চলো যাই পিকনিকে

একটা সময় ছিল যখন শীতের আগমনে বসত চড়ুইভাতির আসর। সেই লোকজীবনের গন্ধমাখা বনভোজনের আয়োজন এখন পরিবর্তিত আবহে পিকনিক। সেকালের উল্টো দিকে একালকে আতশকাঁচের নিচে ফেলে দেখলেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়

Must read

“বনভোজনে পাখিরা সব আসছে ঝাঁকে ঝাঁক
মাঠের ধারে আমার ছিল চড়িভাতীর ডাক
যে যার আপন ভাঁড়ার থেকে যা পেল যেইখানে
মাল মশলা নানারকম জুটিয়ে সবাই আনে।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘‘চড়িভাতী” কবিতার এই লাইনগুলো পড়লেই বয়স নির্বিশেষে সকলের মধ্যেই ভিড় করে আসে চড়ুইভাতি অর্থাৎ পিকনিকের (Picnic) এক প্রাণোচ্ছল আমেজ। মনটা কেমন যেন মাতোয়ারা হয়ে উঠতে চায় বনভোজনের আনন্দে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার উচ্ছ্বাসে। শীতের আমেজ বর্তমানে প্রখর আর এই আমেজের আস্বাদ নেওয়ার এক অনন্য উপায় হল বনভোজন অর্থাৎ পিকনিক। এই শব্দটির আবির্ভাব ঘটেছে ল্যাটিন শব্দ “Pique nique” থেকে। পিকনিক শব্দটি শুনলে যে চিন্তা সর্বপ্রথম আমাদের মস্তিষ্কে উদ্রেক ঘটায় সেটা হল বাঁধভাঙা আনন্দ আর হইহুল্লোড়। বলাই বাহুল্য পিকনিক হল এক ধরনের এক্সকারশন অর্থাৎ ফিস্ট যে ক্ষেত্রে বন্ধু তথা পরিবারের সাথে একসঙ্গে মিলেমিশে মেতে ওঠা হয় বাড়ির বাইরে কোনও একটা জায়গায়। এই জায়গা কোনও নির্জন, নিরিবিলি স্থান হতে পারে অথবা এমনকী কোনও দর্শনীয় বা উল্লেখযোগ্য স্থানও হতে পারে। এই পিকনিক বা বনভোজন মূলত বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়স্বজনদের একত্র করে। নিয়ে আসে এক ছাদের তলায়। সুদৃডঢ় করে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের বাঁধন। বর্তমান ব্যস্ত জীবনে পিকনিকের অবদান অপরিসীম। কারণ পিকনিকের মাধ্যমে সংসার বা জীবন জীবিকার বাঁধনে বাঁধা পড়া মানুষ খুঁজে পায় মুক্তির আনন্দ। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কথাবার্তার মাধ্যমে রঙিন মুহূর্ত কাটানোর আস্বাদ। সাধারণত পিকনিক বা বনভোজন প্রকারভেদে আবর্তিত হয়। পারিবারিক পিকনিক, স্কুল বা কলেজ ভিত্তিক পিকনিক এবং কর্মক্ষেত্রগত পিকনিক।

তবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চড়ুইভাতির (Picnic) আদলের মধ্যে এসেছে কিছু বিস্তর পরিবর্তন। সে সময়কার অর্থাৎ ৯০ দশকের পিকনিক আর বর্তমান যুগ অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীর পিকনিকের মধ্যে রয়ে গেছে কিছু পার্থক্য যেগুলি সমাজের প্রত্যেক স্তরের মানুষজনের কাছেই প্রত্যক্ষিত। সমাজ তীব্রগতিতে অত্যাধুনিকতার পথে অগ্রসর হচ্ছে এবং সেই অত্যাধুনিকতা ক্রমাগত ফেলছে মানুষের কর্মব্যস্ত জীবনে একটা ছাপ। চড়ুইভাতি এই কর্মব্যস্ত জীবন থেকে সাময়িক মুক্তিলাভের পথ। সুতরাং বর্তমান সমাজের বনভোজন অত্যাধুনিকতার বৃহৎ জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাবে তাতে আর সন্দেহ কি!

