কৃষ্ণকলি আর নেই। অধ্যাপক কৃষ্ণকলি বসু (Krishnakali Basu) ওয়েবকুপার (West Bengal College and Univesity Professor’s Association) প্রথম প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি (সভানেত্রী)। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজের (ব্যারাকপুর) ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা ছিলেন। মৃত্যুর সময় ৬৩ বছর বয়স হয়েছিল। প্রাক্তন কংগ্রেসি পরিবারের মেয়ে ছিলেন। ওঁর দাদা সুশোভন বসু আমার রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলেন। সুশোভন সুব্রত মুখার্জির অত্যন্ত বিশ্বস্ত সহকর্মী ছিলেন। কলকাতা পুরসভার পুরপিতা ছিলেন সুশোভন। সান্ধ্য খাবার খাওয়ার সময় অকস্মাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সুশোভনের অকালমৃত্যু হল। সেই রাত্রিটি আমাদের কাছে খুবই বেদনার ছিল। দক্ষিণ কলকাতার পদ্মপুকুরে কৃষ্ণকলিদের যৌথ পরিববার। কৃষ্ণকলিকে আমি ওঁর ১০/১১ বছর থেকে চিনতাম। সুব্রতর (মুখার্জি) সঙ্গে ওঁদের বাড়িতে মাঝেমধ্যে যেতাম। সুশোভনের সঙ্গে কথা হত। কৃষ্ণকলি খুব সাহসী ও ডনপিটে ছিল। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা করত, আবার মারামারিও করত! কখনও-কখনও মারপিটের মাত্রা এমন পর্যায় যেত যে দাদা সুশোভনের পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব ছিল না। তখন সুব্রত মুখার্জি হস্তক্ষেপ করে গোলমাল মেটাতেন। দু-একবার আমিও সুব্রতদার সঙ্গে গিয়ে পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করতাম। কৃষ্ণকলি বরাবরই মেধাবী ছাত্রী ছিল। যতদূর জানি, লেডি ব্রের্বোন কলেজ থেকে ইংরেজি অনার্সে খুব ভাল নম্বর পেয়ে স্নাতক হয়। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করে। কলেজ সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে ব্যারাকপুর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যাপনার চাকরি পায়। পুরোপুরি নিজের যোগ্যতায়। প্রথম থেকেই কৃষ্ণকলি অধ্যাপক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। বামফ্রন্ট তথা সিপিএম-বিরোধী প্রার্থী হিসাবে ওয়েবকুটার (WBCUTA) কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিল। বরাবরই কৃষ্ণকলি সাহসী ছিল। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে সিপিএমের সঙ্গে কৃষ্ণকলি টক্কর দিতে শুরু করল। ওয়েবকুটা ছিল সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন। অধ্যাপকদের দুটো সংগঠন রয়েছে— একটি সিপিএম-প্রভাবিত সংগঠন অপরটি সিপিএম-বিরোধী সংগঠন। শেষোক্ত সংগঠনটির নাম— নিখিলবঙ্গ রাজ্য সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিত (All Bengal State Government College Teacher’s Association)। ২০১১-তে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে স্বাভাবিক কারণে সংগঠনটি সংখ্যায় ও ভারে বেড়েছে। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে আমরা মুষ্টিমেয় কয়েকজন অনেক ঝুঁকি সত্ত্বেও এই সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ছিলাম।
সেই অন্ধকারময় বামফ্রন্টের চরম অত্যাচারের দিনগুলিতে ওয়েবকুটার যে কয়েকজন বামফ্রন্ট-বিরোধী নেতা আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন, কৃষ্ণকলি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এই তথ্য সম্ভবত অনেকের জানা নেই। যাঁরা জানতেন, কালের নিয়মে প্রায় সকলেই প্রয়াত।
তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে এই শতাব্দীর একদম প্রথম দিকে দলের শিক্ষাসেল প্রতিষ্ঠিত হল, যার নেতৃত্বে ছিল শ্রদ্ধেয়া সুপ্রিয়াদি (চট্টোপাধ্যায়) খুব পুরনো রাজনৈতিক নেত্রী। আমরা খুবই তাঁকে মানতাম। আজ তিনি নেই। হাজরা মোড়ের কাছে একটা ছোট ঘরে সুপ্রিয়াদি-সহ আমরা কয়েকজন বসতাম। স্কুলের শিক্ষকেরাই বেশি আসতেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে চিত্ত (মণ্ডল), বিনয় (চক্রবর্তী) আমি এবং মুষ্টিমেয় কয়েকজন।
আরও পড়ুন-বাংলায় এসআইআর, কমিশনকে তোপ দাগল তৃণমূল কংগ্রেস
২০১১ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিলেন, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের জন্য একটি নতুন সংগঠন তৈরি করতে হবে। কৃষ্ণকলিকে (Krishnakali Basu) যথাযথভাবে দায়িত্ব দেওয়া হল। ইতিমধ্যে সুপ্রিয়াদি ভালরকম অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। নতুন সংগঠনের নাম মুখ্যমন্ত্রী নিজেই ঠিক করলেন —West Bengal College and University Prefessors’ Association (ওয়েবকুপা)। তৃণমূল ভবনের আগের বাড়ির একতলার হলঘরে আমাদের বসবার স্থান নির্ধারিত হল। বৃহস্পতি ও শনিবার। বিকেল ৪টা থেকে ৬টা। উৎসাহের অন্ত ছিল না। বহুসংখ্যক অধ্যাপিকা-অধ্যাপক আসতেন। সংগঠন প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন জেলা থেকে আগত অধ্যাপক-প্রতিনিধিদের নিয়ে তৃণমূল ভবনে একটি সম্মেলন হয়েছিল। সেই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কত অধ্যাপক যে বৃহস্পতি ও শনিবার আসতেন, তার ইয়ত্তা ছিল না। সকলের নাম উল্লেখ করা সম্ভব নয়। নাম উল্লেখ করলে কিছু নাম বাদ পড়তে পারে। সেটা অবিচার করা হবে। এই বৈঠকগুলির মধ্যমণি ছিল কৃষ্ণকলি। ওয়েবকুপা তৈরির প্রথম দিকে কৃষ্ণকলিকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। জেলায় জেলায় ঘুরে ইউনিট (Unit) তৈরি করতে হয়েছিল। দু-একটি জায়গায় আমিও সঙ্গে ছিলাম। যেমন, ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়, বোলপুর ইত্যাদি। আরও কয়েকজন নিষ্ঠাবান সহকর্মী সঙ্গী হিসাবে ছিলেন। নাম উল্লেখের প্রাসঙ্গিকতা নেই। তবে একটা সমস্যার সৃষ্টি হল। ২০১১-এর পরে জলস্রোতের মতো শিক্ষকেরা ওয়েবকুপার দরজায় কড়া নাড়তে লাগলেন। কিন্তু এই জলস্রোত ঠেকিয়ে, ঝাড়াই-বাছাই করার মতে David Easton- এর Gate keeping system-এর কোনও ব্যবস্থা ছিল না। এখনও নেই। এই সমস্যা নিয়ে কৃষ্ণকলিকে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত দেখেছি। কিন্তু করার কিছু ছিল না। কৃষ্ণকলি নিজের মতো করে কিছু বিফল অথচ আন্তরিক চেষ্টা করেছিল। কৃষ্ণকলির নেতৃত্বে ওয়েবকুপার প্রথম প্রকাশ্য সম্মেলন সফলভাবে সংগঠিত হয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী হলে সেই বিশাল সম্মেলন হয়েছিল। তৃণমূল কংগ্রেসের প্রথম সারির প্রায় সব শীর্ষনেতা উপস্থিত ছিলেন। ওয়েবকুপার প্রসারে কৃষ্ণকলির অবদান কোনওভাবেই নগণ্য করে দেখা যেতে পারে না। ওয়েবকুপার নতুন কমিটিতে কৃষ্ণকলিকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ল। অসুস্থতা থেকে আর ফিরে এল না। কৃষ্ণকলি আর নেই। কিন্তু আছে তার স্মৃতি, তার কাজ।