সাত-আট বছর বয়স থেকেই মেয়েটির মনে হাজার প্রশ্ন। এ পৃথিবী কার তৈরি, কে সৃষ্টি করেছেন পূর্ণিমার রাত? শিব কি ঈশ্বর? তাঁকে পেতে গেলে কী করতে হবে? বাড়িতে গুরুদেব এলে এই সব জিজ্ঞেস করত মেয়েটি। গুরু নিজের মতো করে কিছু উত্তর দিতেন, কিছু প্রশ্নে নীরব থাকতেন।
কিন্তু মেয়েটি দমে না গিয়ে নিজের মতো করে সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করত। কারণ একই সঙ্গে আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা ও সামাজিক ভেদাভেদ তাকে অস্থির করে তুলছিল সেই কৈশোরের দিনগুলোতেই। মেয়েটির নাম ললিতা। শ্রীনগর শহর থেকে এগারো কিলোমিটার দক্ষিণে সেঁপুর নামে এক গ্রামে আনুমানিক ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৩১৭ থেকে ১৩২০-এর মধ্যে) জন্ম ললিতার। বাবা চন্দ্র ভাট সম্ভ্রান্ত কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ। বাড়িতে বিদ্যাচর্চার উপযুক্ত পরিবেশ। নিয়মিত ধর্মগ্রন্থ পাঠ হয় বাড়িতে। এমন পরিবেশেই বেড়ে উঠল ললিতা।
আরও পড়ুন-সাত শিখরের রানি
এই ললিতাই পরবর্তীকালে নামের বিবর্তনে হয়ে উঠলেন লাল্লা বা লালেশ্বরী। প্রথম কাশ্মীরি ভাষায় লিখিত কবিতার রচনাকারী। যদিও পড়াশোনা শিখেছেন সংস্কৃত ভাষায়, কিন্তু কাব্যসাধনার সময় বেছে নিলেন কাশ্মীরের কথ্য ভাষাকেই, যা সহজেই স্পর্শ করল আপামর কাশ্মীরিকে। হিন্দু মুসলিম দুই সম্প্রদায়ই সাদরে গ্রহণ করলেন এই শৈব সাধিকাকে।
লাল্লি লিখলেন— “আমার নেই পারানির কড়ি।
পথের ধারে এসেছি,
(আমি) ফিরব না তো আর।
বাঁধের ধারে সন্ধ্যা হয়ে এল,
আমার একটিও নাই কড়ি।
ও নেয়ে, কী দেব তোমায়?
আমার একটিও নাই কড়ি”
আরো লিখলেন—
“দেখেছি নদীর অবিরাম স্রোতোধারা,
দেখিনি তো সাঁকো, ওপারে যাবার তরী।
এখন দেখেছি বিকশিত শিশুতরু,
দেখা দেয়নি কাঁটা বা কুসুম শোভা।”
আরও পড়ুন-বল বীর…
লালেশ্বরীর কবিতা পড়লে বোঝা যায় সব কবিতাই দুটি মানে বহন করছে। এই পারানি একদিকে মাঝি আবার অন্য দিকে ঈশ্বর। তিনি অধ্যাত্মবাদে পূর্ণ কিন্তু তাঁকে সক্রেটিসের মতো দার্শনিক বলা যায় না। তিনি নতুন কোনও মতবাদ তৈরি করেননি, বা কোনও দর্শন— যেমন শাক্ত, বৌদ্ধ, ক্রিক ধর্মের মতো কোনও ধর্ম প্রবর্তনের চেষ্টাও করেননি। বরং নানক, চৈতন্য, কবীর, রামকৃষ্ণের মতো সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথাই বারবার উঠে এসেছে তাঁর লেখায়, তাঁর বাক্–এ। বৌদ্ধদের মতো তিনি পরম সত্তাকে শূন্য বলছেন, আবার সর্বক্ষণ শিবমন্ত্র জপ করছেন। তাঁর যোগসাধনার পদ্ধতি কী ছিল জানা যায় না। তবে তাঁর ঈশ্বর-উপলব্ধি ঘটেছিল। তিনি বারবার বলেছেন— শিবের উপস্থিতি অন্তরের মধ্যে। আমাদের অন্তরেই অভিনিবিষ্ট হওয়া উচিত। তার জন্য বনবাসের দরকার নেই। গৃহে থেকেই সাধনা হতে পারে। আত্মার শুদ্ধি এবং চৈতন্য— এই দুটোই ক্রমশ শিবত্ব অনুভূতির দিকে নিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন-শুরু হল বিধানসভার বাদল অধিবেশন, নজিরবিহীনভাবে শোকপ্রস্তাব পর্বেও থাকল না বিজেপি
লালের বিয়ে হয় মাত্র এগারো বছর বয়সে। সেঁপুর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে পাঁপুড় গ্রামে ধনী পরিবার জাফরানের ব্যবসায়ী শিব ভাটের ছেলে সোম ভাটের সঙ্গে। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি সুখের হয়নি তাঁর। শাশুড়ি দিন-রাত মানসিক নির্যাতন করতেন। তাঁর দেখাদেখি স্বামীও। তাঁর ভিতরের ঐশ্বর্য, ঈশ্বর প্রেম বা কাব্যপ্রতিভা তাঁরা এতটুকুও উপলব্ধি না করে যেনতেন প্রকারে অত্যাচার করতেন। ভাতের থালায় ভাতের নিচে একটা বড় পাথর রেখে তার ওপর ভাত দিয়ে বলতেন— বউমানুষ এত ভাত খায়! শুধু তাই নয় জল আনতে নদীতে গিয়ে তিনি জয়েশ্বর এবং বিষ্ণুপদ্মস্বামী মন্দিরে বসে স্তোত্রপাঠ ও জপ করে দেরিতে ফিরলে তাঁর চরিত্র নিয়েও অভিযোগ তোলেন শাশুড়ি। কথিত আছে, একদিন কলসি মাথায় জল নিয়ে বাড়ি ফিরলে লাঠি দিয়ে সেই কলসি ভেঙে দেন তাঁর স্বামী। কিন্তু কলসির আকৃতিতে জল জমাট ও স্থির থাকে তাঁর মাথায়। লাল শিবনাম জপ করতে করতে ঘরে ঢুকে সেই জমাট বাঁধা জল দিয়ে বাড়ির সব পাত্র পূর্ণ করেন। বাড়তি জল বাড়ির বাইরে ফেলে দিলে সেখানে ছোট্ট ডোবা তৈরি হয়। এই ঘটনায় শাশুড়ি এবং সোম ভয় পেয়ে যান। আর ললিতা ইতি টানেন সংসারে।
