বিশ্ব থিয়েটারের কথা

থিয়েটার এমন এক শক্তিশালী মাধ্যম যার মধ্যে দিয়ে সমাজের সর্বস্তরের হৃদয়ের আবেদনকে তুলে ধরা যায়। থিয়েটার আমাদের পথ দেখায়। কিন্তু এখন এমন এক সময় যখন পৃথিবীর অস্তিত্ব নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ঘণ্টায়, মিনিটে বা কোনও খবরের বিবরণে তখন থিয়েটার শিল্পের প্রতি আগ্রহ অনেকটাই অস্তমিত। সম্প্রতি পেরিয়ে এলাম ‘বিশ্ব থিয়েটার দিবস’। এই দিনটি পালন কেন গুরুত্বপূর্ণ সেই নিয়ে লিখলেন শঙ্কর ঘোষ

Must read

প্রস্তাবনা
ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট (সংক্ষেপে আইটিআই) বিশ্ব থিয়েটার দিবস উদযাপন করে চলেছে ১৯৬১ সাল থেকে। এটা শুরু হয়েছিল ২৭ মার্চ ১৯৬১ সালে। সেইসময় ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে এই উদযাপন বার্তা ছড়িয়েও পড়েছিল। প্রথমবারের ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের ভাষণটি লিখেছিলেন ফ্রান্সের জিন ককটিও। ১৯৬১ সালের তৎকালীন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট আর ভি কিভিমা প্রস্তাব করেছিলেন যে এই ধরনের একটা ইনস্টিটিউট তৈরি হওয়া দরকার। সেখান থেকেই ব্যাপারটি এগিয়ে আসে এবং ছড়িয়ে পড়ে স্ক্যান্ডিনাভিয়াম সেন্টারগুলিতে এবং সেই বার্তা আবার পরে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে প্রতিবছর ২৭ মার্চ দিনটিকে গোটা পৃথিবী পালন করে বিশ্ব থিয়েটার দিবস হিসেবে এবং প্রতি বছর এই দিনে কোনও না কোনও বিশ্বনাট্যব্যক্তিত্ব বিশ্বের নাগরিকদের উদ্দেশ্যে বর্তমানের নানাবিধ সংকট নিয়ে কিছু কথা বলেন, আহ্বান জানান ঐক্যবদ্ধভাবে সংকটের মোকাবিলা করে মানুষের উন্নতিতে নিজেকে উৎসর্গ করার। চলতি ২০২৫ সালে এই বার্তাটি দিয়েছেন থিওডোরোস টেরজোপোলোস।

