শেষকৃত্য

উকিলবাবুকে হন্তদন্ত হয়ে দাশুর চায়ের দোকানে আসতে দেখে বেশ অবাক হল সবাই। এমনিতেই মে মাসের মাঝামাঝির দাবদাহে ভরপুর চারধার

Must read

পার্থসারথি গুহ
উকিলবাবুকে হন্তদন্ত হয়ে দাশুর চায়ের দোকানে আসতে দেখে বেশ অবাক হল সবাই। এমনিতেই মে মাসের মাঝামাঝির দাবদাহে ভরপুর চারধার। তার ওপর অ্যাসবেসটাসের ছাউনি-আচ্ছাদিত দাশুর দোকানকে এখন তপ্ত আগ্নেয়গিরি বললেও কম হবে।
কিন্তু, মানুষের যখন দরকার হয় তখন বোধহয় বীভৎস গরম বা হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডার পরোয়া করে না। বর্ষীয়ান আইনজীবী মৃদুল দত্তর অবস্থাও হয়েছে ঠিক সেরকম।

আরও পড়ুন-ফিরে এসো চড়ুই

তার ওপর যাকে এতদিন আঁতিপাঁতি করে খুঁজছিলেন তাকে এভাবে দাশুর দোকানে দেখে হাতে যেন চাঁদ পেলেন। এই অসময়ে উকিলবাবুকে দাশুর দোকানে দেখে অবাক হয়েছে কালিদাস চক্রবর্তীও।
এই অঞ্চলের এক এবং অদ্বিতীয়ম পুরোহিত কালিদাস। বেশ কয়েক পুরুষ ধরে পুজোআচ্ছা করে আসছে চক্রবর্তীরা।
কালিদাস চক্রবর্তীর যজমানও প্রচুর। এমনকী দূরদূরান্তরেও যেতে হয় বিয়ে বা শ্রাদ্ধাদির কাজে। ওঁর শুদ্ধ সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ শোনার সমঝদার আজও বেশ ভালরকমই।
তা বলে উকিলবাবুর আবার কী হল! এই অবেলায় দাশুর দোকানে কেন?

আরও পড়ুন-বিপ্লবী জীবনের অজানা কথা
*
কালিদাস সকাল থেকে কয়েকটা নিত্যপুজো সেরে বাড়ি ফেরার তালেই ছিলেন। এসময় হঠাৎ দাশু ডেকে বসল।
‘ও ঠাকুরমশাই, ও ঠাকুরমশাই…’
‘কী ব্যাপার দাশু— জরুরি তলব যে বড়?’ স্মিত হেসে বললেন কালিদাস।
‘আর বলবেন না। উকিলসাহেব দুদিন ধরে হন্যে হয়ে আপনাকে খুঁজছেন।’
এ পাড়ায় উকিল বলতে তো একজনই।
মুহূর্তের মধ্যে মৃদুল দত্তের লম্বা-চওড়া চেহারাটা ভেসে উঠল। এককালে যে যথেষ্ট ওজনদার মানুষ ছিলেন তা বেশ বোঝা যায়। তবে বয়সের ভারে অনেকটাই ন্যুব্জ হয়ে গিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে ওকালতি থেকেও স্বেচ্ছাবসর নিয়েছেন।
পাড়াতে খুব বেশিদিন আসেননি। নিঃসন্তান। তার ওপর কারও সঙ্গে সেভাবে মেলামেশাও করেন না ওঁরা স্বামী-স্ত্রী। একজন ড্রাইভার কাম ম্যানেজার গোছের লোক আছে। সেই নাকি বাজার সরকার। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব করে।

