সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বিগত একদশকেরও বেশি মোদি জমানায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ঋণ আত্মসাৎ করা শিল্পপতিদের মোট লুটের পরিমাণ ২২ লক্ষ কোটি টাকা। এই টাকা আসলে আমার-আপনার টাকা, যা আমাদের রক্ত-ঘামের বিনিময়ে অর্জিত ক্ষুদ্র পুঁজি। সেই বিপুল টাকা যখন মুষ্টিমেয় কয়েকটি ঋণখেলাপি কর্পোরেট লুট করে নিয়ে যায়, তখন, সরকার আসলে সেই টাকাটা ওই কর্পোরেটদের বকলমে অনুদান দেয়। কিন্তু এই বিপুল দুর্নীতি নিয়ে আমি-আপনি বৃহৎ গণমাধ্যমে কোনও শব্দই শুনতে পাব না। অথচ বাংলার জনবাদী (‘পপুলিস্ট’ শব্দের গ্রহণযোগ্য অনুবাদ) সরকারের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন দুর্গাপুজো উপলক্ষে সরকারি অনুদানের পরিমাণ বাড়িয়ে এক লক্ষ দশ হাজার টাকা করেন, নিন্দামন্দের ঝড় বয়ে যায়। নোম চমস্কি সেই কবেই দেখিয়েছেন, আজকের বৃহৎ পুঁজি গণসম্মতি নির্মাণ করে, যাকে তিনি বলেছেন ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’। সেই ‘গেল-গেল’ রব সমাজের বিভিন্ন অংশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতেও পারে, যা শেষ অব্দি ব্যবহৃত হবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। এই সমবেত আর্তনাদের সুকৌশলী নির্মাণ যেহেতু রাজনৈতিক অভিসন্ধির সঙ্গে যুক্ত, তাই পাল্টা রাজনৈতিক বয়ান প্রস্তুত করাও আজ সময়ের দাবি। দুর্গাপুজো-অর্থনীতি বাংলার সামগ্রিক অর্থনীতিকে চাঙ্গা করানোর এক কার্যকরী মাধ্যম। বিগ কর্পোরেটকে ট্যাক্স ছাড় দেওয়াটাই রাজ্য সরকারের একমাত্র কাজ নয়। এটা বুঝিয়ে দেবার সময় এসেছে।
রাফায়েল স্যাঞ্চেজ তাঁর ‘ড্যান্সিং জ্যাকোবিনস : আ ভেনেজুয়েলান জিনিওলজি অফ লাতিন আমেরিকান পপুলিজম’ বইতে একুশ শতকের লাতিন আমেরিকার জনবাদী রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের যাবতীয় সামাজিক উৎসবের প্রতি আকর্ষণের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি দেখাচ্ছেন ব্রাজিলের জনপ্রিয় নেতা লুলা ডি-সিলভা সাম্বা নাচ ও রিও কার্নিভ্যালে কত বিপুল টাকা সরকারি অনুদান দিচ্ছেন। এরকম অজস্র নাচগানের আসর, মূর্তি নির্মাণের পিছনে একটাই উদ্দেশ্য কাজ করছে, তা হল, সমাজের বিপুল অসংগঠিত জনগোষ্ঠী, যাদের কোনও স্থায়ী সরকারি অথবা বেসরকারি আয়ের উৎস নেই, তাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরও উন্নত ও মজবুত করার উদ্দেশ্যে অর্থনীতিতে টাকার ‘ফ্লো’ (স্রোত) বৃদ্ধি করা। লাতিন আমেরিকাতেও ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, উরুগুয়ে, মেক্সিকোর ‘জনবাদী’ সরকারগুলির সাধারণের জন্য দরাজহস্তে সরকারি ব্যয় নিয়ে সেখানকার বৃহৎ পুঁজিবাদী গণমাধ্যম নিয়মিত চিল-চিৎকার বসিয়ে দিচ্ছে বিগত প্রায় দু’দশকব্যাপী। কিন্তু এর ফল হচ্ছে ঠিক উল্টো। সরকারগুলোর সঙ্গে মেহনতি জনতার গভীর একাত্মতা এতটাই বেড়ে চলেছে যে, যাবতীয় অপপ্রচার, কুৎসা রুখে দিয়ে জনবাদী সরকারগুলি একের পর এক নির্বাচনে মানুষের সমর্থন ও আশীর্বাদ কুড়িয়ে ফিরে আসছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্গাপুজোর অনুদান বৃদ্ধির সঠিকতম সিদ্ধান্তকেও তাই একই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে, এর অর্থনৈতিক অভিঘাতের তাৎপর্য অনুধাবন করতে হবে। পুঁজিপতিদের জন্য ভর্তুকি দিলে তা ‘উন্নয়ন’ আর জনগণের হাতে সরাসরি টাকা তুলে দিলে রাজকোষ শূন্য হয়ে যাচ্ছে, রাজ্য রসাতলে যাবে— এই কুযুক্তি খণ্ডনের সময় এসেছে আজ।
আরও পড়ুন-আবার দিল্লি বিজেপির পুলিশের নির্লজ্জ আচরণ, ছিঃ! বাংলা নাকি বাংলাদেশি ভাষা