আরও পড়ুন- কাজের ধরন বদল, ২০৩০ সালের মধ্যে হারিয়ে যাবে ৯ কোটি ২০ লক্ষ চাকরি 

সে কালে মানুষের জীবন ছিল সহজ সরল মানের চড়ুইভাতিতে এত অত্যাধুনিকতার ছাপ না থাকায় সেই সময়কালে চড়ুইভাতি অথবা বনভোজনের সময় রান্নাবান্না পিকনিক স্পটেই করা হত। সেই রান্নায় সকলে হাত লাগাত এই একসাথে কাজের মধ্যে দিয়ে কেবলমাত্র তাদের ভাল সময়ই অতিবাহিত হত না বরং তাদের মধ্যিকার পারস্পরিক বন্ধন আরও সুগঠিত এবং মজবুত হত।
বর্তমানের আধুনিকতায় বনভোজন বা পিকনিকের সেই স্বাদ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সাম্প্রতিক চড়ুইভাতি বা পিকনিকে দেখা লোকজন রান্নাবান্নার দায়িত্ব ক্যাটারার বা রাধুনীর হাতে তুলে দেয়। সেই রান্নাবান্নায় যে আন্তরিকতার অভাব দেখা যায় সেই অভাবের তাড়নায় আগেকার দিনের পিকনিকের মত মজাটাই হারিয়ে যায়। এক্ষেত্রে অত্যাধুনিকতার তলায় চাপা পড়ে যায় পুরনো দিনের সহজ সরল ব্যবস্থা।
রুমালচোর, ছোঁয়া-ছুঁয়ি, লুকোচুরি, কানামাছি— এইসমস্ত সে সময়কার নস্টালজিক পিকনিকের খেলাগুলি অধুনালুপ্ত। বলতে গেলে বর্তমান পিকনিকে এই সমস্ত খেলাগুলি একেবারে উবে গেছে। এ সময় মানুষ হয়ে গেছে, একেবারে আত্মকেন্দ্রিক। পিকনিক বা বনভোজনে এসেও মানুষ এখন একে অপরের থেকে আলাদা। আর এই আলাদা করার যন্ত্রটি হল প্রত্যেকের হাতে ধরা স্মার্টফোন যেটি উন্নত প্রযুক্তির দান। পিকনিক স্পটে গিয়েও বেশিরভাগ মানুষকে দেখা যায় তারা নিজেদের মতো ডুবে আছে সোশ্যাল মিডিয়া বা অত্যাধুনিক ভিডিও গেমের হাতছানিতে।
বর্তমান যুগের পিকনিক পুরনো দিনের মতো পরিবেশবান্ধব নয়। তখনকার দিনের পিকনিকে এখনকার দিনের মতো ডিজে বা মিউজিক সিস্টেমের প্রচলন ছিল না। পরিবারের সদস্য ও বন্ধু-বান্ধবেরা নিজেদের মধ্যেই কথোপকথন, অন্ত্যাক্ষরি, হাসি-ঠাট্টা-তামাশায় মেতে উঠত। সেই সঙ্গে চলত গ্রামাফোনের মিষ্টি গান। তবে এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অবদান ডিজে পিকনিকের কেবলমাত্র শান্তিপূর্ণ মনোভাবটাকে নষ্টই করে না শব্দদূষণের একটা কারণ হিসেবেও পরিচিত হয়ে ওঠে। বর্তমানে পিকনিক স্পটগুলিতে আনন্দের রসদ হিসেবে ডিজেতে গাঁক-গাঁক করে বেজে চলা অত্যাধুনিক লারেলাপ্পা গান কেবল সমাজের অপসংস্কৃতির অন্যতম কারণ হয়েই উঠছে না অপরদিকে তুলে ধরছে সমাজের চরমতম কলুষিত দিকটিকেও।