আরও পড়ুন-সুরক্ষিত থাক বনভূমি

সংক্ষিপ্তসার
তাঁর মূল ভাষণটির বাংলা রূপান্তর করলে এরকমই দাঁড়ায় যে, আমাদের সময় যে আত্মদর্শনের আর্তি শোনাচ্ছে তা কি আমাদের থিয়েটার শুনতে পায়? আজ হতদরিদ্র নাগরিকরা আন্তর্জালিক বাস্তবতার কুঠুরিতে আবদ্ধ। তাঁরা আজ গোপনীয়তার মধ্যে আটকে গেছে? এই সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ, সার্বিক দমন ব্যবস্থা আর কৃত্রিম যাপনের মধ্যে কি জীবনের বর্ণালি বিচ্ছুরিত হওয়ার স্পর্ধা দেখতে পারে? থিয়েটার কি পরিবেশগত ধ্বংস, বিশ্ব উন্নয়ন, ব্যাপক বৈচিত্রের ক্ষতি, সমুদ্রদূষণ, বরফ গলন, দাবানল বৃদ্ধি এবং আবহাওয়ার চরমতম বিপর্যয় নিয়ে চিন্তিত? থিয়েটার কি বস্তুতন্ত্রের একটা সক্রিয় অংশ হতে পারে না? থিয়েটার বহু বছর ধরে পৃথিবীতে মানুষের যাপন ও প্রভাবকে পর্যবেক্ষণ করে আসছে যথার্থভাবে। কিন্তু সমাজ ও জীবনের এইসব সমস্যা মোকাবিলা করা নাটকের জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে ক্রমে ক্রমে। একবিংশ শতাব্দীতে যখন মানুষের অবস্থা বিবর্তিত হচ্ছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ, মিডিয়া নেটওয়ার্ক এবং মতামত গঠনকারী সংস্থাগুলির দ্বারা, তখন থিয়েটার কি সেই পরিস্থিতি নিয়ে আদৌ চিন্তিত? সমাজমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া আজ যোগাযোগের সবচেয়ে বড় বিকল্প হয়ে উঠেছে, আর এর মাধ্যমেই যোগাযোগকে সহজতর করে তুলেছে। আর এর মাধ্যমেই সোশ্যাল মিডিয়া অন্যদের থেকে প্রয়োজনীয় নিরাপদ দূরত্ব তৈরি করে ফেলতে পেরেছে কৌশলে। অন্য কেউ বা অপরিচিতের প্রতি এক বিস্তৃত ভয়ের অনুভূতি আমাদের চিন্তা ভাবনা এবং কর্মকাণ্ডে ব্যাপক প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করেছে। থিয়েটার কি এই বৈষম্যকে দূর করার জন্য একটি কর্মশালা বা মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে না? আমাদের বুকের গভীরে যে ভয়ের অন্তঃক্ষরণ তাকে কি নাটক প্রতিরোধ করতে পারে না? এই অবিরাম অন্তঃক্ষরণ আমাদের পুরনো ঐতিহ্যকে পুনর্গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। আজ বিশ্বনাট্য দিবস। এই প্রসঙ্গে টেরজোপোলোস আরও বলেছেন, আসুন আমরা জিউস এবং সেমেলের সন্তান সেই আনন্দময় নাট্য ও পুরাণের দেবতা ডায়োনিসাসের চোখের দিকে তাকাই, যিনি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎকে ঐক্যবদ্ধ করেন, যিনি নারী এবং পুরুষ, ক্রোধ এবং দয়া, দেবত্ব এবং পশুত্ব, উন্মাদনা এবং যুক্তি, শৃঙ্খলা এবং বিশৃঙ্খলার মাঝামাঝি জীবন এবং মৃত্যুর সীমারেখায় একজন আকর্ষণীয় বিনোদনের শিল্পী। ডায়োনিসাস একটি মৌলিক অস্তিত্ববাদী দার্শনিক প্রশ্ন উত্থাপন করেন, ‘‘এটাই কি সব?’’ এ-হল এমন একটি প্রশ্ন যা প্রশ্নকর্তাকে পৌরাণিক কাহিনির মূল এবং মানবরহস্যের বহুমাত্রিক দিক সম্পর্কে আরও গভীর অনুসন্ধানের দিকে পরিচালিত করে। বর্তমান মধ্যযুগের বহুমাত্রিক একনায়কতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের স্মৃতির চর্চা করতে হবে এবং একটি নতুন নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব গঠনের লক্ষ্যে আমাদের নতুন এক আদর্শের অভিমুখে অগ্রসর হতে হবে।
পরিচিতি
এই যে বক্তব্য যিনি রাখলেন তাঁর সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। তিনি এক তরতাজা মানুষ, নাটক পাগল। গত শতকের মধ্যভাগে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল। তিনি কলেজ ক্যাম্পাসে স্বভাব রসিক এবং খানিকটা খ্যাপাটে বলে সুখ্যাত। বর্ণবৈষম্য, যুদ্ধ-বিরোধিতা, বিশ্বশান্তি, দারিদ্ দূরীকরণ, অভিবাসন সমস্যা, উদ্বাস্তু নিপীড়ন বা শরণার্থী সংকট নিয়ে তিনি তাঁর আগুনঝরা লেখা লিখেই চলেছেন, এখানে সেখানে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েই চলেছেন। আর করে চলেছেন নাটক। নিখুঁত পরিচালনা, বর্ণময় পরিবেশনা এবং সামগ্রিক প্রযোজনার কল্যাণে তিনি পঞ্চমুখে তারিফ পেয়েছেন থিয়েটারের আচ্ছা আচ্ছা বিশেষজ্ঞদের। টেরজোপোলোসের খ্যাতি নাট্যনির্দেশক, শিক্ষাবিদ, লেখক, এটিস থিয়েটার কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্দেশক হিসেবে। ১৯৪৫ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন নর্দার্ন গ্রিসে। কসটিস মিকাভিলাস স্কুলের ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষিত হয়েছেন (১৯৬৫ থেকে ৬৭)। তিনি উচ্চতর ডিগ্রি পেলেন বার্লিনের এনসেমবেল থেকে। সহকারী নির্দেশক হিসেবে তিনি কাজ করেছেন হেনিয়ার মুলার, ম্যানফ্রেড ওয়েকওয়ার্থ প্রমুখের কাছে। প্রাচীন নাটক নিয়ে তিনি কাজ করেছেন ১৯৮৫ সাল থেকে টানা ১৫ বছর। ১৯৮৫ সালেই এটিস থিয়েটার গ্রুপ তিনি তৈরি করলেন। সেই থেকে ২৩০০ রজনী তিনি অভিনয় করিয়েছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক থিয়েটার উৎসবগুলিতে। প্রাচীন নাটকের পাশাপাশি আধুনিক নাট্যকারের নাটকেরও তিনি মঞ্চায়ন করিয়েছেন। ব্রেখট্-এর নাটকেরও তিনি মঞ্চায়ন করিয়েছেন।

