ভাস্কর ভট্টাচার্য: এখন আর চৌরঙ্গির ফুটপাতে সম্ভবত ম্যাপ অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল বা ম্যাপ অফ ইন্ডিয়ার রঙিন পাতলা বইয়ের দেখা বিশেষ মেলে না। হয়তো পাওয়া যেতেও পারে। আস্তে আস্তে সেই পথ বুঝি ফুরিয়ে আসছে। এসে গেছে আধুনিক স্যাটেলাইটের দুনিয়া। একসময় কলকাতার ফুটপাত অথবা রেলওয়ে হুইলার স্টলগুলোতে ছড়িয়ে থাকত বাংলা-ইংরেজিতে তৈরি মানচিত্রের বইগুলি। প্রয়োজনীয় বই। ম্যাপ দেখে অনেকেই তার গন্তব্য স্থল ঠিক করে নিতেন। চারিদিকেই ছড়িয়ে থাকতো বাংলা-ইংরেজিতে তৈরি মানচিত্রের বইগুলি। কোথাও যেতে গেলে অনেকেই সেইসব মানচিত্রের বই দেখে ঠিক করে নিতেন গন্তব্যস্থলে যাত্রার নিশানা। বিশেষ করে বিদেশি পর্যটকরা ইন্ডিয়া বা কলকাতায় এসে সেইসব মানচিত্রে খুঁজে বেড়াতেন দ্রষ্টব্য স্থান-এর ঠিকানা বা গন্তব্যের নিশানা জানতে।
আরও পড়ুন-মোদি, আপনি মিথ্যুক!
এক সময় অনেকের পড়ার টেবিলে গোলাকার একটি বস্তু বসানো থাকতো যার চতুর্দিকে বিভিন্ন রঙের পার্থক্য নির্দেশ করা থাকত নাম-সহ। ইউরোপ-আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের মতো দেশগুলির সীমা-পরিসীমা। এই গোলাকার বস্তুটিকে বলা হত গ্লোব বা ‘আর্থ অ্যাপল’।
সেই আর্থ অ্যাপলও আজ বিশেষ দেখা যায় না। পালটাচ্ছে বিশ্বের ভৌগোলিক চেহারা, পাল্টাচ্ছে এক দেশের সীমানার সঙ্গে আরেক দেশের সীমানা। এক দেশ ভেঙে তৈরি হচ্ছে নতুন দেশ। তার জলজ্যান্ত উদাহরণ রাশিয়া থেকে বেরিয়ে আসা ইউক্রেন । তৈরি হয়েছে নতুন সীমানা। এমন উদাহরণ অনেক। সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে সেইসব দেশের মানচিত্রের ছবিও।
আরও পড়ুন-স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই এগিয়ে চলবে বালি
আধুনিক বিশ্বের মানচিত্রের সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে স্যাটেলাইট মানচিত্র গুগল। চলমান মানচিত্র। গুগলের হাত ধরে দেশ-বিদেশের শুধু নামকরা দেশেই নয়, সে দেশের সে রাজ্যের অলিতে গলিতে পৌঁছে যাওয়া যায়। এই আধুনিক মানচিত্রের বা পথ নির্দেশিকার কাছে টলেমি, হেরোডোটাসদের তৈরি মানচিত্রের ছবি যেন অনেক ম্লান মনে হতে পারে।
অথচ আজ যতটা সহজ মনে হয়, আগেকার দিনের মানচিত্র তৈরি করা তত সহজ ছিল না। শুধু কঠিন নয়, ছিল দুরূহ। একেকটা সম্পূর্ণ মানচিত্র তৈরি করতে মানচিত্রকরদের পায়েহেঁটে। জলপথে নৌকায় এক স্থান থেকে আরের প্রান্তে দুর্গম পথ পেরিয়ে যেতে হত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। একেকটা দেশের মানচিত্র তৈরি করতে লেগে যেত দশ পনেরো বছরেরও বেশি। ভূপর্যটকের মতো ঘুরে বেড়াতে হত মানচিত্র তৈরির কারণে। সে সব রোমাঞ্চকর কাহিনি লিখিত আছে মানচিত্র
আরও পড়ুন-আরও ২০ হাজার স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড বছর শেষে
