জেনেশুনে বিষ করেছি পান
সকালে ঘুম থেকে উঠেই হাত বাড়িয়ে ফোন, ফেসবুক চেক, ইনস্টাগ্রাম, রিল দেখা, হোয়াটসঅ্যাপে ‘গুড মর্নিং’ পাঠানো। ঘুমোতে যাওয়ার আগেও একই কাজ। এটা হল শহর, গ্রাম, অফিস, বাড়ি—প্রায় সবার গল্প। প্রযুক্তি আমাদের উপকার করেছে ঠিকই, কিন্তু এর অতিরিক্ত ব্যবহার কেড়ে নিচ্ছে ঘুম, চোখ, মন, সম্পর্ক সবই। তাই সময় এসেছে ‘ডিজিটাল ডিটক্স’-এর। এটা কোনও বিলাসিতা নয়, বরং ২০২৫ সালের নাগরিক জীবনের প্রধান দাবি।
আপনি কি ‘ডিজিটাল ক্লান্তি’তে ভুগছেন?
ফোন না থাকলে কি অস্থির লাগে? দিনে ৪-৫ ঘণ্টার বেশি সময় স্ক্রিনে কেটে যায়? রাত ১টা-২টো পর্যন্ত রিল দেখতে দেখতে ঘুম আসে না? মুখোমুখি সম্পর্কের বদলে মেসেজেই সব কিছু সারেন? এই প্রশ্নগুলোর অন্তত তিনটির উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে আপনি ডিজিটাল ওভারলোডের শিকার।
ওভারলোডের কুফল
ডিজিটাল দুনিয়ার ক্রমাগত ‘নোটিফিকেশন’ আমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিনের ক্ষরণে অতিরিক্ত উত্তেজনা তৈরি করে, যা মনোযোগে বাধা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বেশি সময় ফোনে কাটায় তাদের মনোযোগ ধারণ ক্ষমতা ৫০% পর্যন্ত কমে যায় এবং দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়। এমনকী ছোট ছোট সময়ের জন্য ফোন ব্যবহার বন্ধ করতে না পারার অভ্যাস আমাদের ব্রেনের ‘ফোকাস এলাকা’ ক্ষতিগ্রস্ত করে।
টানা স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলে চোখ শুকিয়ে যায়, মাথাব্যথা করে, ঘাড় ও পিঠেও ব্যথা শুরু হয়— যাকে বলে ডিজিটাল ফ্যাটিগ (Digital Fatigue)।
পরিবারে এখন সবাই একসঙ্গে বসেও আলাদা স্ক্রিনেই চোখ রাখেন। তাই হারিয়ে যাচ্ছে সম্পর্ক। সন্তান, সঙ্গী, বাবা-মা— সবার জগৎ আলাদা।
আরও পড়ুন-কমিশনকে সুপ্রিম নির্দেশ, আধার-এপিক দিয়ে নাম তোলা যাবে ভোটার লিস্টে
বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির ব্যবহার আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য এক বড় ঝুঁকি। বিশেষ করে ডিজিটাল আসক্তি বা মোবাইল এবং সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেট ব্যবহারে ক্ষতি হচ্ছে সবার।
সারা দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিনের সামনে বসে থাকার ফলে আমাদের মস্তিষ্কে স্নায়ুবিক উত্তেজনা ও স্ট্রেস বাড়ছে। ২০২২ সালে মার্কিন সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (APA)-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বেশি স্ক্রিন টাইম বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের মধ্যে স্ট্রেস লেভেল ৩০% পর্যন্ত বেশি। কারণ, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো ক্রমাগত আপডেট এবং নোটিফিকেশন দিয়ে আমাদের মস্তিষ্ককে ‘অবিরাম সক্রিয়’ রাখে। এতে মনোযোগ-বিভ্রাট ঘটে, শিথিল হওয়া যায় না এবং সারাদিন মানসিক চাপ অনুভব হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দিনে ৩ ঘণ্টার বেশি সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটায় তাদের মধ্যে ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতার ঝুঁকি প্রায় ২ গুণ বেশি। বিশেষ করে ‘কম্প্যারিজন কালচার’ অর্থাৎ অন্যদের জীবনের সুখ-সমৃদ্ধি সাফল্যের ছবি দেখে নিজেকে তুলনা করা যা থেকে বাড়ছে মানসিক চাপ, হতাশা এবং একাকিত্বও।
অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম এবং বিশেষ করে রাতের বেলা মোবাইল বা ল্যাপটপ ব্যবহার ঘুমের গুণগত মান হ্রাস করে। মার্কিন ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশন (NSF) রিপোর্ট অনুযায়ী, যারা ফোন বা ট্যাবলেট ব্যবহার করে ঘুমের আগে, তাদের গভীর ঘুমের সময় ২০-২৫% কমে যায়, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। নীল আলো (Blue Light) মস্তিষ্ককে জাগিয়ে রাখে এবং মেলাটোনিন হরমোনের উৎপাদন কমিয়ে দেয়, যা ঘুম আসার প্রাকৃতিক সংকেত দেয়। ফলে রাতের বেলা ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখলে ঘুমাতে সমস্যা হয়।
কীভাবে করবেন ডিজিটাল ডিটক্স
ডিজিটাল ডিটক্সের মাধ্যমে আমরা ধাপে ধাপে এই নেতিবাচক প্রভাবগুলো থেকে মুক্তি পেতে পারি। যেমন—
আরও পড়ুন-ওবিসি মামলায় বিরাট জয়: স্থগিত হাইকোর্টের নির্দেশ, বিস্ময় প্রকাশ প্রধান বিচারপতির
আপনার দৈনিক স্ক্রিন টাইম লক্ষ্য রাখুন এবং অন্তত ১ ঘণ্টা সম্পূর্ণ স্ক্রিন-মুক্ত সময় রাখুন।
সকালে উঠে প্রথম ৩০ মিনিট ফোন নয়— নিজের সঙ্গে থাকুন।
ঘুমের আগে ১ ঘণ্টা ফোন থেকে দূরে থাকুন।
রাত ১০টার পর ফোন সাইলেন্ট-এ রাখুন।
প্রয়োজন ছাড়া সব অ্যাপের নোটিফিকেশন বন্ধ করুন।
হোম স্ক্রিনে শুধু দরকারি অ্যাপই রাখুন।
সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটার একটা নির্দিষ্ট সময় রাখুন।
রিল বা শর্ট ভিডিও দেখার সময় টাইমার ব্যবহার করুন। রোজ একটানা ২০ মিনিটের বেশি স্ক্রল করবেন না।
২০-২০-২০ নিয়ম : প্রতি ২০ মিনিট পর, ২০ সেকেন্ডের জন্য, ২০ ফুট দূরের দিকে তাকান।
সন্ধ্যার পর একটু হলেও, হাঁটতে যান বা বই পড়ুন।
দিনে অন্তত ১৫ মিনিট মেডিটেশন বা চুপ করে বসে থাকার চেষ্টা করুন।
একটি ‘ডিজিটাল ডায়েরি’ রাখুন, যেখানে আপনি নিজের পরিবর্তন লিখে রাখবেন। তবে সকালে কিছুক্ষণ কাগজে-কলমে লেখালেখি করুন।
ছোটদের জন্য
খাওয়ার সময় ফোনে হাত দেবেন না। স্ক্রিন টাইম বেঁধে দিন।
একসঙ্গে বসে ছোটদের সঙ্গে কথা বলুন, গল্প বলুন। রাতে মাঝে মাঝে একটু ফ্যামিলি গেম খেলুন।
যাঁরা কর্মরত
অফিসে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা মিটিং চলাকালীন ফোন সাইলেন্ট রাখুন।
ই-মেইল ও মেসেজ চেকের নির্দিষ্ট সময় ঠিক করুন।
কাজের ফাঁকে প্রতি ঘণ্টায় ৫ মিনিট স্ক্রিন ফ্রি বিরতি নিন।
খাওয়ার সময় বা লাঞ্চ ব্রেকে সহকর্মীদের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলুন। ফোনে থাকবেন না।
আরও কিছু কথা
পরিবারে একজন ‘ডিটক্স লিডার’ হোন যিনি সবাইকে উৎসাহ দেবেন। ফোনে সময় কাটানোর বদলে নতুন কিছু শিখতে বলুন, পরিবারকে এবং নিজেকেও সময় দিন। রোজ একটা কাজ সবাই মিলে করুন। লাঞ্চ বা ডিনার টেবিলে ফোন নয়, সবার সঙ্গে কথা বলুন। ফোনে চ্যাটিং নয়, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করুন, সামনে বসে আড্ডা দিন। এই ছোট ছোট ডিজিটাল ডিটক্স আমাদের মধ্যের হতাশা, অবসাদ কাটিয়ে মনকে আরও মজবুত করবে।