আরও পড়ুন-হার্দিক ফিরলেও জয়, অধরা থাকল মুম্বইয়ের

আরও কিছু তথ্য
এবারে দেখা যাক ইতিপূর্বে কারা এই বিশ্ব থিয়েটার দিবসে বাণী দিয়েছেন। ২০২১ সালে এই বিশ্ব থিয়েটার দিবসের বাণী দিয়েছেন হেলেন মিরেন। ২০২২ সালে বাণী দিয়েছেন পিটার সেলার্স। ২০২৩ সালে বাণী দিয়েছেন সামিদা আইঅব। ২০২৪ সালে বাণী দিয়েছেন জন ফসি।
বিশ্ব থিয়েটার দিবস সম্পর্কে আরও কিছু কথা মানবজাতি এক নবীন গভীর ও বদলে যাওয়া সময়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে, আমরা বাস করছি সময়ের কিনারায়। সংবাদপত্র আর গণমাধ্যম সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত এবং অক্ষম আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অনুধাবনে। কোভিড ১৯-এর দু’-দুটো বছর ভোঁতা করে দিয়েছে মানুষের ইন্দ্রিয়গুলিকে, সংকীর্ণ করে দিয়েছে মানুষের জীবনযাপনকে, ভেঙে দিয়েছে সব সম্পর্ককে এবং আমাদের টেনে নামিয়েছে এক অদ্ভুত অবিশ্বাস্য গ্রাউন্ড জিরোতে। এত বেশি সংখ্যক মানুষ আজ ধ্বংসের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে, এত বেশি হিংসা-বিদ্বেষ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে যুক্তিহীনভাবে, এত অবাধ নির্মমতা বাসা বেঁধেছে চেনাজানা ব্যবস্থার মধ্যে, সেখানে এখন আমাদের স্মরণের উৎসব কীভাবে বা হতে পারে? কোনও-না কোনও নতুন আচারশাস্ত্র আমাদের মতো নাট্যকর্মীদের বারবার নতুন কল্পনার জগতে টেনে আনবে যা আমাদের নবীন মহড়ায় উদ্বুদ্ধ করবে। নাট্যকর্মীদের এখন খুঁজতে হবে কীভাবে পুনরাবৃত্তিমূলক সুলভ অন্তহীন নষ্ট-সময়কে ছাপিয়ে স্পর্শ করতে পারব এক জীবনে যা কিছু পবিত্র ও অনন্ত। সে-কাজ একা-একা সম্ভব হবে না। সবাইকে মিলেই কাজটা করতে হবে। থিয়েটার আমাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে একত্রিত হতে। সেইভাবে মগ্ন হয়ে কিছু সৃজন করা যা এতকাল ছিল অজানা।
এই দিনটিতে প্রত্যাশা
আজ থেকে সিকি শতাব্দী আগেই আমরা দু’-দুটো বিশ্বযুদ্ধের বিষক্রিয়ায় দগ্ধ বিংশ শতাব্দীকে পিছনে রেখে একবিংশ শতাব্দীর মধ্যে প্রবেশ করেছি। এখন ২১ শতকের তৃতীয় দশক চলছে। কিছুদিন আগেই আমরা প্রায় দু’বছর ধরে গত ১০০ বছরের ভয়ানকতম বিশ্বব্যাপী করোনা অতিমারির সংকট পেরিয়ে এসেছি। ফলে, জীবন ইতিমধ্যে অনেকটাই বদলে গিয়েছে। বাস্তব এখন আরও গভীর, মানুষ বিপন্ন থেকে বিপন্নতর, যন্ত্রসভ্যতার অভিঘাত আর বিশ্বায়ন আমাদের গলার টুঁটি চেপে ধরেছে। কোনওক্রমে টিকে থাকাটাই একটা বড় কঠিন সমস্যা। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে বসে ব্যক্তি প্রতিনিয়ত তাঁর মূল্যবোধকে বিসর্জন দিচ্ছে। এখন মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে বললে কম বলা হয়, বলতে হয় অবক্ষয়িত মূল্যবোধে নতুন সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। সাহিত্যের নানা শাখার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ শাখাটি হল নাটক। থিয়েটার এমন একটি শক্তিশালী মাধ্যম যার মধ্য দিয়ে সমাজের সমস্তস্তরের মানুষদের হৃদয়ে আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম। নাটক মঞ্চস্থ হয় এবং তা অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের তথা মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়। শিক্ষিত-অশিক্ষিত অল্প শিক্ষিত, স্বশিক্ষিত, নির্বিশেষে সকল মানুষই নাট্যরস উপভোগ করতে পারেন।

