স্বামীজির প্রদর্শিত পথে গড়ে উঠুক যুবসমাজ

আজ স্বামী বিবেকানন্দের ১৬৩তম জন্মদিবস। যদিও প্রতিটি দিনই নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসে, তবু, জাতীয় যুবদিবস হিসেবে যুবসমাজের কাছে আজকের দিনটি বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। তথ্য দেখাচ্ছে, আমাদের দেশে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ মানুষের বয়স ৩৫ বছরের মধ্যে। আবার ২৫ বছরের মধ্যে নাগরিক দেশের মোট জনগণের প্রায় ৫০ শতাংশ। তাঁদের কাছে আজকের দিনটির বিশেষ বার্তা পৌঁছে দিলেন বরিষ্ঠ শিক্ষাবিদ ড. শিবরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

Must read

রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে ১২ জানুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন জাতীয় যুবদিবস হিসাবে পালন করবার সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়। তখন থেকেই প্রতি বছর স্বামীজির জন্মদিন জাতীয় যুবদিবস হিসাবে পালিত হয়। স্বামীজি কোনও নির্দিষ্ট জাতি বা রাষ্ট্রের নন। তিনি সমগ্র বিশ্বের। জাতি ধর্ম-বর্ণ-বয়স নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের কাছে বিবেকানন্দ প্রাসঙ্গিক। সমস্ত ধরনের মানুষই তাঁর দ্বারা অনুপ্রণিত হয়েছেন, সকলেই তাঁর প্রিয়। তবে বিবেকানন্দের বিশেষ প্রিয় ছিল তরুণ ও যুবসমাজ। তিনি যুবকদের উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতেন। তিনি চেয়েছিলেন, প্রতিটি যুবক-যুবতীর শারীরিক, বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়ন। সুঠাম দেহ ছাড়া বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়ন অসম্ভব, এটা স্বামীজি উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি একবার কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, গীতাপাঠ করার চেয়ে ফুটবল খেলা অনেক ভাল। গীতাপাঠের প্রয়োজনীয়তা তিনি কখনও অস্বীকার করেননি। যেটা বলতে চেয়ছিলেন, গীতার মর্ম উপলব্ধি করতে হলে সুস্থ শরীর ও সুস্থ মন আবশ্যক। তার জন্য খেলাধুলো করা, শরীর চর্চা করা জরুরি। তিনি স্বাবলম্বী হওয়ার উপর সর্বাধিক জোর দিয়েছিলেন। তিনি যুবসমাজকে উদ্দেশ্য করে বারবার বলেছিলেন, অপরের উপর নির্ভর কোরো না। নিজের উপর নির্ভর করতে শেখো। স্বাবলম্বী হওয়ার সঙ্গে চাই আত্মবিশ্বাস।

