আজও সুদর্শন-ক্যারিশমাটিক নেতাজিতে মুগ্ধ কোহিমা

নেতাজি ও তাঁর আজাদ বাহিনীকে ঘিরে আপামর ভারতবাসীর আজও অনন্ত আবেগ। দেশের উত্তর-পূর্বে ছবির মতো রাজ্য নাগাল্যান্ড ও তার রাজধানী কোহিমার মানুষদের কাছে কিন্তু আবেগ উপচে স্মৃতির সমাহার। মানুষটার ক্যারিশমা, তাঁর সাহস, তাঁর দৃঢ়তা, লড়াই আর সঙ্গে মাটির ব্যবহার— সব যেন আজও বড্ড জ্যান্ত! নাগাল্যান্ড ঘুরে এসে লিখলেন জয়িতা মৌলিক

Must read

দেশের বীরপুত্র নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে পরতে পরতে জড়িয়ে তাঁর নাম। পাহাড়ের কোলে থাকা নাগাল্যান্ড। তার রাজধানী কোহিমা। সেখানেই ছড়িয়ে রয়েছে নেতাজির স্মৃতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দাগ বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে কিগুয়েমা, রুজাজো।
দীর্ঘ ৬ বছরের বেশি সময় ধরে চলেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্বের মানচিত্রের এক প্রত্যন্ত গ্রাম কোহিমায় পৌঁছয় তার আঁচ। ১৯৪৪-এর ৪ এপ্রিল থেকে ৬ জুন— ৬৪ দিন ধরে ভয়ঙ্কর বিরামহীন যুদ্ধ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামার মধ্যেই আজাদ হিন্দ ফৌজ বাহিনী জাপানের সাহায্য নিয়ে ভারত জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছিল। ১৯৪৪ সালের ১৪ এপ্রিল বিকেল ৫টায় ইম্ফল থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে মণিপুরের বিষ্ণুপুর জেলার মৈরাঙ অঞ্চলে প্রথম ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে আজাদ হিন্দ বাহিনী। পাহাড় ঘেরা অঞ্চলে সূচনা হয় ভারতের বিজয় উৎসব। মিত্রশক্তির অঙ্গ হিসেবে দিল্লি যাওয়ার পথে কোহিমাতে আটকানো হয় জাপান ও নেতাজির যৌথবাহিনীকে। পরাজিত হলেও, আজাদ বাহিনীর সংগ্রামে বীরত্বের বীজ বোনা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে কোহিমা থেকেই ভারতের বিজয়সূচক ইতিহাসের শুরু বলে মনে করা হয়। আজাদ হিন্দ বাহিনীর স্মরণে মৈরাঙে এখনও রয়েছে আইএনএ-র প্রধান কার্যালয়। সেটা মিউজিয়ামে রূপান্তরিত হয়েছে। আছে নেতাজির মূর্তিও। ইতিহাসের পাতায় ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলিত হলেও ভারতের বিজয় পতাকা প্রথম উত্তোলিত হয়েছিল মৈরাঙে।

