বাঙালি : বাংলা মে বোলতা কো বোলতা বোলতা হ্যায়। তব হিন্দি মে বোলতা কো কেয়া বোলতা হ্যায়?
হিন্দিভাষী : আরে ছোড়িয়ে তো। আপ তব সে কেয়া বোলতা বোলতা লাগা রাখা হ্যায়?
ছোট্ট এই কথোপকথনটি সরলসিধা বাঙালি এবং গোবলয়ের এক ধুরন্ধর ব্যবসায়ীর। সেটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গিয়েছেন। আসলে বাংলার মানুষের মতোই এই ভাষাটাও সারল্যে ভরপুর। এবং ততোধিক মিষ্টি। মিষ্টতার নিরিখে বাংলার সঙ্গে তুলনা আসতে পারে দুনিয়ার অন্যতম বেহতরিন লভস উর্দুর।
আর ওপরের কথোপকথনে হিন্দিভাষী ভদ্রলোক কিন্তু ধৈর্য ধরে কথা শুনছেন, তা নয়। তিনি ততক্ষণে মতলব খুঁজছেন। যে এতে তাঁর ফায়দা কতখানি? বেকার বকর বকর করার বান্দা ওনারা নন। আর বাঙালি ততটাই সরল। মেধা অফুরান। বাঙালির প্রতিভার বিচ্ছুরণে তামাম দুনিয়া আলোকিত। কিন্তু ওই যে বদ-অভ্যেস একটা জন্মগত। বাঙালি যে বড় উপকারী মনোভাবাপন্ন। রাস্তার কোনও মানুষ যদি ঠিকানা জানতে চায় এখনও অধিকাংশ বাঙালি সব কাজ ভুলে অসহায় মানুষটিকে প্রায় তাঁর গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছে তবে ক্ষান্ত হন। বাঙালির সরলতার সুযোগ নিয়ে গেরুয়া ব্রিগেড চিরকালই ঠকিয়ে চলেছে আমাদের। শুরুটা সামনে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লোগো লাগিয়ে পিছন থেকে কলকাঠি নাড়া দিনদয়াল উপাধ্যায়কে দিয়ে। গুজরাতে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের গগনচুম্বী স্ট্যাচু স্থাপনের সময় ভুলেও শ্যামাপ্রসাদের কথা মনে পড়ে না এদের। তাছাড়া আরএসএস জন্মলগ্ন থেকেই গণেশ ওল্টানোর খেলায় সুপ্রসিদ্ধ। তাদের তৈরি জনসংঘের ঝাঁপ বন্ধ করে প্রবল ইন্দিরা-বিরোধী হাওয়ায় জনতা দলে ভিড়ে যাওয়া। পরবর্তীতে ঝোপ বুঝে কোপ মেরে বিজেপি নামক রাজনৈতিক দল গড়ে তোলা। এখন আবার নাগপুর বনাম গুজরাতের যে দ্বন্দ্ব বেধেছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে বিজেপির গণেশ উল্টে গেলেও অবাক হতে হবে না।
বাঙালিমাত্রই ধোয়া তুলসীপাতা তা বলছি না। গদ্দার অধিকারী, অচল ঘোষ, ন্যাড়া বাগচীরা হল সেই বিরলতম যারা আপামর বাঙালির সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলা করে। ওই ব্রিটিশ আমলে ছিল না, ইংরেজদের তাঁবেদারি করে রায়বাহাদুর উপাধি বাগিয়ে নেওয়া বাঙালি। আর গদ্দার অধিকারীরা যে দলের হয়ে এইমুহূর্তে হম্বিতম্বি করছেন সে দলের ইতিহাসের ছত্রে-ছত্রে ব্রিটিশের দাসত্ব ও মুচলেকার ইতিহাস খোদাই করা আছে। এই মুহূর্তে বাঙালি বিভীষণদের তালিকায় আরও এক গদ্দারের আবির্ভাব হয়েছে। এমনিতে তিনি মরশুমি হিসেবেই পরিচিত। বাংলায় যখন তাঁর ইভেন্ট বা রিয়েলিটি শো থাকে তখন হঠাৎ হঠাৎ উদয় ঘটে। প্রচণ্ড গরমে গলায় মাফলায়, মাথায় উলের টুপি-সহ কিম্ভূতকিমাকার পোশাকে দেখে কেমন অস্বস্তি হয় আমাদেরই। তার ওপর তিনি এমন এক অভিনেতা যিনি জীবনের মধ্যগগনে বাংলার দিকে ফিরেও তাকাননি। বলিউডি কেরিয়ারে ভাটা পড়ায় বাংলায় নোঙর বেঁধেছেন। সবথেকে বড় কথা বাঙালি-বিদ্বেষী বিজেপির হয়ে প্রচারে এসে তিনি গোবলয়ের গোয়েবলসীয় অসত্য তথ্য পরিবেশন করে গেলেন। এমন একটা দিনে উত্তর কলকাতায় তাঁকে দেখা গেল যেদিনটা বাঙালির হৃদয়হরণ করা মহানায়ক উত্তমকুমারের প্রয়াণদিবস। আপামর বাঙালি শোকবিহ্বল, নস্টালজিক।
