দক্ষ জনশক্তির অভাব ও ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব

কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক প্রচারে বিশ্বের দ্রুততম ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি হিসেবে ভারতকে তুলে ধরা হলেও কর্মসংস্থানের বাস্তব চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

Must read

নয়াদিল্লি : কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক প্রচারে বিশ্বের দ্রুততম ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি হিসেবে ভারতকে তুলে ধরা হলেও কর্মসংস্থানের বাস্তব চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিক রিসার্চ (এনসিএইআর) তাদের ডিসেম্বর ২০২৫-এর প্রতিবেদনে এক চূড়ান্ত সতর্কবার্তা দিয়েছে। ‘ইন্ডিয়াজ এমপ্লয়মেন্ট প্রসপেক্টস : পাথওয়েজ টু জবস’ শীর্ষক এই রিপোর্টে স্পষ্ট জানানো হয়েছে যে, ভারত তার ক্রমবর্ধমান কর্মক্ষম জনসংখ্যার জন্য, বিশেষত যুবক ও নারীদের জন্য পর্যাপ্ত স্থিতিশীল এবং উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

আরও পড়ুন-কামিন্স-লিয়নের দাপটে অ্যাসেজ জয়ের হাতছানি

১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের এই প্রাচীনতম এবং অত্যন্ত প্রশংসিত অর্থনৈতিক নীতি গবেষণা সংস্থার মতে, আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে এই সংকট নিরসন না হলে ভারত তার ‘জনতাত্ত্বিক লভ্যাংশ’ হারানোর মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেখানে যুবশক্তিকে উন্নত ভারতের মূল অংশীদার এবং শক্তি হিসেবে বর্ণনা করছেন, এনসিএইআর-এর পরিসংখ্যানে সেই রাজনৈতিক বয়ান ও বাস্তবতার মধ্যে এক বিশাল ব্যবধান ফুটে উঠেছে। গত সাত বছরে ভারতের কর্মক্ষম জনসংখ্যায় ৯০ মিলিয়ন মানুষ যুক্ত হলেও কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে মাত্র ৬০ মিলিয়ন। অর্থাৎ প্রতি বছর প্রায় ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লক্ষ কর্মসংস্থানের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার ৫০ শতাংশে স্থবির হয়ে আছে এবং তরুণীদের অংশগ্রহণের হার বিশ্বমানের তুলনায় অত্যন্ত নিম্নমুখী।

আরও পড়ুন-জেলা পুলিশের উদ্যোগে শিক্ষক পদপ্রার্থীদের মক ইন্টারভিউ

অর্থনীতিবিদ সন্তোষ মেহরোত্রার ভাষায়, ভারত তার নিজের জনতাত্ত্বিক কাঠামোর সঙ্গেই এক অসম দৌড়ে লিপ্ত— যেখানে উচ্চ প্রবৃদ্ধি থাকলেও কর্মসংস্থান নেই, যা আসলে কোনো প্রগতি নিশ্চিত করছে না। বর্তমান রিপোর্টটিতে কাঠামোগত অসংগতির ওপর আলোকপাত করে বলা হয়েছে যে, ম্যানুফ্যাকচারিং এবং পরিষেবা ক্ষেত্র ক্রমশ পুঁজি-নিবিড় হয়ে উঠছে। শিল্প সংস্থাগুলি শ্রমিকের পরিবর্তে মেশিন এবং অটোমেশনের ওপর বেশি বিনিয়োগ করছে। এমনকি পোশাক বা বস্ত্রশিল্পের মতো শ্রম-নিবিড় ক্ষেত্রগুলিও এখন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকেছে। অন্যদিকে, কৃষি খাত এখনও ৪৫ শতাংশ শ্রমশক্তিকে আঁকড়ে ধরে আছে, যদিও মোট স্থূলমূল্য সংযোজন (জিভিএ)-এর অবদান মাত্র ১৫ শতাংশ। প্রাক্তন প্রধান পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেনের মতে, ভারত পর্যাপ্ত শিল্পায়ন না করেই সরাসরি পরিষেবা ক্ষেত্রে ঝাঁপ দিয়েছে, যার ফলে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের ভিত্তিটি অত্যন্ত দুর্বল রয়ে গেছে। একে তিনি ‘অকাল বি-শিল্পায়ন’ বলে অভিহিত করেছেন। সরবরাহের দিক থেকেও চিত্রটি হতাশাজনক। ভারতের শ্রমশক্তির মাত্র ৪ শতাংশ আনুষ্ঠানিক বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ পেয়েছে। আন্তর্জাতিক তুলনায় এই হার অত্যন্ত নগণ্য। দক্ষতা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ অনিতা রাজনের মতে, ভারতের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল এবং শিল্পের চাহিদার সঙ্গে এর কোনও সংযোগ নেই। ফলে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও তাদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের উপযোগী করে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলস্বরূপ, গত তিন দশকে উন্নতির দাবি সত্ত্বেও ভারত উৎপাদনশীলতার নিরিখে চিন বা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ২০৪০-এর পর জনতাত্ত্বিক জানলা বন্ধ হতে শুরু করবে, তাই নীতিনির্ধারকদের হাতে এই সংশোধন করার সময় অত্যন্ত সীমিত।

Latest article