একসঙ্গে অনেক রোগকে শরীরে অভ্যর্থনা জানিয়ে ফেলার খুব সহজ রাস্তা হল স্ট্রেস বা মানসিক চাপ। অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন, হরমোনাল সমস্যা, ঘুমের সমস্যা, উচ্চরক্তচাপ, হার্টের সমস্যা, থাইরয়েড, কোলেস্টেরল-সহ নানা ধরনের শারীরিক এবং মানসিক সমস্যার অন্যতম কারণ। তাই প্রতি বছর এপ্রিল জুড়ে পালিত হয় ‘জাতীয় স্ট্রেস সচেতনতা মাস’। এই মাসটি পালনের আগে ১৯৭৪ সালে ওয়র্কপ্লেসে বা কর্মক্ষেত্রে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের জন্য একটি সংস্থাও চালু হয়েছিল। এরপর ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আন্তর্জাতিক স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট অর্গানাইজেশন’। ১৯৯২ সালে এপ্রিল মাসে প্রথমবার এই অর্গানাইজেশন জাতীয় স্ট্রেস সচেতনতা কর্মসূচি পালন শুরু করে। প্রতিবছর পুরো এই মাস জুড়ে স্ট্রেস-সংক্রান্ত নানা ধরনের সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ সার্ভের সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতের প্রতি ৭ জনের মধ্যে ১ জন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। প্রায় ৩৮ মিলিয়ন মানুষ ভারতবর্ষের অ্যাংজাইটির শিকার। কোভিড ১৯-এর পর সেই রেশিও বর্তমানে প্রায় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষণা অনুযায়ী দীর্ঘস্থায়ী চাপ একজন মানুষের আয়ু আড়াই বছর কমিয়ে ফেলতে পারে।
আরও পড়ুন-ধর্ষণ মামলায় এলাহাবাদ হাইকোর্টের মন্তব্য আপত্তিকর, ভর্ৎসনা সুপ্রিম কোর্টের
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কী
স্ট্রেস হল একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতি বা ঘটনার চাপের জন্য শরীর, মনে হওয়া প্রতিক্রিয়া। দীর্ঘ এবং ক্রমাগত মানসিক চাপ আপনাকে দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। হঠাৎ হওয়া স্ট্রেস থেকে উত্তেজনা আসতে পারে যেমন চোয়াল চেপে ধরা অনুভব হতে পারে। দ্রুত ব্যথা বাড়তে পারে, নতুন করে মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হতে পারে— ঘাড়ে, পিঠে, মাথায়, মাথার পিছন দিকে, কাঁধে। হঠাৎ হৃদ্স্পন্দন বেড়ে যেতে পারে, শ্বাস নিতে অসুবিধে হয়, মনোযোগ দিতে অসুবিধে হয় ইত্যাদি নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
স্ট্রেস দীর্ঘদিন সহ্য করলে
যখন চাপে থাকি, তখন আমাদের নার্ভাস সিস্টেম ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ প্রতিক্রিয়া দেয়। এর ফলে শরীর থেকে যে সমস্ত হরমোন নির্গত হয়, তা হৃদ্-স্পন্দনকে বাড়িয়ে তোলে। ঘাম বেশি হয়। এর ফলে হাইপার টেনশন, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের সম্ভাবনা খুব বেড়ে যায়।
আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায় সর্বোপরি মনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। খুব বেশি রাগ, চিৎকার বা ভীষণ কান্না হতে পারে।
স্ট্রেস থেকে অতিরিক্ত মানসিক দুশ্চিন্তা, ভয়, অস্থিরতা কাজ করে।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেবার পরেও ক্লান্তি যেতে চায় না।
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। স্থায়ী মাথার যন্ত্রণা। ঘুমের প্রচণ্ড ব্যাঘাত ঘটে।
যাঁদের হাঁপানি আছে, তাঁদের জন্য স্ট্রেস খুবই মারাত্মক। এর ফলে প্যানিক অ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে।
ক্রনিক স্ট্রেস আমাদের ফুসফুস ও পাকস্থলীর সমস্যা আনে। এর ফলে বিভিন্ন প্রকার গ্যাসট্রোইনটেস্টিনাল রোগ, হজমের সমস্যা শুরু হয়। বমি হয়। গলা, বুকজ্বালা, কোষ্ঠকাঠিন্য হয় বা কারও কারও ডায়েরিয়া হতে পারে। পেট ফাঁপা, অন্ত্রের প্রদাহজনক রোগ, আলসারেটিভ কোলাইটিস ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