আরও পড়ুন-বিধানসভায় দলের বিধায়কদের ১০০ শতাংশ উপস্থিতিতে জোর তৃণমূল পরিষদীয় দলের বৈঠকে
মেতে ওঠেন একান্তে শিবসাধনায়। একেশ্বর শিবজ্ঞান। বুদ্ধের মতো জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি চান তিনি। তাঁর মুখ দিয়ে বেরোয় সহজ সরল কাশ্মীরি ভাষায় বলা, লেখা ছোট-ছোট কবিতা, যিনি শোনেন তিনিই মুগ্ধ হয়ে যান। ক্রমে লালের পূর্ণ শরণাগতি অনুভূতি হয়। গুরু সিদ্ধ শ্রীকণ্ঠ অনুভব করেন ভক্তের এই পাগলের মতো সাধনা। তিনি ভক্তকে ঈশ্বরসামীপ্য সাধনার মন্ত্র দান করলেন। লাল্লা ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে উঠলেন এরপর। অশনে বসনে আচার আচরণে সব সংস্কার মুক্ত হলেন। বললেন— “ধীরে ধীরে কাঁদো আমার মনরে।
ওরে, মায়ায় ঘিরেছে তোরে,
এ জগতের কোনও কিছুই রইবে না
তোর পাশেরে
নিজের মনকে, ওরে মন
ভুললি কেমন করে?”
লালেশ্বরীর বাক্যগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, মানবসমাজের ভালর জন্য উচ্চারিত। অজ্ঞানতায় যেন জীবন না কাটে সেইদিকেই তাঁর আহ্বান। তিনি বলেন যোগসাধনা এক-দু দিনের নয়, তা জীবনব্যাপী পালন করতে হয়। এর জন্য কৃচ্ছ্রতার দরকার নেই। মধ্যপন্থা নিলেই হবে। খাদ্য, পোশাক সব পরিস্থিতি ও পরিবেশ অনুযায়ী গ্রহণ করলেই হবে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বহু বিধানের তীব্র বিরোধিতা করেছেন তিনি। দেবতাদের সামনে পশুবলি তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তন্ত্রসাধনার মদ-মাংস সহযোগে বামাচারী প্রক্রিয়া, শবসাধনা এসবেও তাঁর আপত্তি ছিল। তিনি মনে করতেন এগুলো ধর্মের নামে বিকৃতীকরণ। তিনি লিখলেন—
“যখন দিন-রাত্রি তোমায় খুঁজে ফিরি,
তুমি খেলার ছলে লুকিয়ে শুধু থাকো।
যখন তোমায় মনের মাঝে খুঁজি
তখন তোমার আমার
মিলন মহোৎসব।”
আরও পড়ুন-পার্ক সার্কাস: মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন আত্মঘাতী কনস্টেবল, জানালেন পুলিশ কমিশনারের
এত বছর আগে লালেশ্বরী কাশ্মীরি ভাষায় কাব্যসাধনা করলেও এবং এত বছর ধরে সাধক হিসাবে পূজিত হলেও মাত্র দুশো বছর আগে সাধক পণ্ডিত রাজানন্দ ভাস্কর আচার্য লালেশ্বরীর কাশ্মীরি ভাষায় রচিত ষাটটি শ্লোক সংগ্রহ করে সংস্কৃতে অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। আর ১৯২০ সালে মানে ১০২ বছর আগে স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন এবং লায়োনেভ ডি বার্নেট স্থানীয় পণ্ডিতদের সাহায্যে ১০৯টি শ্লোক উদ্ধার করে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন “Wise saying of Lalla Ded” নামে। এরপর হিন্দি, উর্দু ও ইংরেজিতে লালেশ্বরের বাক্ নিয়ে একাধিক কাজ শুরু হয়।
আনুমানিক ১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু লালেশ্বরের। এত বছর পরে তাঁকে বিশ্বসাহিত্যের পাঠক নতুন ভাবে চিনছেন, আবিষ্কার করছেন তাঁর যোগসাধনার সঙ্গে সম্পৃত্ত বাককে, সাতশোরও বেশি বছর আগে তিনিই প্রথম মহিলা কবি ও সাধিকা যিনি বলেছিলেন— যত্র জীব তত্র শিব। এ যেন আমাদের স্বামীজি বিবেকানন্দের বাণী— জীবে প্রেম করে যেই জন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।
অনুবাদ-ঋণ : প্রভাত গোস্বামী
তথ্য-ঋণ : lal Ded-Her life and sayings : Nilkanta Kotru, কাশ্মীরের দুই কন্যা : প্রভাত গোস্বামী