বর্তমান ফ্ল্যাট কালচারে অভ্যস্ত মানুষের কাছে প্রাইভেসি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ক্রমাগত এই প্রাইভেসি তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে এ যুগের পিকনিক বা বনভোজনের ক্ষেত্রেও। পিকনিক কথার অর্থ যেখানে পরিবারের সকলে একত্রিত হওয়া সকলের আনন্দ একে অন্যজনের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া সেখানে এ সময়কার পিকনিকে দেখা যায় পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা যেটি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে সামাজিক অবক্ষয়ের একটি চরমতম কারণ। উন্নত প্রযুক্তি-মিশ্রিত অত্যাধুনিক দিনসমূহের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া পুরাতন অতীতের সাদামাঠা দিনগুলিতে আয়োজিত চড়ুইভাতি বা বনভোজনের আনন্দঘন মুহূর্তগুলিতে কচিকাঁচা বয়োজ্যেষ্ঠ নির্বিশেষে সকলেই এক হয়ে যেত। যেন সেই ক্ষণিকের জীবনমুহূর্তে সকলেই হয়ে গেছে একসুতোয় গাঁথা। তবে সম্প্রতি আধুনিকতায় পুষ্ট পিকনিক বা বনভোজনগুলি একেবারে ব্যতিক্রমী চিত্র তুলে ধরে সমাজের সামনে। সেই ছবিতে ফুটে ওঠে এক পারিবারিক পিকনিকের দৃশ্য যেখানে বাবা-মায়ের তার সমবয়সিদের সাথে এক জায়গায় মেতে ওঠে আর ছোটরা মেতে আছে তাদের নিজস্ব বয়সের দলের সাথে। উভয় পক্ষই উভয় পক্ষের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা থেকে বঞ্চিত। উভয় পক্ষের কর্মপরিকল্পনা সংক্রান্ত আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে অনবগত। বিষয়টা বড়দের ক্ষেত্রে না হলেও ছোটদের মনের উপর ফেলে এক চরম নেতিবাচক প্রভাব। সন্তানদের সময় দেওয়া প্রতিটা বাবা-মায়ের কর্তব্য। এক্ষেত্রে সন্তানের নৈতিক দিক পুষ্ট হয়। সম্প্রতি দৈনিক জীবন-দৌড়ে মা-বাবা বিশেষত ওয়ার্কিং পেরেন্টসদের কাছে সন্তানদের দেওয়ার মতো সময়ের বড়ই অভাব। সপ্তাহান্তের রবিবার অথবা অন্য কোনও ছুটির দিনে যখন তারা কোনও পিকনিক (Picnic) বা বনভোজনের উদ্দেশ্যে কোথাও যায় সেই সময়ে ছোটরা আশা করে তাদের বাবা-মায়ের সান্নিধ্যলাভের‌ কিন্তু অত্যাধুনিকতা সমৃদ্ধ পিকনিক নিয়ে আসে সেখানেও পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা।

তবে সম্প্রতি স্কুল এবং কলেজের আয়োজিত পিকনিক বা এক্সকারশন অতীতের তুলনায় অনেক উন্নত হয়েছে। এখনকার যুগের এক্সকারশন ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানের পরিধি আরও বৃদ্ধি করে। এই সমস্ত এক্সকারশনে ছাত্র-ছাত্রীরা পাঠ্যপুস্তকের চেয়েও স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ এবং অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞান অর্জন করে। শুধু জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধিই নয় পাশাপাশি সমাজ সম্পর্কিত প্রচলিত চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও আধুনিক শিক্ষামূলক পিকনিক বা এক্সকার্সনের গুরুত্ব অসীম। চড়ুইভাতি বা বনভোজন বিষয়টির সামগ্রিক পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ সকল পিকনিকপ্রেমী জনসাধারণের কাছে এই সিদ্ধান্ত উপস্থাপিত করে যে সে-যুগের আর এ-যুগের পিকনিক বা চড়ুইভাতির মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক থাকলেও যেকোনও কালের ক্ষেত্রেই দৈনন্দিন ব্যস্তসমস্ত জীবনের একঘেয়েমি দূরীকরণে, ক্ষণিকের উচ্ছ্বাস-আনন্দ উপভোগে পিকনিক বা বনভোজনের অবদান অনস্বীকার্য এবং অনবদ্য।

Latest article