আরও পড়ুন-কেজরিওয়ালের গাড়িতে হামলা চালাল বিজেপি

আর সেই আবহেই নাগাল্যান্ডের রুজাজোয় পৌঁছলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। স্থানীয়দের কথায়, ঘোড়ায় চড়ে পৌঁছন সুভাষ বসু। কোমরে গোঁজা তলোয়ার। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন লম্বা, ফর্সা এবং সুদর্শন। তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন গ্রামের মহিলারা। তাই দেখে রীতিমতো তাঁদের সঙ্গে খুনসুটি করতেন রুজাজো গ্রামের পুরুষরা। সেই কথা একদিন যায় নেতাজির কানে। শুনে হেসে ফেলেন তিনি।
আইএনএ এবং জাপানি বাহিনী যে-পথে ভারতে ঢোকে তার মধ্যে একটি ছিল নাগাল্যান্ডের ছোট্ট গ্রাম রুজাজো। ১৯৪৪-এর ৪ এপ্রিল সেখানে শিবির করেন নেতাজি। দিল্লির দিকে যৌথবাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কোহিমায় আইএনএ-এর মেজর জেনারেল শাহ নওয়াজ খানের নেতৃত্বে বাহিনী তৈরি করেন সুভাষ। কিন্তু নেতাজির নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তায় ছিল জাপানিরা। কিন্তু সেই ভয় সুভাষকে আটকাতে পারেনি। নাগাদের যোদ্ধা মানসিকতা সঙ্গে নিয়ে বীরবিক্রমে এগিয়ে চলেন ‘দেশনায়ক’।
১৯৪৪-এর মার্চেই সুভাষের নেতৃত্বে বাহিনী ইম্ফল ও কোহিমার দিকে অগ্রসর হয়। যার আসল লক্ষ্য ছিল দিল্লি। অসম-নাগাল্যান্ডের গহন অরণ্যের বুক চিরে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন নেতাজি। যা সফল হলে, সেই সময়ই ভারত ছাড়তে হত ব্রিটিশ সরকারকে। আর আক্ষরিক অর্থেই দেশনায়ক হতেন সুভাষচন্দ্র বসু। তখন নাগা পাহাড়ে অল্প কিছু রাস্তা ছিল। এখনও ওই অঞ্চলে রাস্তা তেমন বেশি নেই। তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে জাপানি বাহিনী এগিয়ে চলে।
রুজাজো পৌঁছনোর আগেই সোমরা গ্রামে থেমেছিলেন সুভাষ। এক অপূর্ব পাহাড়ি গ্রাম। বাড়ির বারান্দার উপরে ফুলের বাক্স। পাথরের পাকারাস্তা বৃষ্টির জলে স্নাত। একটি বড় কাঠের বাড়ি— যেখানে নেতাজি থাকতেন— তার দরজার মাথায় নাগা সংস্কৃতি মেনে লাগানো থাকত পাহাড়ি গবাদি পশুর খুলি। ঘরের ভিতরে একটা মাত্র আলো। এখনও সেই ঘর সংরক্ষিত।
যুদ্ধবিরতিতে এক বিশাল কাঠের গুঁড়ি-বিছানো বিছানায় বিশ্রাম নেন সুভাষ। উঁচু বাড়িটি ছিল অন্ধকার, ঠান্ডা। জানালা দিয়ে আসা তেরচা সূর্যের রশ্মিতে ধূলিকণা নাচে। ভিতরে এখনও সামরিক পোশাকে লম্বা মালা-পরা নেতাজির কাট আউট। স্থানীয়রা জানান, বোস এবং আইএনএ-সৈন্যরা বিশাল ঘোড়ায় চড়ে গ্রামে এসেছিলেন। সেই ঘোড়াগুলো খিদেয় ছাদের সব খড় খেয়ে নেয়।

আরও পড়ুন-এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতির বিরুদ্ধে চিঠি ১৩ প্রবীণ আইনজীবীর

