শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর চরিত্রহীন উপন্যাসে লিখেছেন, ‘‘মিথ্যার ভূমিকা দিয়ে মুখরোচক করার চেষ্টার মতো অন্যায় আর নেই।’’
সম্পূর্ণ প্রচারসর্বস্ব প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-সহ পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারা সর্বদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে দেনা করে খয়রাতি করার অভিযোগ তুলে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে চলেছেন। এবারে মিথ্যার বেসাতি করার অভিযোগে নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্রীয় সরকারের (NM Government) বিরুদ্ধে এবং তার ডবল ইঞ্জিনের সবচেয়ে প্রধান অঙ্গ গুজরাত সরকারের বিরুদ্ধে প্রকৃত সত্য জনসমক্ষে প্রকাশিত হল।
তথ্য চাপা দেওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর নিজের রাজ্য যে ‘ঋণের ফাঁদে’ পড়তে চলেছে সে-বিষয়ে সতর্কবাণী প্রকাশ করল সিএজি। ২০২৩ সালের ৩১ মার্চের তথ্যানুযায়ী গুজরাতের মাথাপিছু ঋণ পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু ঋণের সমান— ৬০ হাজার টাকা। অথচ প্রতিনিয়ত রাজ্যের বিরোধী দলনেতা-সহ বিজেপির ছোট, বড় সমস্ত নেতাই পশ্চিমবঙ্গের ঋণ নিয়ে সর্বদা গেল গেল রব তুলে চলেছে।
কী ভণ্ডামি বলুন তো! তথাকথিত আদর্শ রাজ্য হিসেবে গুজরাতের গুণগানে সর্বদা মুখরিত বঙ্গের এই বিজেপির নেতৃবর্গ। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ২০২২-২৩ সালের বাজাটের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে (পৃষ্ঠা ৯৪) ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত গুজরাত রাজ্যে অনুমিত অপরিশোধিত ধারের অঙ্ক ৪ লক্ষ ২৩ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। ইন্ডিয়া সেন্সাস-এর ২০২৩ সালের তথ্যে গুজরাত রাজ্যে অনুমিত জনসংখ্যা ৭ কোটি ৪ লক্ষ ১৫৩ জন। এই তথ্যে স্পষ্ট যে ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত গুজরাত রাজ্যে মাথাপিছু ঋণ ৬০ হাজার ১৮৬ টাকা। একই তথ্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে মাথাপিছু ঋণ ৬০ হাজার ২৮৮ টাকা। কার্যত, নরেন্দ্র মোদির নিজের রাজ্যে গুজরাতেও ঋণের বোঝা বৃদ্ধি নিয়ে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা সিএজি-র সাম্প্রতিক রিপোর্ট থেকেই স্পষ্ট। এই বাস্তব তথ্যগুলো প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাজ্যের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বিজেপির কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে বেমালুম চেপে দেওয়া হচ্ছে।
অবস্থা আরও ভয়াবহ সারা ভরতের নিরিখে। জানেন কি, ক্যামেরাজীবী প্রধানমন্ত্রীরই সৌজন্যে ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ভারতে জন্মালেই একজন শিশুর ঘাড়ে ঋণ (মাথাপিছু ঋণ) পশ্চিমবঙ্গ বা গুজরাত রাজ্যের প্রায় দ্বিগুণ দাঁড়িয়েছে— ১ লক্ষ ১৭ হাজার ৪৭৩ টাকা।
শুধু কি তাই? কেন্দ্রে মোদি তাঁর ন’বছরের জমানায় দেশে দেনার বোঝা তিনগুণ করে ফেলেছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী (NM Government) হওয়ার সময় দেশে ঋণের বোঝা ছিল ৫৫ লক্ষ কোটি টাকায়। ন’বছর অতিবাহিত হওয়ার পর ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ তা প্রায় তিনগুণ বেড়ে ১৫৫ লক্ষ ৭৭ হাজার কোটিতে দাঁড়িয়েছে। মোদি একাই মাত্র নয় বছরেই ১০০ লক্ষ কোটি কাটা দেনা করেছেন। তথ্যে স্পষ্ট স্বাধীনতার পরে ৬৭ বছরে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভারতের দেনা ৫৫ লক্ষ কোটি টাকা। কার্যত, ভারতের ৬৭ বছরের দেনার প্রায় তিনগুণ বেশি দেনা হয়েছে মোদির আমলে মাত্র ৯ বছরে। এটা কি ক্যামেরাজীবীর উন্নয়নের রসিকতা!