আরও পড়ুন-প্রেমে বাধা, দাদাকে নৃশংস খুনে ফাঁসির সাজা হল ভাইয়ের

নিজেদের উপর আলোকপাত
এবার নিজেদের দিকে একটু তাকানো যাক। বাংলার সাধারণ রঙ্গালয় তথা পেশাদারি নাট্যশালাগুলি গড়ে উঠতে সময় লেগেছিল কম করে ২০০ বছরের বেশি। বাংলা থিয়েটার জগতের ঐশ্বর্য যুগে দীনবন্ধু মিত্র, মধুসূদন দত্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ প্রমুখ নাট্যকারেরা কোনও না কোনও ভাবে রঙ্গমঞ্চগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গিরিশচন্দ্র এবং ক্ষীরোদপ্রসাদ পেশাদারি নাট্যকার হয়ে উঠেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এসে বিষয়টিকে আরও বিস্তৃত করে দিলেন। সেই সময়কাল পার হয়ে আমরা যখন বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ, ষাট, সত্তরের দশক অতিক্রম করছি তখন দুটি ধারার নাটক সমান্তরালভাবে চলছিল বাংলার বুকে। একদিকে পেশাদারি রঙ্গমঞ্চগুলির নাটক। অপরদিকে, গ্রুপ থিয়েটারের নাটকগুলি। হাতিবাগান থিয়েটার পাড়াটাকে একসময় তো লন্ডনের থিয়েটার পাড়ার সঙ্গে তুলনা করা হত। তার কারণ, সেখানে পাশাপাশি রয়েছে স্টার থিয়েটার, বিশ্বরূপা থিয়েটার, রংমহল থিয়েটার, রঙ্গনা থিয়েটার, সারকারিনা, বিজন থিয়েটার। এর আশপাশেই ছিল মিনার্ভা থিয়েটার, কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ। সেই থিয়েটার বিলুপ্ত হতে দশ বছর সময়ও লাগেনি। বাংলা পেশাদারি থিয়েটারের দিকে প্রগতিশীল মানুষরা চিরকালই একটু ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকেছেন। অপেশাদারি বাংলা থিয়েটারের সচেতন রাজনীতিসমৃদ্ধ কর্মীদের অনেকেই তখন বলতেন ‘ওরা’। ভাবখানা এমন ‘ওরা’ মানে ওপারের ফুটপাথের মানুষেরা, বিপ্লব-বিবর্জিত লোকজনেরা। এই উন্নাসিকতা পেশাদারি থিয়েটারকে যেমন সহমর্মিতা লাভ থেকে বঞ্চিত করেছে, তেমনি অপেশাদারি থিয়েটারকেও বাঁচার পথে সামান্যতম সাহায্য করেনি। যে নীতিহীনতাকে ঘৃণা করত রাজনৈতিক-শিক্ষিত অপেশাদারি থিয়েটার, তাদের অনেকেই কিন্তু নীতিহীনতারই শিকার! এই বিভাজন যত বেড়েছে সংস্কৃতি ততই দুর্বল হয়েছে। তার পিঠে সওয়ার হয়েছে রাজনৈতিক মাফিয়া আর প্রোমোটারের দল। গ্রুপ থিয়েটারের দৈন্যদশাও চাপা থাকেনি। সেখানে দেখতে পাই যে একটা গ্রুপ কীভাবে ভেঙে গিয়ে আরেকটা গ্রুপ তৈরি করেছে। গ্রুপ থিয়েটারের নাটক বললেই প্রথম যে দুটি মুখ আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার একটি হল উৎপল দত্তের এবং অপরটি হল শম্ভু মিত্রের। পাশাপাশি পাচ্ছি অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, মনোজ মিত্র, বিভাস চক্রবর্তী-সহ বিশিষ্ট নাট্যকারদের অভিনেতাদের। শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্র মিলে যে বহুরূপী গোষ্ঠী চালনা করেছিলেন সেখানে বিজন ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে বহু বিশিষ্টজনই যুক্ত ছিলেন এবং তাঁরা যে-সমস্ত নাটক মঞ্চস্থ করেছেন তার অনেকগুলোই কিন্তু বিদেশি নাটক থেকে বাংলায় রূপান্তর করে। যেমন উল্লেখযোগ্য হল রাজা ওয়াদিপাউস। এ-ছাড়াও তাঁরা করেছেন দশচক্র পুতুল খেলা যেগুলি বিদেশি নাটক থেকেই অনুপ্রাণিত। উৎপল দত্ত তাঁর গ্রুপ পিএলটি তৈরির সময় থেকেই শেক্সপিয়রের বিখ্যাত নাটকগুলিকে বঙ্গ-রূপান্তর করেছিলেন। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়-রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত নান্দীকার গোষ্ঠীতে থাকাকালীন সেই একই কাজ করেছেন। তাঁদের বিখ্যাত নাটকগুলি সবই কোনও না কোনও বিদেশি নাটকের থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে। কিন্তু এমন একটি অবস্থা এসে দাঁড়াল যে সেই বহুরূপী ছেড়েই শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্রকে বেরিয়ে আসতে হল। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের সঙ্গে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবাদের সূত্র ধরে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বেরিয়ে আসতে হল নান্দীকার থেকে। পেশাদারি রঙ্গমঞ্চগুলির ঝাঁপ অনেককাল আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অপেশাদারি থিয়েটার অর্থাৎ গ্রুপ থিয়েটারগুলি যে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অভিনয় করে সেখানে ধারাবাহিকতাটা বজায় থাকছে না। বিদেশি নাটক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর মৃত্যুর পূর্বে বেশ কিছুদিন কিং লিয়ার নাটকের অভিনয় করেছিলেন। ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে’ এই কথাটাকেই মন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে আমরা এই সমস্ত নাট্যকারের ইংরেজি নাটক বা বিদেশি নাটক থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অভিনয় করতে দেখেছি।

আরও পড়ুন-বিনিয়োগের বিষয়গুলি দেখতে নির্দেশ মুখ্যসচিবকে, ফিরলেন মুখ্যমন্ত্রী

আজকের দিনের শপথ
বিশ্ব থিয়েটার দিবসের প্রসঙ্গে আজকে আমরা এই শপথটাই করতে পারি, আসুন আমরা সকলেই নিজেদের বিকশিত করি ঐক্যবদ্ধ পৃথিবী ও সম্মিলিত মানবতার সন্ধানে। নাটক আমাদের সেই পথচলা দেখাক।

Latest article