পৌঁছে নেতাজি একজন শিক্ষিত গ্রামবাসীর খোঁজ করেন। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়া এক কিশোরকে খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর দাদা সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তাঁকে দোভাষী হিসেবে বেছে নেন সুভাষ। নেতাজির সুদর্শন চেহারা, বিনয়ী, সহৃদয় ব্যবহার নাগাদের মন জয় করে নেয়। রুজাজো ছিল ভারতের প্রথম আইএনএ-শাসিত গ্রাম।
সুভাষ যখন নাগাল্যান্ডে পৌঁছে বাহিনীকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন, তখন তিনি পাশে পান বেশিরভাগ নাগাদের। কারণ, তাঁরা ছিলেন যোদ্ধা। কিন্তু ব্রিটিশ বাহিনী তাঁদের যোগ্য সম্মান দেয়নি। ফলে নেতাজি আসার পরে, তাঁর সঙ্গ নেন নাগারা।
নেতাজির নাগাল্যান্ড পৌঁছনোর খবর যায় ব্রিটিশদের কাছে। সঙ্গে জাপানি বাহিনী। ফাইটার প্লেন বোমা বর্ষণ করে। স্থানীয়দের রক্ষা করতে বাঁশঝাড়ের মধ্যে সভার আয়োজন করেন সুভাষ। সেই জায়গায় এখনও বোমার খোল, না-ফাটা বোমা, বুলেট-খোল পড়ে থাকতে দেখা যেতে পারে।
কিগুয়েমাতে জাপানি মেজর জেনারেলের সঙ্গে বৈঠক করেন নেতাজি। সেখানে সুভাষের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিল নাগারা। সেই কারণেই তাঁদের বৈঠকের জায়গা করা হয়েছিল কিগুয়েমার সবচেয়ে উঁচু টিলায়। খাঁচা পাথরের ধাপ পেরিয়ে উঠতে হয় সেখানে। চারিদিক সবুজ পাহাড় দিয়ে ঘেরা। সেই সময় কিগুয়েমার যুবকরা থাকতেন মোরাং-এ। যদি হঠাৎ করে আক্রমণ হয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিহত করতে একজোট হয়ে বেরোনো যায়। নাগাদের জীবনশৈলীর উপর ভিত্তি করে খালি পায়েই তাদের বাহিনীতে শামিল করার অনুমতি দিয়েছিলেন নেতাজি। কিগুয়েমার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই আইএনএ-র মালবাহক হিসেবে কাজে যোগ দেন। দুর্গম পর্বত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ভারী সামগ্রী, জল, জ্বালানিকাঠ এবং রেশন বহন করতেন তাঁরা। সৈন্যদের জন্য অস্থায়ী শিবির নির্মাণে অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। আর সেই সবই করতেন নেতাজির প্রতি আনুগত্যে। কারণ সুভাষের কথা, উপজাতির প্রতি সম্মান, ক্যারিশমা— সব কিছুতেই মন্ত্রমুগ্ধ ছিলেন নাগারা। আগলে রাখতেন তাঁদের প্রিয় নেতাজিকে। তবে, সুভাষ বসুকে নিরাপত্তা দেওয়া, আইএনএ-তে শামিল হয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার তেমন স্বীকৃতি কিগুয়েমা, রুজাজো পায়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। কিন্তু এখনও নেতাজির স্মৃতি সযত্নে লালন করছে নাগাল্যান্ড।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর কোহিমা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য স্থান হিসেবে জায়গা করে নেয় কোহিমা-সহ নাগাল্যান্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। গ্যারিসন পাহাড়ের চারদিক থেকে ১০০০-এর কম মিত্রবাহিনীর সেনাকে ঘিরে রাখা হয়েছিল। ডিমাপুর থেকে কোহিমা যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটি জাপানিরা কেটে ফেলায় গোলাবারুদ এবং খাদ্য সরবরাহের ঘাটতি ছিল। অনেক অ-যোদ্ধা-গাড়ির চালক, বাবুর্চি, কেরানিকে আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হয়। ১৩ দিন ভারীসংখ্যক বাহিনীর আক্রমণকে আটকাতে পারে নাগা বাহিনী। টেনিস কোর্ট এবং ডিসি বাংলো এলাকার চারপাশে মুখে মুখে ঘোরে সেই কোহিমার যুদ্ধের গল্প। ফিল্ড মার্শাল উইলিয়াম স্লিম একবার লিখেছিলেন যে, কোহিমার যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ’ হিসেবে লেখা থাকবে।
এদিকে, ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ২য় ডিভিশন ডিমাপুর থেকে কোহিমায় এগোতে সক্ষম হয়। অবশেষে ১৯৪৪ সালের ১৮ এপ্রিল কোহিমায় পৌঁছে মিত্রবাহিনীকে অনেক স্বস্তি এনে দেয়। ২য় ডিভিশন ধীরে ধীরে কোহিমা ও তার আশপাশ থেকে জাপানি বাহিনীকে তাড়িয়ে দেয়। মিত্রবাহিনীর জোরালো প্রতিরোধের মুখে শেষ পর্যন্ত জাপানি বাহিনীকে বার্মার দিকে পিছু হটতে হয়। দু’পক্ষের হতাহতের সংখ্যা ছিল যথেষ্ট বেশি।
কোহিমা ওয়ার সিমেট্রিতে কোহিমার সেনাদের সমাহিত করা হয়। কোহিমা যুদ্ধ-কবরস্থানে কোহিমার যুদ্ধে লড়াই করা সাহসী সেনাদের ১৪২১টি কবর রয়েছে। ভিক্টোরিয়া ক্রস হোল্ডার রয়েছে, যা কোহিমা যুদ্ধ-কবরস্থানে সমাহিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ সম্মান।
কোহিমা যুদ্ধ-কবরস্থানের নিচে পাথরের প্যানেলে খোদাই করা কোহিমার যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন এমন সৈন্যদের নাম-সহ ২য় ডিভিশনের স্মারক রয়েছে।

