ধরুক পুরুষ পরম পৌরুষে সভ্যতার তরবারি, সদা তার পাশে রয়েছে যে গো বিজয়লক্ষ্মী নারী

আন্তর্জাতিক নারীদিবস বর্ষপঞ্জিতে দেগে দেওয়া একটি দিবস মাত্র নয়। ভিন্ন তার গৌরব গাথা, উজ্জ্বল তার হয়ে ওঠা। ৮ মার্চের রেশ ধরে সে কথাটাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন অধ্যাপক ড. রূপক কর্মকার

Must read

আমাদের অর্ধেক আকাশ নারীদের। কিন্তু এই ভাবনা থেকে আমরা আরও একধাপ এগিয়ে বলতে পারি, মহাকাশ থেকে সমুদ্র, বিজ্ঞান থেকে সাহিত্য, রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, সঙ্গীত থেকে খেলাধুলা, সর্বত্রই শুধু নারীদের সাফল্যের পদচিহ্ন। আন্তর্জাতিক নারীদিবস অর্থাৎ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে নারীদের কৃতিত্বের স্বীকৃতি দেওয়ার দিন। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ দ্বারা আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালিত হলেও তার সূত্রপাত কিন্তু হয়েছিল আরও প্রায় ১৩০ বছর আগে ১৮৪৮ সালে। দাসপ্রথা বিরোধী সম্মেলনে নারীদের বক্তৃতা দিতে বাধা দেওয়ায় ক্ষুব্ধ আমেরিকান এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যান্টন এবং লুক্রেটিয়া মট নিউইয়র্কে প্রথম নারী অধিকার আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। আমেরিকায় প্রথম জাতীয় নারীদিবস পালিত হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী সময়ে যা ৮ মার্চ নির্ধারণ হয়। নারীদিবস উদযাপনের গোড়ার দিকে উদ্দেশ্য ছিল নারীদের ভোটাধিকার, কিন্তু সময়ের প্রবাহে নারীদিবসের অঙ্গীকার হয়ে ওঠে সমতা ও সাম্যের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উন্নত দেশগুলোতে নারীদের জীবন নাটকীয় ভঙ্গিতে পরিবর্তিত হতে থাকে।

আরও পড়ুন-আসন্ন গ্রীষ্মে হাওড়া শহরে পানীয় জল সরবরাহ নিয়মিত রাখতে বৈঠকে কেএমডিএ এবং পুরসভা

উন্নত প্রযুক্তি নারীদের গৃহস্থালির বোঝা অনেক কমিয়ে দেয়, এতে নারীদের আয়ুষ্কাল সহজাত প্রবৃত্তিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তৎকালীন সময়ে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচিত হতে শুরু করে এবং নারীদের জীবনেরও পট পরিবর্তন হয়। নারীদের ভাবনা ছিল উন্নত সমাজে তাদের বাধা বিপত্তি হয়তো কমতে থাকবে, সেই ভাবনা যে ভুল তা অচিরেই প্রমাণিত হয়েছিল এবং নারীদের কাছে বাধার পাঁচিল যেন আরও মজবুত হতে শুরু করেছিল। ১৯৬৩ সালে বেটি ফ্রিডান রচিত‍‘নারীর রহস্য’ নামক বইটিতে নারীদের জীবন নিয়ে কিছু সুন্দর বর্ণনা করেছিলেন, তাঁর মতে, ‘‘নারীদের আয়ুষ্কাল গৃহপালিত জীবন দ্বারা মৃত হয়ে পড়েছিল, তারা তাদের নিজেদের হতাশাকে চিনতে এতটাই সামাজিক ভাবে বাধ্য ছিল যে তাদের চলার সীমানাটাও বাঁধা ছিল।’’ পরিবার থেকে শুরু করে সমাজে পুরুষতান্ত্রিক ও লিঙ্গ বৈষম্যের আস্ফালনে নারীরা প্রায় কুক্ষিগত হয়ে পড়েছিল। হুমায়ন আজাদের এক বিশ্লেষণ এখানে না বললেই নয়, ‘‘পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ শহিদের নাম মা।’’ আসলে নারীদিবসের অন্য একটি তাৎপর্য রয়েছে, তা হল লিঙ্গ বৈষম্যের লড়াই। নারীদিবসের তাৎপর্য কয়েকটি পর্যায়ক্রমে লুকিয়ে রয়েছে। মূলত সেগুলি হল, সমঅধিকার, বৈষম্য দূরীকরণ ও সর্বাঙ্গে স্বাধীনতা। আর এই সকল বাধা একমাত্র দূর করতে পারে শিক্ষার প্রসার। শ্রী ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘বঙ্গ সাহিত্যে নারী’তে স্ত্রীশিক্ষার বিষয়টি পূর্ণাঙ্গরূপে বর্ণিত আছে। এই গ্রন্থটিতে আলোচিত ছিল সাধারণ দরিদ্র পরিবারে মেয়েদের শিক্ষার কোনও অধিকার ছিল না। সেই সমাজে বদ্ধমূল ধারণা ছিল, যে মেয়ে লেখাপড়া করে সে রাঁড় (বিধবা) হয়। এই প্রসঙ্গে রাজা রামমোহন রায় এক বাদানুবাদে বলেছিলেন, ‘‘আপনারা বিদ্যা শিক্ষা জ্ঞানোপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন নাই, তবে তাহারা বন্ধিহান হয় ইহা কিরূপে নিশ্চয় করেন।’’ ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেশ কিছু ক্ষণজন্মা মানুষ ধরিত্রীর বুকে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তার মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন অন্যতম। বিধবাবিবাহকে আইনসিদ্ধ করা (১৮৫৭), বাল্যবিবাহ নিবারণের জন্য আইন পাশ করা (১৮৭১), সমাজের আরও এক ব্যাধি বহুবিবাহ দূর করার যে প্রয়াস তা সমাজের এক অন্য পথকে প্রশস্ত করেছিল। কৌলিন্য কিংবা বর্ণ অথবা জাতিভেদের মতো কুসংস্কারের শিকড়ে আঘাত করে মানবতার যে জয়গান রচনা হয়েছিল তার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বিদ্যাসাগর। আরও এক মহামানব বিবেকানন্দের নারীদের প্রতি ভাবনা আরও উচ্চতর।