যৌনইচ্ছা কমে যায়। এর ফলে সম্পর্কে সমস্যা আসে, চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়।
নারী এবং পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রজনন ক্ষমতায় বেশ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে স্ট্রেস।
দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি কমিয়ে দেয়। ফলে ঘন ঘন সর্দি, ঠান্ডা-লাগা এবং সংক্রমণ তৈরি হয়।
মানসিক চাপ উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতা দুই আনে। কাজকর্মে প্রবল অনীহা তৈরি হতে শুরু করে। সামাজিক সম্পর্ক থেকে ব্যক্তি ধীরে ধীরে দূরে সরে যান। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পছন্দ করেন।
অনেকেই মানসিক চাপ হলে খুব বেশি খান বা একদম খাওয়া ছেড়ে দেন। ফলে হয় ওজন বাড়তে থাকে না হয় কমে যায়। দুটোই ক্ষতিকর।
আরও পড়ুন-শিশুচুরি হলেই বাতিল করা হবে হাসপাতালের লাইসেন্স : সুপ্রিম কোর্ট
মানসিক চাপ দূর করতে
ঘুম আমাদের মনের অনেক ব্যাধি দূর করে। স্ট্রেস কমায়। ৬ থেকে ১২ বছর বয়সিদের জন্য ৯ থেকে ১২ ঘণ্টা। এই ব্যস্তযুগে কিশোর-কিশোরী এবং প্রাপ্তবয়স্ক জন্য ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। ভাল ঘুমের জন্য রাতে স্ক্রিন ব্যবহার কমিয়ে ফেলা দরকার।
নিয়মিত যোগাসন বা ব্যায়াম বা এরোবিক্স চাপ কমাতে খুব ভাল কাজ করে। আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, মেজাজ ভাল রাখে এবং হালকা বিষণ্নতা ও উদ্বেগের লক্ষণও কমাতে পারে।
মানসিক চাপমুক্ত হতে নিজেকে সময় দেওয়া জরুরি। সময় বের করে পছন্দের কাজটা করুন। যা ভাল লাগে তাই মাঝেমধ্যে খেতে হবে। বেড়াতে যেতে হবে। পরিবেশ বদল হলে অনেক সময় মানুষ তাঁর পুরনো এনার্জি ফিরে পায়।
হাইফাইবার যুক্ত খাবার যেমন ওটমিল, বাদাম, মটরশুঁটি, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন লেবু, স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, আঙুর, ব্ল্যাকবেরি, পনির, চিকেন, ডাল, ডিম, টকদই মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য,করে। উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা কোলেস্টেরল থাকলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে চার্ট করে নিন।
ডার্ক চকোলেট খান। এতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট এবং ফ্ল্যাভোনয়েডে যা মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে। পাশাপাশি, ‘হ্যাপি’ হরমোন বা এনডরফিন ক্ষরণে সহায়তা করে। ফলে উদ্বেগ, অবসাদের মতো সমস্যা নিয়ন্ত্রণে থাকে। ডার্ক চকোলেটে থাকা ম্যাগনেশিয়াম স্নায়ুর উত্তেজনা প্রশমনে সাহায্য করে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, উদ্বেগ ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ভিটামিন ডি-এর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। সামুদ্রিক মাছে এই দুটি উপাদানটি থাকে ভরপুর মাত্রায়।
অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টে সমৃদ্ধ ক্যামোমাইল টি স্নায়ুর উত্তেজনা প্রশমিত করে। অনিদ্রাজনিত সমস্যায় খুব উপকারী।
কলা একটি সুপার ফুড। কলার মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম। যা মানসিক চাপ কমায়, মুড স্যুইং আটকায়, মন ভাল রাখে।
স্ট্রেস কমাতে ক্যাফেইন গ্রহণের মাত্রা কমান কারণ এটি কর্টিসল বাড়ায় যা আপনার মেজাজের ওপর প্রভাব ফেলে। উচ্চমাত্রা ক্যাফেইন প্রথমে ফিলগুড অনুভব করালেও পরে তা ক্ষতি করে।