আরও পড়ুন-বাঘের হামলায় মৃত্যু বৃদ্ধের, মার খেলেন বনকর্তারা

রক্তক্ষয়ী ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জাদুঘর
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর কোহিমা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নাম। কোহিমা জেলার অধীন হেরিটেজ ভিলেজ কিসামা। যুদ্ধের স্মৃতি আর ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটিও। সেখানেই রয়েছে ২য় বিশ্বযুদ্ধ জাদুঘরটি। সেখানে রয়েছে নাগাবাহিনী আর জাপানি সেনা আধিকারিকদের সঙ্গে নেতাজির সাক্ষাতের বিভিন্ন নিদর্শন।
২০০৮ সালে জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়। যুদ্ধের সময়কার প্রত্নবস্তুর সংগ্রহ, মডেল এবং ভিস্যুয়াল প্যানেলের মাধ্যমে সেখানে যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, ঘটনার ব্যাখ্যা করে। অডিও-ভিস্যুয়াল উপস্থাপনার মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ঘটনা জীবন্ত হয়ে ওঠে এই মিউজিয়ামে। দেখানো হয় তথ্যচিত্রও। সেইসব স্মৃতিকে জীবন্ত করে তোলে ওই সব ভিডিও।
কোহিমায় পরাজয়ের সঙ্গে, কোহিমা হয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডে অগ্রসর হওয়ার জাপানি সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। কিন্তু অসম সাহসের সঙ্গে লড়াই করে নাগাবাহিনী। পাহাড়ের ধাপ আর ঘন জঙ্গলকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজ বাহিনীর উপর আঘাত চালিয়ে যায় তারা। সেই যুদ্ধক্ষেত্রের নিখুঁত মডেল তৈরি করা হয়েছে সেখানে। যুদ্ধ করতে গিয়ে একসময় শেষ হয়ে যায় অস্ত্র। খালি হাতেই যুদ্ধে নামেন নাগা সেনারা। মডেলে মূর্ত হয়ে ওঠে সেইক্ষণ। আর স্মরণে আসেন নেতাজি। কারণ, তিনিই নাগা সেনাদের মনোবল জুগিয়েছিলেন।
জাদুঘরে প্রদর্শন করা হয়েছে কোহিমার দীর্ঘ যুদ্ধের সময়ে দু’পক্ষের ব্যবহৃত অস্ত্রের ধ্বংসাবশেষ এবং বিভিন্ন সরঞ্জাম যা যুদ্ধের সময় ব্যবহার করা হয়। রয়েছে সেই সময়ের ছবি। যেসব জাপানি সেনাধ্যক্ষর সঙ্গে নেতাজি বৈঠক করেন, আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। সবই রয়েছে সেই জাদুঘরে।

Latest article