সোমনাথ বিশ্বাস, হলদিয়া: রবিবার সকালে হলদিয়ায় চায়ের আড্ডা থেকে স্থানীয় যুবকদের কাছে বঞ্চনার কথা শুনে তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ (Kunal Ghosh) ছুটে গিয়েছিলেন ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে। বন্দর থেকে খানিকটা দূরে এই ওয়ার্ডের দুটি গ্রাম বিষ্ণুরামচক এবং সৌতনপুরে বিদ্যুতের খুঁটি ঢোকেনি। স্বাধীনতার এতবছর পরেও অন্ধকারে ডুবে গ্রামবাসীরা। দেখে অবাকই হলেন কুণাল। গ্রামে দাঁড়িয়েই কুণাল সংশ্লিষ্ট দফতরের শীর্ষ বিভাগের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেন। ব্যাস, ম্যাজিকের মতো কাজ। কয়েক ঘন্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে গ্রামবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। গ্রামে এসেও কথা বলে যান সংশ্লিষ্ট দফতরের দুই আধিকারিক। শুধু তাই নয়, ২৪ ঘন্টার মধ্যে গ্রামে ইন্সপেকশনও করা হবে বলেও জানান ওই দুই আধিকারিক। তাঁদের রিপোর্ট পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
অন্যদিকে, পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী আজ, রবিবার বেলার দিকে হলদিয়া পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড পরিদর্শনে যান কুণাল ঘোষ (Kunal Ghosh)। প্রায় ঘন্টা দুয়েক গোটা ওয়ার্ড ঘুরে ঘুরে মানুষের অভাব-অভিযোগ, সমস্যা, দুর্দশার কথা শোনেন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক। বিশেষ করে মহিলাদের কাছে তাঁদের অভাব-অভিযোগ জানতে চান কুণাল ঘোষ। এরপর ওয়ার্ডের মধ্যেই এক ব্যক্তির বাড়ির ছাদে স্থানীয়দের নিয়ে নন্দীগ্রামের মতোই চাটাই বৈঠক করেন তিনি। সেই বৈঠক থেকে আলোচনার মাধ্যমে খোঁজার চেষ্টা করেন সমাধান সূত্রও। উপস্থিত সকলকে সমস্যাগুলির দ্রুত সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শও দেন কুণাল।
এদিন ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দুর্গাচক এলাকায় যখন ঘুরছিলেন কুণাল, ঠিক তখনই একটি করুণ আবেদন আসে তাঁর কাছে। রাস্তার পাশে এক শিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক মহিলার কাতর আর্জি, জন্ম থেকেই তাঁর নাতির একটা চোখ নষ্ট। পাথরের চোখ বসানো। সেটাও বারবার পাল্টাতে হয়। খরচ ৮৪ হাজার টাকা। ছেলে জোগারের কাজ করেন। তাই বাচ্চাটির ভবিষ্যতের কথা ভেবে যদি কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
আরও পড়ুন: ভয়াবহ পথ দুর্ঘটনা কলকাতায়, লরির ধাক্কায় প্রাণ হারালেন পুলিশ কনস্টেবল
পাশের আরেকটি বাড়ির জোয়ান ছেলে অসুস্থ। বাড়িতে উপার্জনের লোক কম। কোথায় বললে চাকরি হবে, চিকিৎসা মিলবে কিনা জানে না। কেউ বলে দেয় না। দুয়ারে সরকারে স্বাস্থ্যসাথীর আবেদন করেও মিলছে না। ভোটের সময় নেতা-নেত্রীরা আসেন, গালভরা প্রতিশ্রুতি দেন। ভোট চলে গেলে আর দেখা মেলে না। তাঁদের জীবন যে তিমিরে, সেই তিমিরেই থাকে।
কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রৌঢ়া হাতজোড় করে কুণালকে বলেন, “বাবু ১০০ দিনের কাজ করে সংসার চালাই। তাও সবদিন কাজ মেলে না। ভাঙা বাড়ি। কোনওরকমে ত্রিপল দিয়ে জোড়াতাপ্পি মেরে চলছে। ছেঁড়া ঢাকতে প্লাস্টিক ভরসা। এই সমস্ত অভিযোগ ঘুরে দেখে নথিবদ্ধ করেন কুণাল। বলে দেন, ৪-৫ দিনের মধ্যে ফলোআপ করতে হবে। নির্দিষ্ট করে তার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থানীয় কয়েকজন যুবক ও ব্যক্তির উপর।
এরপর তাঁদের মধ্যেই এক ব্যক্তির বাড়ির ছাদে চাটাই পেতে স্থানীয় মানুষজন ও কিছু পার্টিকর্মীকে নিয়ে বৈঠক করেন কুণাল। সেখান থেকে প্রাথমিকভাবে সমাধান সূত্র বের করার চেষ্টা করেন।
কুণাল হলদিয়া পুরসভায় যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই বঞ্চনার লম্বা ইতিহাস শুনছেন। ভুরি ভুরি অভিযোগের ডালি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন মানুষ। উন্নয়নের রেশ মাত্র নেই। ভোটের আগে শুধুই প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়েছে। সেটা বাম জমানাতেই হোক বা শুভেন্দুর অধীনে থাকা তৃণমূল জমানায়।
সমস্যার কারণও খুঁজে পেয়েছেন কুণাল। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে যা উঠে এসেছে তাতে স্পষ্ট, আগে যে বা যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, যাঁর কথায় হলদিয়ায় নিয়ম নীতি তৈরি হত, সেই শুভেন্দু অধিকারী এবং তাঁর ঘনিষ্ঠরাই সমস্যার মূলে। শুধু নাগরিক পরিষেবা নয়, শিল্পতালুক হলদিয়ায় টাকার বিনিময়ে লোক ঢুকিয়ে ছিল শুভেন্দু ও তাঁর লোকজন।
চাটাই বৈঠকে কুণাল বলেন, “দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যা নির্দেশ দিয়েছেন, সেটাই ঘুরে ঘুরে করছি। মানুষ কাজ পাক, চিকিৎসা পাক, এলাকার মানুষরা মিলে দলটা করুক। সরকারের পরিষেবা পৌঁছাক।” সমস্যার কথা শোনার পর বলেন, “আমরা ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি মানুষের কাছে। শুভেন্দু অধিকারী যা করে গিয়েছেন তার ফল ভুগতে হচ্ছে। আপনাদের মতোই আমাদেরও অভিজ্ঞতা খুব খারাপ। সেখান থেকে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।”
তাঁর আরও সংযোজন, “আমি কো অর্ডিনেটর নই। স্থানীয়রা যাতে ঠিক মতো কাজ করতে পারেন, আর মমতাদির কাজ যাতে মানুষের কাছে পৌঁছয় ঠিক মতো সেটা দেখাই আমার কাজ।” হলদিয়ার নেতৃত্ব সম্পর্কে কুণালের বক্তব্য, “এলাকার মানুষ যাঁরা দলটা করেন, তাঁরা যদি নেতৃত্ব দেন সেটাই তো ভাল। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যা নির্দেশ দিচ্ছেন এলাকার নেতৃত্বকে নিয়ে আমি সেটাই করছি। সমস্যা শুনছি। মানুষকে কাজটা দলের স্থানীয়রা করে দিক। আর দলটা করুক মানুষ।”