অথচ মহানায়ক নিয়ে একটা শব্দও বেরোল না তথাকথিত ‘মহাগুরু’র মুখ থেকে। তাঁর কাছে হয়তো এই মুহূর্তে ‘মহানায়ক’ নরেন্দ্র ভাই দামোদরদাস মোদি। আগে যেমন জ্যোতি বসু ছিলেন তাঁর মহানায়ক! এভাবে গিরগিটির মতো রঙ বদলে মহানায়ক পাল্টানোর ইতিহাস তাঁকে সমগ্র বাঙালি সমাজের কাছে খেলো করে তুলেছে। এহেন মিঠুনবাবু যখন বলছেন, সারা দেশ জুড়ে বাঙালির ওপর অত্যাচারের খবর ভুল, তখন বোঝাই যায় কতটা মেরুদণ্ড বিকিয়ে বসে আছেন তিনি। ছেলেকে বাঁচাতে শেষপর্যন্ত এতটা নিচে নামলেন?
প্রতিনিয়ত তথ্য আসছে বাঙালির ওপর অত্যাচারের। একের পর এক বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাঙালি খতরে মে। আর প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি-সহ পরিযায়ী পাখি বিজেপি নেতারা এখানে এসে বলে চলেছেন, তাঁরা নাকি বাঙালি অস্মিতা রক্ষা করবেন। এ যেন বেড়ালের গলায় মাছ খাব না’র ধাষ্টামো। বকতপস্বী বিজেপি নেতাদের বিশ্বাস করার পরিণাম কী হতে পারে তা হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছে তামাম দেশবাসী। বস্তুত, দেশের সংবিধান নিয়েই টানাটানি করছে একদল হিংস্র শ্বাপদ। বেআব্রু করে দিচ্ছে ভারতবর্ষের দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোকে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের আকাশচুম্বী দামে নাভিশ্বাস উঠছে দেশবাসীর। দেশের জোটনিরপেক্ষ আদর্শের দলাইমালাই করে পুরো বিশ্বের দরবারে ভারতকে কোণঠাসা করে দিয়েছে মো-শা জুটির হঠকারী পদক্ষেপ। সঙ্গে বাঙালি বিদ্বেষের বুলডোজার নিয়ে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে ইংরেজের বুট পালিশ করা গেরুয়া বাহিনী। পরাধীন ভারতে এই বাংলা থেকে একের পর এক অগ্নিযুগের বিপ্লবী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অগ্রণী ছিলেন। নেতাজি, ক্ষুদিরাম, মাতঙ্গিনী, বিনয়-বাদল-দীনেশরা যখন রক্ত ঝরাচ্ছেন তখন তাঁদের উজ্জীবিত করেছে বঙ্কিমের বন্দে মাতরম। জাতীয় সঙ্গীত রচয়িতা রবিঠাকুর থেকে নজরুল কে নেই! সেদিক থেকে ফের বাঙালি আরেক স্বাধীনতার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। গোটা দেশ জুড়ে বাঙালি মাত্রই রোহিঙ্গা (খায় না মাথায় মাখে কেউ জানে না) আর বাংলাদেশি বলে দেগে দেওয়া শুরু হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে। অসমের দলবদলু গৈরিক মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা তো সরাসরি বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশি বলে কুমন্তব্য করেছেন। দেশের বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে একের পর এক বাঙালির ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। হয় ডিটেনশন ক্যাম্প নয় বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া। গণতান্ত্রিক পথে বাংলা জয় দূরস্থ বুঝতে পেরে পিছনের রাস্তা দিয়ে এভাবে বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার কুৎসিত পথ নিয়েছে আরএসএস, বিজেপি। সুখের কথা, এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতে লড়াইয়ের ব্যাটন বাংলার নয়া রেনেসাঁর কান্ডারি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। সিপিএমের ৩৪ বছরের লাগামছাড়া অত্যাচার, নিপীড়নের হাত থেকে যিনি বাংলা মা’কে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছেন। দিল্লির দানবদের দস্যুপনাও তিনি ঠিক আটকে দেবেন।
এই বিশ্বাসে বলীয়ান আপামর বাঙালি!
আরও পড়ুন: ভাষা বিদ্বেষ নিয়ে এবার বাংলা গান