আরও পড়ুন-প্রসঙ্গ : চিরঞ্জিত
*
‘পুরোহিত মশাই নমস্কার।’ একেবারে তাঁর সামনে এসে সম্ভাষণ করেছেন মৃদুল দত্ত।
‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। উকিলবাবু নমস্কার। তা দাশু বলল, আপনি নাকি দুদিন ধরে খুঁজছেন আমাকে…’
‘হ্যাঁ। ঠিকই শুনেছেন। এ পাড়ায় আসার পর থেকেই তো আপনার নামডাক শুনে আসছি। খুবই সমস্যায় পড়ে আজ আপনার শরণাপন্ন হয়েছি।’ উকিলবাবুর গলায় আর্তির ছাপ স্পষ্ট।
কালিদাস মনে মনে ভাবছিলেন এত প্রতাপশালী দুঁদে উকিলের হঠাৎ তাঁর সঙ্গে কী দরকার পড়ল। পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা শুনেছেন। কিন্তু উকিল ছুঁলে আবার কত ঘা কে জানে! এতদিন ধরে রাজ্যের যজমান ঘেঁটে চলেছেন। তা বলে উকিলের পাল্লায় তো পড়েননি।
মিনমিন করে কালিদাস বলেই ফেললেন, ‘তা আমার মতো ছাপোষা পুরুতের সঙ্গে আপনার মতো মান্যিগণ্যি মানুষের কী দরকার… ঠিক বুঝলাম না স্যার’
‘এভাবে বলবেন না প্লিজ। সমাজে জজ-উকিলের যেমন গুরুত্ব আছে, তেমনই আপনাদের মতো পুরোহিতদেরও চাহিদা কম নাকি? তা ছাড়া এই বয়সকালে কেই বা পোঁছে আমাদের!’

আরও পড়ুন-গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূল কংগ্রেসের জয় নিশ্চিত

দাশু ততক্ষণে দোকানের বেঞ্চিটা বের করে সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়াঘেরা জায়গায় পেতেও দিয়েছে। হাসিমুখে বলেছে, ‘আপনারা এত জ্ঞানীগুণী মানুষ। এভাবে দাঁড়িয়ে কথা বললে চলে। একটু না হয় বসেই…’
‘সমস্যাটা খুবই জটিল। বাড়িতে কথা বললেই বোধহয় ভাল হত। সেখানে আবার গিন্নি শুনলে উতলা হবে। তাই এই অবেলায় দাশুবাবুর দোকানে চলে এসেছি। উনি বলছিলেন, ঠাকুরমশাই বেলাবেলি নাগাদ পুজোআচ্ছা সেরে একবার ঠিক আসেন…’ বেঞ্চিতে গুছিয়ে বসে উকিলবাবু ফের শুরু করেছেন।
‘ঠিকই বলেছে ও। দুপুর বা সন্ধে যতটুকু সময় পাই একবার এই দাশুর কফি হাউসে হাজিরা দিয়ে যাই।’ কালিদাস দাঁড়িয়েই উত্তর দেন। ফতুয়ার পকেট থেকে রুমাল বের করে একবার ঘামটা মুছে নেন।

আরও পড়ুন-গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূল কংগ্রেসের জয় নিশ্চিত

মধ্যাহ্নের গনগনে রোদ যেন সব কিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিতে চাইছে। তার সঙ্গে উপরি পাওনা হল হল্কার মতো তাপপ্রবাহ। যদিও দাশুর দোকানের সামনেটায় সরাসরি রোদ লাগছে না। কৃষ্ণচূড়া গাছটি নিজে রোদে পুড়েও ওদের ছায়া দিচ্ছে।
‘আসলে সেই কোন সকালে পুজোয় বেরিয়েছি। এখন ঘরে গিয়ে এই পুরুতের ধরাচূড়া ছাড়তে না পারলে শান্তি পাব না।’ ভদ্রভাবেই বাড়ি ফেরার কথা মনে করিয়ে দেন কালিদাস।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ ঠাকুরমশাই। আর আপনাকে আটকাব না। আসলে আপনি হয়তো জানেন না আমি নিঃসন্তান। এতদিন কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু, বয়সকালে এসে বুঝতে পারছি সন্তান না থাকার যন্ত্রণা…’
‘সন্তান থাকলেই যে আপনার বাধ্য হত তা কিন্তু নয়। এখন যা ঘটছে চারদিকে। কাগজ খুললেই তো দেখা যায় বৃদ্ধ বাপ-মাকে সন্তানের খেদিয়ে দেওয়ার গল্প।’

