যে কোনও রাজ্য বা দেশের অর্থনীতি সফল কিনা তা নির্ভর করে বেশ কিছু পরিকাঠামোর সাফল্যের উপর। তার মধ্যে যেমন রয়েছে কৃষিক্ষেত্র তেমনি রয়েছে শিল্পক্ষেত্রও। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিষেবাক্ষেত্রকেও সমানভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে তার কারণ অবশ্যই জনতা জনার্দন। আজ বলব আমাদের প্রিয় বাংলার কথা, তার শিল্পের কথা, তার সমৃদ্ধির কথা। পশ্চিমবঙ্গ রাজনৈতিক হোক বা অর্থনৈতিক সবসময়ই যেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু-তে থাকা এক জনপ্রিয় রাজ্য।
দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম জমানার কাঁটাতার উপড়ে ফেলে এমন এক সরকার এখন জনগণের পরিষেবায় মগ্ন, যা দেখে দূর-দূরান্তের দেশের মানুষও ছুটে এসেছেন কখনও তার অভূতপূর্ব সাড়া ফেলা প্রকল্পের নিদর্শন দেখতে, কখনও ছুটে এসেছেন সংস্কৃতির বহর দেখতে। জরাজীর্ণ পশ্চিমবঙ্গ যেন আজ এক মুক্ত বায়ু-তে বিরাজমান। রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি, নজরুলের স্বাভিমান, বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য, বিবেকানন্দের নতুন ভারতের মেলবন্ধন— যেন এক টুকরো পশ্চিমবঙ্গের আজ জলছবি। তবে এই জলছবির আসল তথ্য লুকিয়ে আছে তার পরিসংখ্যানে।
আরও পড়ুন-আই লিগ নিয়ে আজ জরুরি সভা
সাম্প্রতিক বাজেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে মা-মাটি-মানুষের সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন GSDP (এটি হল শিল্প দ্বারা সংযোজিত সমস্ত মূল্যের সমষ্টি এবং এটি জাতীয় উৎপাদনের প্রতিরূপ হিসেবে কাজ করে) ছিল ৪,৬০,৯৫৯ কোটি টাকা যা ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৭,০০,৯৩৯ কোটি টাকায়। ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে GSDP-র পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১৮ লক্ষ কোটি টাকা। এর সাথে GSVA অর্থাৎ গ্রস স্টেট ভ্যালু আ্যডেড (যা রাজ্যের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি সূচক হিসাবে কাজ করে)-এর কথা না বললেই নয়, ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে GSVA বৃদ্ধির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৭.২৬ শতাংশ সেখানে জাতীয় গড় ছিল ৬.৫৩ শতাংশ।
২০২৪-২৫-এ GSVA প্রথম অ্যাডভান্স এস্টিমেটে ৬.৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে যা জাতীয় গড়ের ৬.৩৭ শতাংশ থেকে অনেকটাই এগিয়ে। সরকারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে ইঙ্গিত তা আরও কিছু প্যারামিটারের উপর নির্ভর করে। তার মধ্যে একটি প্যারামিটার হল বেকারত্বের হার। সিএমআইই (CMIE)-এর দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষের তৃতীয় কোয়ার্টারে জাতীয় বেকারত্বের হার যেখানে ৯.০৫ শতাংশ ছিল সেখানে রাজ্যের বেকারত্বের হার তার থেকে ৩ শতাংশ কম ছিল। বেকারত্ব হ্রাসের এই ধারা ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষেও বহাল ছিল।
২০২৫-এর জানুয়ারি মাসে জাতীয় বেকারত্বের হার যেখানে ৭.৯৩ শতাংশ ছিল, পশ্চিমবঙ্গের বেকারত্বের হার ছিল ৪.১৪ শতাংশ। রাজ্যের শিল্প ও অন্যান্য ক্ষেত্র মিলিয়ে প্রায় দু কোটি মানুষের জীবিকার সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে রাজ্যে ৪০ শতাংশ বেকারত্ব হ্রাস পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাজেটের প্রাপ্ত তথ্য থেকে আরও জানা গেছে ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে কৃষি ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে যেখানে রাজ্যের বৃদ্ধির হার ছিল ৪.২ শতাংশ সেখানে জাতীয় বৃদ্ধির হার ছিল ৩.৮ শতাংশ। পরিষেবা ক্ষেত্রে রাজ্যের বৃদ্ধির হার যেখানে ৭.৮ শতাংশ, জাতীয় ক্ষেত্রে তা ৭.২ শতাংশ।
