বেশ কয়েক বছর ধরেই ভারতীয় নাগরিকদের মনে এক অনিশ্চয়তা, বিশ্বাসহীনতা ভীষণ প্রকট হয়েছে। ‘নিজ ভূমে পরবাসী।’ আতঙ্কে দিন কাটে সাধারণ, মধ্যবিত্ত খেটে-খাওয়া গরিব মানুষদের। তারা এখনও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেন । ‘নাগরিক’ কী জিনিস, নাগরিক হতে গেলে কী প্রয়োজন আজও তাঁরা সেসব ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেননি। প্রশ্ন অনেকেরই মনে, কাগজই কি নাগরিকত্ব প্রমাণের শেষ কথা! এসব ভাবনা স্বাধীনতার এতবছর পরেও দেশের আকাশে-বাতাসে। অথচ, যেখানে সীমাহীন বেকারত্ব, লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেশের অবস্থান নড়বড়ে(!) তখনই তারা সেসব ভুলিয়ে দেশেরই মানুষের মধ্যে এমনতর শঙ্কাকে প্রকট করতে চাইছে।
যাঁদের পিতৃপুরুষ এই দেশের মাটিতে রক্ত-ঘাম দিয়ে ভারতবর্ষকে নির্মাণ করে গেছেন, তাঁদের অনেকের কাছে চাহিদামতো কাগজ না থাকলেও তাঁদের রক্তের প্রতিটি অণুতে মিশে আছে ভারতীয়ত্বের নমুনা। অথচ বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার এই নাগরিকত্বের বিষয়টি নিয়ে এমন লম্ফঝম্প করছে, তাদের প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যে আদালতও তাদের কড়া বার্তা দিচ্ছে। ২৭ সেপ্টেম্বর আপনাদের কাগজ মারফত একটি খবর থেকে জানতে পারলাম, পশ্চিমবাংলার বীরভূমের পাইকরের একটি পরিবার জীবিকার সন্ধানে দেশেরই একটি রাজ্য দিল্লিতে প্রায় ২০ বছর ধরে থাকছিলেন। কিন্তু শুধুমাত্র বাংলাভাষী হওয়ার কারণে নাকি আইনের তোয়াক্কা না করে, প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ না করে যেভাবে তাড়াহুড়ো করে পরিবারটিকে জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা ভীষণই অনৈতিক, অমানবিক এবং অসাংবিধানিকও। হাইকোর্টের বর্তমান রায়েই তা প্রমাণিত। উল্লেখ্য, কলকাতা হাইকোর্ট যেদিন (২৬ সেপ্টেম্বর) সোনালিদের চার সপ্তাহের মধ্যে ফিরিয়ে আনার রায় দিচ্ছে, সেদিনই ছিল সমাজ সংস্কারক, নারী মুক্তির অগ্রদূত, শিক্ষানুরাগী পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদিন, আবার সেদিনই কলকাতায় এসেছিলেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে, নিশ্চয়ই তিনি এই রায় শুনতে কলকাতায় আসেননি।
এত নিষ্ঠুর আচরণ এই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে আশা করতে হচ্ছে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে। ১৮ জুন দিল্লি পুলিশ মারফত প্রায় ৮ মাসের ওই অন্তঃসত্ত্বা মাকে, স্বামী শিশুপুত্র এবং তাঁর আত্মীয়দেরকে আটক করে ২৬ জুন দেশের শিকড় থেকে ছিন্ন করে বিদেশ-বিভুঁই বাংলাদেশের খোলা আকাশের নিচে ফেলা হয়, একেবারে সহায় সম্বলহীন করে দেওয়া হল– এ কতটা নির্মম, কতটা পৈশাচিক, কতটা মানবতার পক্ষে অপমানজনক একবার কি ভেবে দেখবে না ভারতীয় জনগণ! কে দিয়েছে তাদের ভারতীয় নাগরিককে সহজেই বে-নাগরিক করার অধিকার! অথচ যে নাগরিকদের ভোটে তারা ক্ষমতায় আসীন, সেই নাগরিক-ভোটারদের সাথে তারা এই নিষ্ঠুর অসংবিধানিক আচরণ করে চলেছে দিনের পর দিন!