আরও পড়ুন-আজ ভার্চুয়াল বৈঠকে নেত্রী

‘এটা আপনি একশোভাগ সত্যি কথা বলেছেন। তা-ও সন্তান না থাকার জন্য যদি আমাদের ঠিকমতো সৎকার না হয়… সেই চিন্তাতেই পাগল হয়ে যাচ্ছি।’
এতক্ষণে উকিলবাবুর সমস্যার কথা বুঝতে পারলেন কালিদাস। রাজ্যের যজমান চরিয়ে খায়। মানুষ ‘হাঁ’ করলে তার মনের কথা টের পেয়ে যান। কিন্তু মৃদুলবাবুর মনের অতলে এতক্ষণ কিছুতেই ঢুকতে পারছিল না। উকিল-ব্যারিস্টারের মন বলে কথা! আইনি প্যাঁচের মতোই জটিল। সমস্যার কথা বুঝলেও এর সঙ্গে তার কী সম্পর্ক সেটা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না কালিদাসের।
দীর্ঘ কথোপকথনে ততক্ষণে উকিলের খোলস ছেড়ে মৃদুলবাবু হয়ে উঠেছেন তিনি। কালিদাসকে বলেছেন, উকিলবাবু না বলে মৃদুলবাবু ডাকলেই ভাল লাগবে।

আরও পড়ুন-সমর্থকদের ট্রফি উৎসর্গ দিমিত্রিদের, গোয়েঙ্কার উপহার, সরে গেল এটিকে

উকিলবাবু এবং মৃদুলবাবুর মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে কালিদাস তাঁর এই গুরুতর সমস্যার সঙ্গে নিজের যোগ খুঁজে পেয়েছে। মানে মৃদুলবাবুই তা খোলসা করেছেন।
রীতিমতো কাতরভাবে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আচ্ছা ঠাকুরমশাই মারা যাওয়ার পর আমার মুখাগ্নি ঠিকমতো হবে তো? আদৌ সৎকার হবে তো! নাকি ঘাটের মড়ার মতো…’
‘ছি ছি। কীসব ভাবছেন বলুন তো? আপনি একজন স্বনামধন্য আইনজীবী। আপনার কিনা সৎকার করার লোকের অভাব হবে। ছেলেমেয়ে না থাকলেও আত্মীয়স্বজন তো আছে নাকি?’
‘আর আত্মীয়স্বজন। তাদের কথা আর নাই বা শুনলেন। তারা তক্কে তক্কে ছিল কবে বুড়ো-বুড়ি মরবে। সেজন্যই তো শহরের পুরো উল্টো প্রান্ত থেকে বাড়ি বিক্রি করে আপনাদের এই দিকে চলে এসেছি। যদিও তাতে ওই চিল-শকুনদের নজরদারি পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।’ তীব্র গরমেও মৃদুলবাবুর ঠাণ্ডামারা আকুতি শোনা যায়।

আরও পড়ুন-সমর্থকদের ট্রফি উৎসর্গ দিমিত্রিদের, গোয়েঙ্কার উপহার, সরে গেল এটিকে

‘তাহলে কাউকে দত্তক নিয়েই না হয় সৎকারের বৈধ ব্যবস্থা করে রাখুন। আপনি তো আইনের জগতের মানুষ।’ মৃদুলবাবুর সমস্যার জট ছাড়াতে ব্যস্ত হন কালিদাস।
‘এতদিন এই জগতে থেকে বেশ বুঝেছি আইনটাই শেষ কথা নয়, অনেক ঊর্ধ্বে আন্তরিকতা। প্রশ্ন হল সেই আন্তরিকতা নিয়ে আমাকে দাহ করবে কে? দায়সারা ভাবেই হয়তো… তাহলে তো ওপরে গিয়েও শান্তি পাব না। আমার বিদেহী আত্মা পাগলের মতো ঘুরে বেড়াবে। আপনি একটা উপায় বাতলান ঠাকুরমশাই…’, বলে বেঞ্চি থেকে উঠে কালিদাসের দুটো হাত চেপে ধরেন মৃদুল দত্ত।
সেদিন হয়তো আরও কথা হত। যদি না দাশু খাওয়াদাওয়া সেরে ওদের তাগাদা দিত—
‘আরে বেলা প্রায় আড়াইটা হতে চলল। যান শীগগির বাড়ি যান। খাওয়াদাওয়া করুন। যা গরম। শরীর খারাপ হয়ে যাবে তো!’