আরও পড়ুন-সুন্দরবনের কোজাগরী উৎসবের সূচনায় কীর্তি আজাদ
এই সমস্ত পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির পুনর্জাগরণের কাহিনি। পরিষেবা ক্ষেত্রের সাথে লজিস্টিকের একটি ওতোপ্রোতো সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। সেই সম্পর্ক মজবুত করতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার উন্নত চিন্তাভাবনার নিদর্শনও রেখেছে। লজিস্টিককে যে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় তা পশ্চিমবঙ্গ সরকার দৃঢ়তার সাথে প্রমাণ করেও দেখিয়েছে। ক্রমবর্ধমান লজিস্টিক সেক্টর উন্নয়নের স্বার্থে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল লজিস্টিক সেক্টর ডেভেলপমেন্ট পলিসি ২০২৩’ ঘোষিত হয়েছে। রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধার্থে আন্তঃরাজ্য করিডর স্থাপন লজিস্টিকের যে আরও উন্নয়ন করবে এবং লগ্নিকারীদেরও যে আকৃষ্ট করবে সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
শুধু শিল্প বা বিনিয়োগকারীদের জন্য ভাবনা নয়, প্রান্তিক মানুষের কথাও সর্বদা ভেবে চলেছে এই সরকার। প্রান্তিক মানুষের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল মনরেগা (MGNEGA) প্রকল্প। তার পুরস্কারস্বরূপ প্রাপ্তির খাতা শূন্য। কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের প্রান্তিক জনগণকে বঞ্চিত করে তাদের ন্যায্য পাওনা বন্ধ করেও মা-মাটি-মানুষের সরকারকে তার অঙ্গীকার থেকে সরিয়ে আনতে পারেনি। ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে যেখানে ৪৩ লক্ষ জব কার্ড হোল্ডারদের জন্য ১১ কোটি কর্ম দিবস সৃষ্টি করা হয়েছিল ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে ৬৪ লক্ষ জব কার্ড হোল্ডারদের জন্য ২৮ কোটি কর্মদিবস সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে থেমে না থেকে রাজ্য সরকারের নিজস্ব কর্মশ্রী প্রকল্পের উপর ভর করে ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে ৬১ কোটি কর্মদিবস সৃষ্টি করে নজির স্থাপন করেছে। এই খাতে এখনও পর্যন্ত ১২৩৫৫ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-ইন্দো-ভুটান রিভার কমিশন আজও হল না, কেন্দ্রের উদাসীনতাতেই উত্তরে দুর্যোগ : ঋতব্রত
পশ্চিমবঙ্গের কৃষি-ভিত্তিক শিল্প (যেমন খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ), ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং বস্ত্র শিল্প উল্লেখযোগ্যভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে শুধু নয়, কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে। শিল্প পরিকাঠামো যেমন মেগা ফুড পার্ক, কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনা এবং নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে শিল্প সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এত বছর বড় শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ ছিল রাজ্য সরকারের কাছে চ্যালেঞ্জ, কিন্তু সেই সমস্যারও সমাধান হয়েছে শুধু নয়, সাধারণ মানুষের চাহিদামতো প্রাপ্তি শিল্পের দিগন্তে নতুন হাওয়া বইছে। দেউচা-পাঁচামি প্রকল্প তার অন্যতম নিদর্শন। দেউচা-পাঁচামি কোলিয়ারির বিস্তীর্ণ এলাকায় যাঁরা বসবাস করতেন তাঁদেরকে ক্ষতিপূরণের সাথে চাকরির সংস্থান করে উন্নয়নের পথে শামিল করা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক অনবদ্য প্রচেষ্টা। তবে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের সম্পর্ক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্তির খাতা যেন বোঝাই হয়ে পড়েছে। সেই খাতার ভারে উন্নয়ন কিন্তু স্তব্ধ হয়নি বরং নতুন নতুন রাস্তা বের হয়েছে। পরিশেষে বলা যায়, কৃষি-শিল্পের মেলবন্ধনে পশ্চিমবঙ্গ কীভাবে পিছিয়ে থাকে! বাংলার বাণিজ্যের সিংহাসনে লক্ষ্মীর তো বসত হতেই হত।