আরও পড়ুন-২-২ ড্র মহামেডানের

তাঁর মতে, নারীরা হল উন্নত অগ্রগতির চাবিকাঠি। তাঁর উপলব্ধি ছিল জাতির অগ্রগতির সর্বোত্তম থার্মোমিটার হল নারীদের প্রতি আচরণ। নিখুঁত নারীত্বের ধারণা হল নিখুঁত স্বাধীনতা। আর একজন অবিবাহিত পুরুষ হল অর্ধেক পুরুষ এবং অসম্পূর্ণ। স্বামী বিবেকানন্দ আরও উপলব্ধি করেছিলেন, নারীদের অজ্ঞতা সমাজের অগ্রগতির প্রধান অন্তরায়। আর এই অন্তরায় মোছার একমাত্র উপায় হল নারীশিক্ষার উন্নয়ন। ১৮৯৩ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর বস্টন ইভনিং ট্রান্সক্রিপ্টে স্বামী বিবেকানন্দের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেই সাক্ষাৎকারে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তাঁর বিয়ে করার পরিকল্পনা আছে কি না? তাঁর তাৎক্ষণিক উত্তর ছিল, ‘‘আমি কেন বিয়ে করব, যখন আমি প্রতিটি নারীর মধ্যে কেবল ঐশ্বরিক মাতাকেই দেখি? কেন আমি এই ত্যাগ স্বীকার করব?’’ তাঁর আরও উত্তর ছিল, ‘‘ভারতের আদর্শ নারীত্ব হল মাতৃত্ব— সেই অসাধারণ, নিঃস্বার্থ, সকল দুঃখ-কষ্ট ভোগকারী, চির ক্ষমাশীল হল মা।’’ বর্তমান সময়ে সমাজে নারীদের স্বতন্ত্রতা উল্লেখযোগ্য ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। নারীরা এখন স্বাবলম্বী, আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ, সুসচেতন এবং সর্বোপরি স্বাধীন। রাজনীতি থেকে খেলাধুলা, শিক্ষা থেকে ব্যবসা, নানান পরিধিতে নারীদের সাফল্য ঈর্ষান্বিত। তবে উন্নয়নের পাল্লা কখনও একমুখী হতে পারে না, যেমন একটি পাখির পক্ষে কখনওই এক ডানায় উড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই নারী-পুরুষের উভয়ের কল্যাণেই সমাজের সমৃদ্ধির চাবিকাঠি লুকিয়ে। তবে সাম্প্রতিককালে একটা নাম না বললে নারী ক্ষমতায়নের প্রেক্ষাপটটা হয়তো অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, তিনি পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যে নারী ক্ষমতায়নের এক মূর্ত প্রতীক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কন্যাশ্রী প্রকল্প নারী ক্ষমতায়নে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। যা নারী সমাজে এক দৃষ্টান্ত উল্লেখিত হয়েছে। কন্যাশ্রী প্রকল্প শুধু নারী ক্ষমতায়ন করেছে তাই নয়, বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক ব্যাধিকেও সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন করেছে। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, বিধবাভাতা, আর্থিক দিক থেকে নারীদের স্বাবলম্বী করার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে তাদের ভিত আরও মজবুত করেছে। সামাজিক ভিত মজবুতে এবং নারী ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে সকল কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তা এক কথায় অনবদ্য, প্রশংসার যোগ্য।

আরও পড়ুন-মা ক্যান্টিনের প্রসারে বরাদ্দ আরও পঞ্চাশ কোটি টাকা

আধুনিক সময়ের ওপর ভিত্তি করে যদি নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে কখনও কোনও ইতিহাস রচনা হয়, সেখানে সর্বজনসম্মতিক্রমে অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামটি একবার হলেও উচ্চারিত হবে। মনুষ্য সৃষ্টির আদি শক্তি নারীদের কোনও নির্দিষ্ট দিন হয় বলে আমরা মনে করি না, আমাদের জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত তাদের ঘিরেই। তবে শেষে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা স্মরণীয় কথাগুলোতেই নারীদিবসের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করি, ‘‘কোনকালে একা হয়নিকো জয়ী, পুরুষের তরবারি; প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে, বিজয়লক্ষ্মী নারী’’।

Latest article