিওআর্থ্রাইটিস সেটা দেখতে হয় প্রথমে। ব্যথা, যন্ত্রণার তীব্রতা কত। চেষ্টা করা হয় ওষুধ ছাড়া যাতে চিকিৎসা করা যায়। উবু হয়ে বসবেন না, বাবু হয়ে বসবেন না ও মেঝেতে বসবেন না। খুব বেশি ব্যথা থাকলে অল্প পরিমাণ ওষুধ দেওয়া হয় ও ফিজিওথেরাপি করার পরামর্শ দেওয়া হয়।বিশেষ করে বয়স্কদের ওষুধ ছাড়া যতটা সম্ভব সারিয়ে তোলা যায় সেটা দেখা হয় ও প্যারাসিটামল জাতীয় ট্যাবলেট দেওয়া হয়, কঠিন ব্যথার ওষুধ নয় ।এক্সারসাইজ দেখিয়ে দেওয়া বা ফিজিকাল মেডিসিন বিভাগে রেফার করে দেওয়া হয়। ওজন বেশি হলে সেক্ষেত্রে ওজন কমানোর ভীষণ জরুরি। সেল্ফ ম্যানেজমেন্ট শেখান হয় কীভাবে নিজের চিকিৎসা নিজে করবে।প্রথমে স্টেরয়েড জাতীয় পরে প্রয়োজনে হায়ালনিক অ্যাসিড ইনজেকশন দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। ব্যাথা খুব বেশি হলে তবেই হাঁটুর ভিতরে ইনজেকশন দেওয়া হয়। সাধারণ তাপমাত্রায় গরম ঠান্ডার সেঁক দিতে পারে। ব্যথা ও গরম থাকলে দিনে দুবার বরফ ঘষুন। ব্যথার ওষুধের মলম লাগানো যেতে পারে। নি ক্যাপ বা নি ব্রেস পরবার পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে হাঁটুর অ্যালাইনমেন্ট ঠিক থাকে ও ব্যথাও কমে। মুখে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দেওয়া যেতে পারে তবে কিছু ক্ষেত্রে। জয়েন্ট ভিটামিন গ্লুকোজামিন আর কনড্রয়েটিন বা এর সাথে ডাযাসেরিন দেওয়া হয় এইগুলো দিলে রোগী ভাল থাকে। এছাড়া অনেক ওষুধের ব্যবহার করা হয়। তবে এইগুলোর ব্যবহারে একশো শতাংশ সুস্হতার আশ্বাস দেওয়া যায়না। পরিশেষে যদি খুব বেশি রকমের অস্টিওআর্থ্রাইটিস হয় ও পাশাপাশি রোগীর অবস্থা সন্তোষজনক হয় তাহলে হাঁটু পরিবর্তন করা যেতে পারে।

পরিষেবা
মেডিকেল কলেজে রিউমাটলজি ইউনিট আছে।বুধবার আর শুক্রবার। এখানে অস্টিওআর্থ্রাইটিস এবং বিভিন্ন বাতের চিকিৎসা হয়।রিউমাটয়েড আথ্রাইটিস, অ্যাঙ্কাইলজিং স্পনডিলাইটিস , কোমরে ব্যথা ইত্যাদি আরও রোগের চিকিৎসা হয়। আউটডোরে দুদিন মিলে মোটামুটি পাঁচশো রোগী আসে।টিকিট কেটে দেখাতে হয়। প্রয়োজন বুঝে ভর্তি করানো হয়।

Latest article