আরও পড়ুন-জিতেও খুশি নন মোলিনা, অস্কারের তোপে রেফারি

স্বামীজি লিখেছেন, পুরানো ধর্ম বলে, যে ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে না, সে নাস্তিক। নতুন ধর্ম বলে যে নিজেকে বিশ্বাস করে না, সেই নাস্তিক। তরুণ-যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের সমস্যা সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। বিবেকানন্দ একাধিকবার বলেছিলেন, আমাদের শিক্ষা হয় কেরানি তৈরি করেছে অথবা ‘দুষ্টু উকিল’ তৈরি করেছে। চাকরির পরিবর্তে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে রোজগারের উপর জোর দিয়েছেন। স্বামীজি তাঁর আস্থাভাজন শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে পরামর্শ দিচ্ছেন, শাড়ি সংগ্রহ করে জাহাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে। তিনি তাঁর পরিচিত মানুষদের চিঠি দিয়ে দেবেন। প্রথমে কিছুদিন ধৈর্য্য ধরে লেগে থাকলে ভাল বিক্রি হবে। রোজগার ভালই হবে। কেরানির চাকরি করে কী হবে? কোনও কাজকেই স্বামীজি তুচ্ছ মনে করতেন না। কিন্তু পরের গোলামি করার চেয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজের শ্রম ও উদ্যমে কিছু করা ও অর্থ উপার্জন করা তিনি অনেক বেশি মর্যাদাপূর্ণ মনে করতেন। এইভাবে যুবসমাজ স্বনির্ভর হতে পারলে দেশের অর্থনীতি মজবুত হবে। শরৎবাবুকে বিবেকানন্দ আরও বলেছেন: ‘‘আমি চাই A Band of Young Bengal। এরাই দেশের আশা-ভরসাস্থল। চরিত্রবান, বুদ্ধিমান, পরার্থে সর্বত্যাগী এবং আজ্ঞানুবর্তী যুবকদের উপরেই আমার ভবিষ্যৎ ভরসা— আমার idea-গুলি যারা wark out করে নিজেদের ও দেশের কল্যাণ-সাধনে জীবনপাত করতে পারবে” (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, নবম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩৭)। বিবেকানন্দের অনুরাগী মাদ্রাজের তরুণ-যুবকদের অন্যতম নেতা আলাসিঙ্গা খেরতমলকে ১৮৯৩-এর ২০ অগাস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি চিঠিতে বিবেকানন্দ লিখছেন : ‘‘গণ্যমান্য, উচ্চপদস্থ অথবা ধনীর উপর ভরসা রাখিও না। তাহাদের মধ্যে জীবনশক্তি নাই— তাহারা একরূপ মৃতকল্প বলিলেই হয়। ভরসা তোমাদের উপর— পদমর্যাদাহীন, দরিদ্র, কিন্তু বিশ্বাসী— তোমাদের উপর। ভগবানে বিশ্বাস রাখো। কোনও চালাকির প্রয়োজন নাই; চালাকি দ্বারা কিছুই হয় না। দুঃখীদের ব্যথা অনুভব কর, আর ভগবানের নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর— সাহায্য আসিবেই আসিবে… হে মাদ্রাজবাসী যুবকগণ, আমি তোমাদের নিকট এই গরিব, অজ্ঞ অত্যাচার-পীড়িতদের জন্য এই সহানুভূতি, এই প্রাণপণ চেষ্টা— দায়স্বরূপ অর্পণ করিতেছি।” (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠ ২৮৮)। প্রখ্যাত ও অতি-বিশিষ্ট বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখছেন, ১৯০১-এর ১৯ মার্চ স্বামীজি প্রথম ঢাকায় এলেন। হেমচন্দ্র এবং তাঁর ১০/১২ জন বন্ধু স্বামীজির সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেলেন। তাঁদের কারও বয়স ১৮/১৯-এর বেশি নয়। শ্রদ্ধেয় হেমচন্দ্রের কথায়, ‘‘যদিও স্বামীজীকে তাঁর ঢাকায় আসার প্রথম দিনেই তাঁকে দর্শন করেছিলাম, তবু আমি মনে করি, তাঁকে সত্যিকারের প্রথম এবং প্রকৃত দর্শন আমি করেছিলাম স্বামীজীর ঢাকা থেকে চলে আসার দু-একদিন আগে। ঐদিনই স্বামীজীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে এবং একান্তে দেখা করার দুর্লভ সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। জ্বলন্ত অগ্নিশিখার স্পর্শ পেয়ছিলাম আমারা সবাই সেদিন। আমাদের সকলকে এক অপূর্ব চৈতন্যালোকে নিয়ে গেল তাঁর স্পর্শ, তাঁর বাণী। ঐদিন এবং তার পরের দিন স্বামীজীর সঙ্গে আমার ঐ সাক্ষাতের ফলে আমি জীবনে এক নতুন আলোকের সন্ধান পেয়েছিলাম যা আমার জীবনের গতিপথকে নির্ধারিত করে দিয়েছিল। অবশ্য ঐ দুর্লভ দর্শনের এবং তাঁর আশীর্বাদ ও অনুপ্রেরণা লাভের সৌভাগ্য শুধু আমার একারই হয়নি। আমার সঙ্গে ঐ দু’দিনই ছিল আমার বাছাইকরা কয়েকজন অন্তরঙ্গ বন্ধু। এটা একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার যে, আমাদের ঐ দলের প্রত্যেকেই পরিবর্তিকালে হয়েছিল এক-একজন দুর্ধর্ষ মুক্তি-সংগ্রামী। যুগনায়কের সঙ্গে সেই সাক্ষাৎকার তাই শুধু আমারই জীবনের ভবিষ্যৎ যাত্রাপথকে উন্মুক্ত করে দেয়নি, আমাদের সেই বন্ধুগোষ্ঠীর সকলকেই করেছিল। আমাদের সকলের কাছেই সেই সাক্ষাৎকার যেন একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছিল” (হেমচন্দ্র ঘোষের স্মৃতিকথার কিছু অংশ ছাপা হয়েছিল চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ গ্রন্থে, স্বামী লোকেশ্বরানন্দ সম্পাদিত)। ১৯০২-তে বিবেকান্দের মৃত্যুর অল্পদিনের মধ্যে তাঁর প্রভাব আগুনের মতো তরুণ-যুবসমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯১৩-তে ব্রিটিশ সরকার গঠিত Sedition Committee তার রিপোর্টে লিখেছিল, মৃত বিবেকানন্দ জীবিত বিবেকানন্দের চেয়ে আরো ভয়ংকর। মুক্তি আন্দোলন, বিপ্লবী আন্দোলনের উপর স্বামীজীর প্রভাব ছিল সর্বাধিক— ঐতিহাসিকেরা এই ব্যাপারে মোটামুটি একমত। পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয়তম মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণীদের আর্থিকভাবে স্বর্নিভর হওয়ার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য বহু প্রকল্প ও কর্মসূচি নিয়েছেন, যা আমাদের রাজ্যে এই প্রথম। খেলাধুলোতে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের উৎসাহিত করার জন্য সরকারি অনুদান দেওয়া হচ্ছে। বিবেকানন্দ যুবসমাজের উপর সর্বাধিক ভরসা করেছিলেন, সেই ভরসাকে বাস্তবায়ন করবার আন্তরিক প্রচেষ্টা করছেন মমতা এবং তাঁর সরকার।

Latest article