প্রতি সেকেন্ডে মোদি সরকার দেনা করছেন ৪ লক্ষ টাকা। প্রতিদিন দেনা ৩৪৫৬ কোটি টাকা। অন্যান্য উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে গড় ঋণের বা দেনার বোঝা জিডিপি-র ৬৪.৫%, কিন্তু ভারতে দেনা জিডিপি-র ৮৪%-এর বেশি। সৌজন্যে মোদি সরকার! অথচ পশ্চিমবঙ্গের ঋণ রাজ্যের জিএসডিপি-র প্রায় ৩৫%।
এবার ঋণের বোঝা নিয়ে ভারতের অন্য রাজ্যগুলির প্রসঙ্গে আসা যাক। বামফ্রন্টের নেতারা কেরল নিয়ে খুবই বড়াই করেন। ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত কেরল রাজ্যে মাথাপিছু ঋণ ১ লক্ষ ১২ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা। পশ্চিমবঙ্গ বা গুজরাত রাজ্যের প্রায় দ্বিগুণ।
আরও পড়ুন- এবার সুপার হিট সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী, দু’দিনে প্রায় ১২ হাজার সমাধান
শুধু কি তাই? কর্নাটক ও তামিলনাডুর মতো শিল্পোন্নয়ন রাজ্যে ২০২৩ সালে মাথাপিছু ঋণ যথাক্রমে ৭৬৮৯০ টাকা ও ৯০০৬৬ টাকা পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেক বেশি মাথাপিছু ঋণ এই দুই শিল্পোন্নত রাজ্যে। এ ছাড়াও পঞ্জাব রাজ্যে মাথাপিছু ঋণ ১ লক্ষ টাকার বেশি এমনকি কংগ্রেস শাসিত রাজস্থান রাজ্যে ২০২৩ সালে মাথাপিছু ঋণ পশ্চিমবঙ্গের থেকে বেশি। ভারতের আরও বেশ কিছু রাজ্যে মাথাপিছু ঋণ পশ্চিমবঙ্গের থেকে যথেষ্ট বেশি। এর মুখ্যত দায় মোদি সরকারেরই।
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় মোদি বড় বড় কথা বলতেন। প্রধানমন্ত্রী (NM Government) পদে বসে নিজের রাজ্য থেকে শুরু করে দেশের অর্থব্যবস্থার হাল কার্যত বিগড়ে দিয়েছেন। ঋণের ভয়াবহতা ছাড়াও মোদির সৌজন্যে গ্যাসের দাম প্রায় তিনগুণ বেড়েছে, পেট্রোল ও ডিজেলের দাম ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে, মার্কিন ডলারের সাপেক্ষে ভারতীয় টাকার মূল্য ৫০ শতাংশের বেশি কমেছে। এ ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে ভোজ্য তেল, ডিজেলের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।
বেকারত্ব! মোদির আমলে গত ৫০ বছরের সর্বোচ্চ বেকারত্ব। আর সরকারি চাকরি? রেল থেকে শুরু করে সরকারি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির চাকরি অসংখ্য ছাঁটাই হলেও চাকরি পুরণের নামে শুধু বিশেষ ড্রাইভের নিদান চলছে। দেশে সমৃদ্ধির হারও তলানিতে। ৮ শতাংশের বেশি প্রকৃত বৃদ্ধির কথা বললেও গত ৯ বছরে গড়ে বৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি নয়। আর এই বৃদ্ধি মুখ্যত দেশের মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ লোকের। কার্যত প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার যুগ চলছে মোদির আমলে!