তৈরির ইতিহাসে। লেখা আছে জেরাডস সার্লেটর,আব্রাহাম আর্থেলিউস, নিকোলাস ডে, ক্লডিয়াস টলেমি, হেরোডোটাস-সহ অসংখ্য নাম।
সময়ে সময়ে বিভিন্ন উৎসাহী বিভিন্নরকম মানচিত্র তৈরি করে ইতিহাসখ্যাত হয়ে আছেন। তেমনই একজন টলেমি। গ্রিক গণিতবিদ, জিওগ্রাফার, অ্যাস্ট্রলজার, সংগীত বিশেষজ্ঞ টলেমির তৈরি মানচিত্র এক নতুন দিশা দেখিয়েছিল। তিনি জিওসেন্ট্রিক মডেলের জন্য খ্যাত। তার আগে মানচিত্র তৈরি করেছিলেন রোমান রাজার সান্নিধ্যে আল মুহমুম্মদ ইদ্রিসি। তাঁর পুরো নাম অনেক বড়। তিনি মুহম্মদ ইদ্রিসি নামেই পরিচিত ছিলেন। সিসিলির রাজা নরম্যান এর বদান্যতায় তৈরি করেছিলেন রুপোর মহামূল্যবান মানচিত্র। সুদীর্ঘ মহামূল্যবান মানচিত্রের পরিমাপ ছিল ১১x৫ ফুট। ওজন ছিল ১৮০ কিলোগ্রাম।
আরও পড়ুন-জুটমিল খুলতে উদ্যোগী তৃণমূল কংগ্রেস
এই মানচিত্র তৈরি করতে সময় লেগেছিল দশ বছরেরও বেশি। ১১৫৪ সালে প্রথম সবর্বসমক্ষে সেই মানচিত্র আনা হয়। যদিও পরবর্তীতে এই মানচিত্রের অনেক ত্রুটি বের করেছিলেন অন্যান্য মানচিত্রকররা। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে মহামূল্যবান মানচিত্রটি উধাও হয়ে যায়। আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
নানা কারণে পৃথিবীর চেহারা পাল্টাবার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন মানচিত্র তৈরিতে কালে কালে অনেক মানচিত্র তৈরি হয়েছে, সরকারি ও বেসরকারি ভাবে। সেই পথ ধরেই ইতালীয় মানচিত্রকর গাস্তালদি, পর্তুগিজ জাও দে বরোস, ওলন্দাজ ফান লিনেন-এর মতো ম্যাপ মেকাররা এক এক সময়ে সাড়া জাগানো ম্যাপ তৈরি করে ছিলেন। তেমনই এই বাংলার প্রথম মানচিত্র তৈরি করেছিলেন জেমস রেনেল নামে এক ব্রিটিশ তরুণ। মাত্র ২১ বছর বয়সে ভারতের সন্ধানে এসেছিলেন এই দেশে। তখন দেশের সর্বেসর্বা ছিলেন ভ্যান্সিটার্ট। তাঁর আনুকূল্যেই জেমস রেনেল বাংলার প্রথম সার্ভেয়ার নিযুক্ত হয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-রাহানে-পূজারার পাশে ব্যাটিং কোচ
১৭৬৪ সালের এপ্রিলে তাঁরই হাতে তৈরি হয়েছিল ভারতের প্রথম মানচিত্র। অবিভক্ত বাংলার মানচিত্র তৈরি করতে সময় লেগেছিল ১৭৬৪-১৭৭৭, প্রায় ১৩ বছর। যার নাম ‘আ বেঙ্গল অ্যাটলাস’। মোট ১৩টি মানচিত্রে বাংলা বিহারের নানা প্রান্তের খবরাখবর ছিল। যদিও সেই ম্যাপও নাকি সঠিক ছিল না। সে অন্য বিষয়। এই যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির প্রচেষ্টা ও উৎসাহে ইউরোপ, আমেরিকা, ভরত-সহ বিভিন্ন দেশের মানচিত্র তৈরি হয়েছিল, তাই-ই বা কম কী?
মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন মানচিত্র নির্মাণ। এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সীমারেখা বা কাঁটা তারের বাইরের সামগ্রিক ছবিই তুলে ধরে মানচিত্র। দেশ কাল মানুষ তার ভাষা সংস্কৃতির নানান ঐশ্বর্যের সীমারেখার কাজই করে মানচিত্র। বিশ্বভুবনের ছবি চিনতে জানতে তাই মানচিত্রের প্রয়োজন অনেক জরুরি।