আরও পড়ুন-লং মার্চে অংশ নিয়ে প্রাণ হারালেন কৃষক
*
সেদিন বাড়িতে ফিরলেও মৃদুলবাবুর জন্য বেশ খারাপই লাগছিল কালিদাসের। ভাত বাড়তে-বাড়তে গিন্নিও সেটা টের পেয়েছিল।
‘কী এত ভাবছ গো?’
গিন্নির কথায় উদ্বেগের আঁচ টের পেয়ে ‘ও কিছু না’ বলে খাওয়ায় মনোনিবেশ করেছিলেন কালিদাস। যদিও বারবার মৃদুলবাবুর অসহায় মুখটা ভেসে উঠছিল।
সেদিন সন্ধেবেলা মেয়ের সঙ্গে খুনসুটি সেরে বেরোতে যাবেন এমন সময় দাশুর ফোন এল।
‘আর বলবেন না ঠাকুরমশাই। উকিল সাহেবের স্ত্রী একটু আগেই মারা গিয়েছেন। ওনাদের তো সেরকম কেউ নেই। তাই শেষকাজে আমাদের একটু থাকা প্রয়োজন।’

আরও পড়ুন-নৌশাদের মিথ্যাচার প্রতিবাদে ধাক্কা যুবকের

একথা শোনার পর কালিদাসের মতো মানুষ কী চুপ থাকতে পারে?
শ্মশানে মৃদুলবাবুর স্ত্রীর শেষকৃত্যে হাজির ছিলেন কালিদাস আর দাশুর দোকানের কয়েকজন। ড্রাইভার ছেলেটিও ছিল অবশ্য।
স্ত্রীর মুখাগ্নি করার পর শ্মশানবন্ধুদের চা-বিস্কুট খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন মৃদুলবাবু। সেখানেই কালিদাসের দু-হাত ধরে ফের আর্তি করলেন, ‘পুরোহিতমশাই সুমনার তো গতি করলাম আমি। কিন্তু, আমার গতি কে করবে? আদৌ কি শান্তি পাব মরে?’
মানুষটাকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া কিছুই বলতে পারেননি কালিদাস। সত্যিই তো এ-বয়সে নিঃসন্তান একজন মানুষের এরকম চিন্তা হওয়া একেবারেই অস্বাভাবিক নয়!

আরও পড়ুন-১১ হাজার কিমি রাস্তা উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী
*
এর মধ্যে আবার এক গ্যাঁড়াকল হল। হঠাৎ করেই গভীর রাতে মৃদুলবাবুর ফোন পেয়ে ‘নীলিমা আবাসনে’ ছুটে গেলেন কালিদাস। অত রাতে পরিচিত মানুষ বলেই ওপরে যেতে দিয়েছে কেয়ারটেকার।
যাই হোক, ফ্ল্যাটের দরজা খোলা পেয়ে ভিতরে গিয়ে কালিদাস দেখে বিছানায় শুয়ে পেটে হাত দিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তরুণ মণ্ডল। স্নেহশীল পিতার মতো সমানে ওর গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন মৃদুল।
আর বলছেন, ‘একটু অপেক্ষা কর বাবা। এক্ষুনি অ্যাম্বুল্যান্স আসছে।’ বলেই কালিদাসকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির হাসি হেসে বলে উঠেছেন, ‘এই দেখ। পুরোহিত এসে গিয়েছেন। আর চিন্তা নেই।’ ততদিনে অবশ্য মৃদুলবাবু থেকে কালিদাসের মৃদুলদা হয়ে উঠেছেন বৃদ্ধ মানুষটা।
যার শিয়রে ওরকম পিতৃসম মানুষ রয়েছেন তার সত্যিই চিন্তা কীসের। তরুণকে দেখে হিংসাই হচ্ছিল কালিদাসের। অ্যাম্বুল্যান্স এল খানিক পরেই। নার্সিংহোমে পরের দিনই অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশন হল তরুণের।

আরও পড়ুন-মাণ্ডবীর তীরে আজ ট্রফির হাতছানি, অন্য ডার্বি প্রীতমদের কাছে, ফুটছে বেঙ্গালুরুও

ভর্তি করার সময় আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিটাও দিয়ে দিলেন মৃদুল।
তরুণের নামের পাশে গার্জিয়ান হিসেবে কনসেন্ট ফর্মে সই করলেন।
রিসেপশনিস্ট মহিলাটি তা-ও গাঁইগুই করছিল, ‘আপনি দত্ত আর ওনার সারনেম মণ্ডল। আপনাদের মধ্যে সম্পর্কটা…’
তাকে থামিয়ে পিতৃস্নেহে ভরপুর মৃদুল বললেন, ‘আপনাদের পেমেন্ট ক্লিয়ার হওয়া নিয়ে তো কথা! তা ছাড়া কিছুদিনের মধ্যেই তরুণকে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে দত্তকপুত্র করে নিচ্ছি।’
অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article