প্রতিবাদের আগুনই হোক শিক্ষার আলো

বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, ছাত্র রাজনীতিই বাংলার রাজনীতির পথে একটা-একটা করে আলোকস্তম্ভ গড়ে দিয়ে গেছে

Must read

সুদীপ রাহা: বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, ছাত্র রাজনীতিই বাংলার রাজনীতির পথে একটা-একটা করে আলোকস্তম্ভ গড়ে দিয়ে গেছে। ছাত্র রাজনীতি আসলে বুকের ভেতর বারুদ ঠেসে নেওয়ার একটা স্কুল, যে স্কুলিং আমাদের ‘আপন পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে’ জ্বলে ওঠার সাহস জোগায়। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ছাত্র রাজনীতি আরও প্রাসঙ্গিক, আরও প্রয়োজনীয়। দেশের বুক থেকে দ্বেষের রাজনীতিকে ঝড়ে উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে ছাত্র আন্দোলন। সুকান্ত তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন, ‘এ দেশের বুকে আঠেরো আসুক নেমে’। আঠেরোর প্রাসঙ্গিকতা এখানেই। কারণ, ‘এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য’। নির্ভীক লড়াইয়ের যে মন তা তৈরি করে দেয় ছাত্র রাজনীতি। ঘটনার দুর্বিপাকে ছাত্র রাজনীতিকে কলঙ্কিত করতে চায় তারা, যারা এ নব নবীনের গান’কে ভয় পায়। নতুনের কেতন উড়িয়ে ছাত্ররাই পারে রাজনীতির ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া দেওয়ালে প্রাসঙ্গিকতার রং ঢেলে দিতে। এই রাজনৈতিক উন্মাদনা-উদ্দীপনার ঢেউয়ে ‘মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে’ ভেসে যেতে পারে ছাত্র-ছাত্রীরাই। ছাত্র-রাজনীতিই দেশনেতাদের জন্ম দিয়েছে। দেশজুড়ে হাজার হাজার উদাহরণ আছে তার। আমাদের চোখের সামনে আমরা যে রক্তকরবীর ‘নন্দিনী’কে দেখি সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফায়ারব্র্যান্ড বানিয়েছে ছাত্র-রাজনীতিই।

আরও পড়ুন-রাজনীতির শিকড় ছাত্রসমাজ

আজকের ভারতবর্ষে কৃষক-শ্রমিকদের মতো ছাত্রছাত্রীরাও বঞ্চিত হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে। নিঃশব্দে লুঠ হয়ে যাচ্ছে শিক্ষার অধিকার। কেন্দ্রীয় এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি হোক কিংবা এডুকুইটি-র (Eduquity) মতো কালিমালিপ্ত সংস্থার মাধ্যমে হয়ে চলা প্রতারণা—প্রতিটি ক্ষেত্রেই দায় এড়িয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এই সরকার পরীক্ষায় স্বচ্ছতা ও যোগ্য প্রার্থীদের ভবিষ্যৎ রক্ষার বদলে দুর্নীতি ও প্রভাবশালীদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছে। ফলস্বরূপ দেশের কোটি-কোটি ছাত্রছাত্রীর স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, অথচ নরেন্দ্র মোদির সরকার এই গভীর সংকটের দায় স্বীকার তো করছেই না, বরং নীরব থেকে কার্যত দুর্নীতিকে আশ্রয় দিচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আস্থা নষ্ট করে দিয়ে বিজেপি সরকার গোটা প্রজন্মকে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
অন্যদিকে, নতুন শিক্ষানীতি (NEP) আসলে শিক্ষাকে আরও দুর্লভ করে তুলছে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জন্য। চার বছরের স্নাতক কোর্স চালু করার ফলে ইতিমধ্যেই বহু শিক্ষার্থী মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে, কারণ আর্থিক বৈষম্যে ভরা এই দেশে একটি অতিরিক্ত বছর মানে পরিবারের উপর দ্বিগুণ বোঝা। যাদের পরিবার দিন আনে দিন খায়, তাদের কাছে এক বছরের বাড়তি খরচ আর সময় অপচয় একেবারেই অসহনীয়। ফলে উচ্চশিক্ষা আরও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে গরিব এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য। আসলে বিজেপি সরকারের মূল মন্ত্রটাই হল—যখন পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান দেওয়া সম্ভব নয়, তখন শিক্ষাই যেন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। এভাবেই তারা পরিকল্পিতভাবে ছাত্রসমাজকে অশিক্ষিত রেখে ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করছে। আমরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের কাছে এ বিষয়টা আরও বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে, তাঁদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলতে চাই।

আরও পড়ুন-আমার ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে: মহারাষ্ট্র নিবাসের গণেশপুজোয় উপস্থিত মুখ্যমন্ত্রী

গবেষণাক্ষেত্রের দিকেও যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখব, বিজেপি সরকারের নীতির ফলে ভারতে অ্যাকাডেমিক গবেষণা কার্যত ধ্বংসের মুখে। Scholars at Risk (SAR)-এর Free to Think 2024 রিপোর্ট জানাচ্ছে, ভারতের অ্যাকাডেমিক ফ্রিডম ইনডেক্স ২০১৩ সালের ০.৬ থেকে নেমে এসে ২০২৩-এ দাঁড়িয়েছে মাত্র ০.২-এ—যা স্বাধীনতার পর সর্বনিম্ন। সরকারের এজেন্ডা চাপিয়ে দেওয়া, সমালোচক অধ্যাপকদের ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দেওয়া, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন দমন করার ফলে গবেষণার পরিবেশ ভেঙে পড়ছে। অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সব্যসাচী দাস কেবলমাত্র একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করার পর বিজেপি নেতাদের চাপে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন—যা ভারতের অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতার শ্বাসরোধের স্পষ্ট উদাহরণ। একইসঙ্গে সরকার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার অর্থ বরাদ্দ কমিয়ে বেসরকারীকরণের পথে ঠেলে দিচ্ছে, যাতে স্বাধীন, সমালোচনামূলক ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ, বোঝাই যাচ্ছে আমাদের দেশের হীরক রাজা বুঝে গেছেন, ‘‘ওরা যত বেশি জানে, তত কম মানে’’। তাই শিক্ষা ব্যবস্থাটাই আজ ধ্বংসের মুখে। যে-দেশে ডবল ইঞ্জিন রাজ্য উত্তরপ্রদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাদ চলে যান পাঠ্যসূচি থেকে, আর পরিবর্তে আসেন সাভারকর; সে-দেশে শিক্ষার কালো দিন ঘনিয়ে এসেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একমাত্র সংঘবদ্ধ আন্দোলনই পারে এ দুঃসময়ের মেঘকে শিক্ষার প্রগতির ঝড়ে উড়িয়ে প্রকৃত দেশপ্রেমের নজির গড়তে। ছাত্র-ছাত্রীদের ইস্যু নিয়ে গড়ে উঠুক বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলন। আমাদের বিশ্বাস, এ অন্ধকার কেটে যাবে।
আজ ২৮শের মঞ্চ আমাদের কাছে নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও আমাদের অধিনায়ক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বার্তা এনে দেবে। সেই বার্তাই আমাদের সঞ্জীবনী শক্তি; যা বাংলা-বিরোধী, শিক্ষা-বিরোধী, ছাত্র-বিরোধী বিজেপির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইকে আরও শক্তিশালী করবে। প্রতিবাদের আগুন দিয়েই আমরা শিক্ষার প্রদীপে আলো জ্বালব।

Latest article