পশ্চিমবঙ্গে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৪৫ হাজার বারোয়ারি দুর্গাপুজো (durga puja) হয় এইমুহূর্তে। এ-বছর দুর্গাপুজো খাতে সরকারি অনুদান বেড়ে হয়েছে ৪৯৫ কোটি টাকা। গতবছরের হিসেব অনুযায়ী রাজ্যের পুজো-অর্থনীতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এ-বছর স্বাভাবিকভাবেই সেই টাকার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে। তিনবছর আগে রাজ্যের পর্যটন দফতর এবং ব্রিটিশ কাউন্সিল এক যৌথ সমীক্ষা চালিয়েছিল রাজ্যের পুজো-অর্থনীতি নিয়ে। এই সমীক্ষার কাজে যুক্ত ছিল লন্ডনের ম্যারি ইউনিভার্সিটি এবং খড়্গপুর আইআইটিও। সমীক্ষার রিপোর্ট, ২০২১-এ, কোভিড তখনও যায়নি পুরোটা, গোটা ভারতের অর্থনীতিতে এক অভূতপূর্ব মন্দা শুরু হয়েছে, তবুও এই পুজো-অর্থনীতি বাংলার জিডিপির ২.৫% ঘরে তুলেছে, যা দিক্-নির্দেশক। গতবছর থেকে যা ট্রেন্ড, তাতে মনে করা হচ্ছে এবছর রাজ্য-জিডিপি ৭% অব্দি বাড়তে পারে এই পুজো-অর্থনীতির সুবাদেই। ব্রিটিশ কাউন্সিলের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১-এ প্রতিমা প্রস্তুতিতে ২৬০-২৮০ কোটি, বিজ্ঞাপনবাবদ ৫০৪ কোটি, খাওয়াদাওয়ার বাজার তৈরি হয়েছিল ২৮৫৪ কোটি টাকার। ‘অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া’ (অ্যাসোচাম)-এর সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুসারে শারদোৎসবের বার্ষিক বাণিজ্যিক বাজার যৌগিক ৩৫% হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিবছর। দুর্গোৎসবের (durga puja) সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য মানুষের রুটি-রুজির ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে এই অর্থনীতির সাফল্যের উপরে। পুজোর মরশুম ভ্রমণ ও পরিবহণ শিল্পের বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ফুটপাতের ফুচকাওয়ালা, ছোট খাবারের স্টল, সেলুন, স্পা, বিউটি পার্লার, কসমেটিক স্টোর, প্যান্ডেল-বাঁধাই, ডেকরেটার্স, মৃৎশিল্প, বিনোদন, কৃষি, সাউন্ড সিস্টেম, আলোকসজ্জা, রঙ শিল্প, বিজ্ঞাপন, স্বর্ণশিল্প, পুজোর উপকরণ, ঢাকি, পুরোহিত, ম্যাগাজিন, নাটক-যাত্রা, মিষ্টান্ন, বস্ত্রশিল্প সমেত এক বিরাট অর্থনৈতিক ইকো-সিস্টেম এই আর্থিক পুনরুজ্জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। পুজোয় সরকারি অনুদান বৃদ্ধি এই সার্বিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত। গতবছর বারোয়ারি পুজোর সংগঠন ‘ফোরাম ফর দুর্গোৎসব’-এর সভাপতি কাজল সরকার পিটিআইকে জানিয়েছিলেন, পুজোকে কেন্দ্র করে ২০১৯ থেকে ২০১৪— এই পাঁচ বছরে অর্থনীতি বৃদ্ধির হার ৪৫% বেড়েছে। রাজ্যের জিএসটি কমিশনার খালিস আনওয়ার বলেছিলেন— ‘রাজ্যের পণ্য ও পরিষেবা কর বাবদ আয় লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে বিগত বছরগুলোতে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকবে।’ কায়েমি স্বার্থ এই অর্থনৈতিক বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কথা বলছে, কারণ, এই বিপুল আর্থিক বৃদ্ধি মুষ্টিমেয় কর্পোরেটের হাতে কুক্ষিগত না-হয়ে এক বিরাট বেনিফিসিয়ারি তৈরি করেছে। এই উন্নয়নের ভিত্তিই হল আর্থিক সমবণ্টন বা সোশ্যাল ডিস্ট্রিবিউশন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যয় একজন আইকনিক নেত্রী যিনি বাংলার আর্থিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে এক ধরনের বণ্টনযোগ্য সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
আর এখানেই গাত্রদাহ বিরোধী শক্তির। এই ‘গেল-গেল’ রবের পিছনে রয়েছে কায়েমি শ্রেণিস্বার্থ!