এই বিপন্নতার প্রহরে যদি তাঁদের পাশে দেশের মানুষ, দেশের আইনজীবী, দেশের মিডিয়া, দেশের বিভিন্ন সংগঠন, স্থানীয় সরকার-প্রশাসন সবাই দাঁড়ায় তবেই কিন্তু তাঁদের ফিরে আসা সম্ভব। নচেৎ, নয়। আর সেই দেশও কিন্তু তাঁদের নেবে না। যদিও তাঁদের কাতর আবেদনে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার-প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আইনজীবীরা যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন তাতে ভারতীয় নাগরিককুল সত্যিই আশান্বিত।
আরও পড়ুন-২৮৪ বছর দুর্গারূপে পুজো হয়ে আসছে নবপত্রিকা বা কলাবউয়ের
ইদানিং বিহারের পর পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর শুরু হতে চলেছে। অনেকের মতে, এই এসআইআর আসলেই এনআরসির একটি ধাপ মাত্র। এখানেও দেখা গেছে, যেভাবে প্রামাণ্য কাগজপত্র চাওয়া হচ্ছে, তা সত্যি একটা সময়ের নিম্ন-মধ্যবিত্ত, গরিব খেটে-খাওয়া মানুষদের পক্ষে জোগাড় করা যেমন কঠিন বা তেমনই তাদের সেসব থাকাটাও প্রায় অসম্ভব। আমরা সোনালি খাতুনদের এই আইনি মামলাতেও সামান্য একটি বানান ভুলের ব্যাপার নিয়েও যেভাবে আদালতের ময়দানে বিরোধী পক্ষের আইনজীবীদের প্রশ্ন তুলতে দেখেছি তাতে অবাক হয়ে গেছি। ’ভলু শেখ’ না ’ভদু শেখ’ এই সামান্য বানানগত ভুলেও যদি তাঁরা প্রশ্ন তোলেন, তাহলে আমাদের কি সত্যিই শঙ্কিত হওয়ায় কারণ নেই বলছেন! সামনে এসআইআর হতে চলেছে। তাতে দেখা যাবে, বিভিন্ন জনের নামের বানানের ক্ষেত্রে বা পদবি থাকা না থাকা– এইসব অসংগতি প্রায় ৬০-৭০%। আর এটাকেই তাঁরা তাঁদের বাধা দেওয়ার জায়গা বলে মনে করছেন কোর্টের মঞ্চে! আশ্চর্য! এলাকাবাসী জানে যে, এ একজন বহু পুরনো ভারতীয় বাসিন্দা, অথচ তাঁদের মনমতো কাগজ না দেখাতে পারলে তাকে কিনা বলা যাবে ’বে-নাগরিক’! বিদেশি! ডি ভোটার! শিক্ষিত সচেতন পরিবার যেখানে সঠিক উপযুক্ত কাগজ দেখাতে হিমশিম, সেখানে সাধারণ মধ্যবিত্ত, অল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত ও অসচেতন মানুষদের পক্ষে তা কতটা সম্ভব! এই রক্ত-ঘাম ঝরানো আদি ভারতবাসীর নাগরিকত্বের প্রশ্নের কালো মেঘ যে ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে, তা মনে করা কোনওভাবেই অমূলক নয়। অথচ বিজেপির নেতৃত্ব ফলাও করে বলে বেড়াচ্ছেন, একজনও ভারতবাসীর কোনও চিন্তা নেই। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাদের এই আশ্বাস বাণী কার্যত ’মিথ্যা’, ব্যর্থ এবং মন ভুলানো, হাওয়া ঘোরানো বার্তা ছাড়া কিছু নয়। বাস্তবে তা আমরা দেখতেই পাচ্ছি।
অতএব সাবধান দেশের নাগরিক, এই বিপদ শুধু কোনও নির্দিষ্ট একটি জাতির বলে আজ সাময়িক মনে হলেও তা কিন্তু মোটেও নয়। এ শঙ্কা সমগ্র জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের। এ বিপদ কিন্তু আপামর বর্তমান ভারতীয় নাগরিকের। সোনালি খাতুনদের এই একটি উদাহরণই আমাদের বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ।
তাই আগামী দিনে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে, একপেশে, প্রতিহিংসাপরায়ণ, দ্বিচারী মনোভাবাপন্ন বিজেপি সরকারের অস্তিত্বকে আমরা মেনে নেব, নাকি আমরা আমাদের জন্মলব্ধ নাগরিকত্বের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে সজাগ হব। তবে আশার কথা, বীরভূমের এই বাঙালি পরিবারটির পক্ষে বিশেষ করে সাংসদ সামিরুল ইসলাম-সহ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এবং বাংলার সুধী-সচেতন মানুষ ও মিডিয়া তাঁদের উজাড় করা সমর্থন দিয়েছেন এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তাঁদেরকে আমরা কুর্নিশ জানাই। আমরা চাই, যে সরকার দেশের নাগরিকদের পক্ষে বিপজ্জনক, যে সরকার দেশের নাগরিকত্বকে চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করায়, সেই সরকারের পতন অনিবার্য হোক। আজ সোনালি, কাল স্বর্ণালি হবে না যে তার কী মানে আছে? আজ দানিশ, কাল দীনেশের পরিবারের যে হবে না তার কী মানে আছে!