হারানো দিনের স্মরণীয় নায়িকা

অলক্ষ্মী হয়েই নাম কিনেছিলেন 'বনপলাশীর পদাবলীর' লক্ষ্মী। সেখানেই ছিল তাঁর শিল্পী জীবনের সার্থকতা। ছবি এবং পেশাদারি মঞ্চাভিনয়ে ছিলেন সমান দক্ষ। শুধু নায়িকা নন, ছিলেন সুগায়িকাও। সেই অভিনেত্রী বাসবী নন্দীর উপর আলোকপাত করেছেন ড. শঙ্কর ঘোষ

Must read

বনপলাশীর বাসবী

কথামুখ
প্রাইভেট বাস চালাবার বহুদিনের স্বপ্ন সনাতনের। কিন্তু সুযোগ কোথায় ? অর্থই বা কে দেবে ? ঘর বাঁধার স্বপ্ন রয়েছে পদ্মের সঙ্গে। বাস ড্রাইভার হয়ে গেলেই পদ্মের সঙ্গে তার বিয়ে হবে এমনটাই ঠিক করেছিল তারা। নিম্নবিত্ত পরিবার সহায়-সম্বলহীন। তবু দু’চোখে অনেক স্বপ্ন। রাতারাতি বাসের ড্রাইভার শুধু নয়, বাসের মালিক হওয়ার সুযোগ এসে গেল। দাদা দাদা বলে যাকে মান্য করত সনাতন, সেই পাড়াতুতো দাদা সব ব্যবস্থা করে দিল। শুধু একটি শর্ত। দাদার মেয়ে লক্ষ্মীকে বিয়ে করতে হবে। সনাতন ভেবে দেখল একটা পেতে আরেকটা ছাড়তেই হবে। সেই মতো বাসের মালিক ও ড্রাইভার হবার সুযোগ গ্রহণ করে পদ্মকে ছাড়ল সনাতন। বিয়ে করল লক্ষ্মীকে। লক্ষ্মী তো নয় সে যেন ভীষণ অলক্ষ্মী। কোনও কাজের নয়। শুধু খাওয়া আর ঘুম। সেইসঙ্গে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ, সন্দেহ সর্বক্ষণ। সনাতনের কাছে ঘর তখন অসহ্য।

আরও পড়ুন-শ্যামলের দুর্নীতির তদন্তে ১২ সদস্যের সিট গঠন

পদ্মের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য সে উদগ্রীব। মাছ ধরতে গিয়ে সনাতনের বড়শি আটকে গেল পদ্মের ব্লাউজে। সনাতন গাইছে গান ‘দেখুক পাড়া পড়শিতে কেমন মাছ গেঁথেছি বড়শিতে।’ ঘটনাটি লক্ষ্মীর নজর এড়াল না। স্বামীকে সেই রাতে বেদম প্রহার করল লক্ষ্মী। মুখে যা নয় তাই বলে গালিগালাজ করল লক্ষ্মী। সেই রাতে লক্ষ্মী বাধ্য হল আত্মহত্যা করতে। পদ্মের ধারণা হল লক্ষ্মীর এই অপঘাতে মৃত্যুর জন্য দায়ী সে। এক বিষাদঘন পরিস্থিতি। বহুপঠিত একটি উপন্যাসের খানিকটা অংশ গড়ে উঠেছে লক্ষ্মী ও পদ্মের সম্পর্ককে ঘিরে। উপন্যাসটির নাম ‘বনপলাশীর পদাবলী’। লেখক রমাপদ চৌধুরী। এর চলচ্চিত্ররূপ দিলেন উত্তম কুমার। নায়কের চরিত্রে তিনি। প্রেমিকা পদ্ম হলেন সুপ্রিয়া দেবী। স্ত্রী লক্ষ্মী হলেন বাসবী নন্দী। সবার নজর কাড়লেন বাসবী। সবার চোখে ঘৃণা ঝরছে এই চরিত্রের জন্য। শিল্পী সেখানেই সার্থক। ‘বনপলাশীর পদাবলী’ বাসবীর অভিনয় জীবনের স্মরণীয় কীর্তি। বেঙ্গল ফিল্মস জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের তরফ থেকে এই অভিনয়ের জন্য তিনি পুরস্কৃত হলেন।

আরও পড়ুন-সীমান্তে ইউএপিএ চালু করার প্রস্তাব কেন্দ্রীয় সরকারের

জন্মকথা
সেই বাসবী নন্দীর জন্ম ১৯৩৯ সালের ৫ ডিসেম্বর কলকাতায়। বাবা ডাক্তার ছিলেন। নাম বি এল নন্দী। আশুতোষ কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় পাশ করেন। বিএ পরীক্ষা আর দিয়ে উঠতে পারেননি। তখন সংগীত আর অভিনয়ের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ। সতীনাথ মুখোপাধ্যায় এবং উৎপলা সেন এই শিল্পী দম্পতির কাছে সংগীত শিক্ষা করেছিলেন। উচ্চাঙ্গ সংগীত শিক্ষা করেন সত্যদেব চৌধুরীর কাছে। নৃত্য শিক্ষা করেছেন। নাচ শিখেছেন গোবিন্দন কুট্টির কাছে। এই সব গুণ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বাংলা ছবির জগতে।

আরও পড়ুন-দুই বিজেপি নেতার কুকীর্তি সামনে, আরও বিপাকে সৌমেন্দু, ভাতা ৬ হাজার, তাতে কীভাবে বিদেশ সফর

ছবির জগতে প্রবেশ
বিপ্লবী অনন্ত সিংহ পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। তখন তিনি একটি ছবি নির্মাণের পথে ছিলেন। ছবির নাম ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’। পরিচালক প্রফুল্ল চক্রবর্তী। নতুন নায়িকার সন্ধানে তিনি ছিলেন। বাসবী নির্বাচিত হলেন নায়িকা হিসেবে। ছবিতে বাসবী নন্দী। তাঁর বিপরীতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। দু’জনে চুটিয়ে অভিনয় করলেন। দমফাটা হাসির ছবি। মুক্তি পায় ১৯৫৮ সালে। প্রথম ছবিই সুপারহিট। হাস্যরসের ছবির প্রতি দর্শকদের বাড়তি আকর্ষণ থাকে। ছবিটি এই সুবিধাটি পেয়েছিল। ১৯৫৮ সালে দ্বিতীয় ছবিটি মুক্তি পেল। ছবির নাম ‘পুরীর মন্দির’। বিপরীতে অসীম কুমার। ১৯৫৯ সালে ভানু-বাসবী জুটির ছবি মুক্তি পেল ‘মৃতের মর্তে আগমন’। যত ফুট ছবি তত ফুট হাস্যরস। জমিয়ে তুললেন বাসবী নন্দী-ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৫৯ সালে একটি ছবি মুক্তি পেল ‘ভ্রান্তি’। বিপরীতে আশিসকুমার। উত্তমকুমারের বিপরীতে নায়িকা হলেন, সেটিও হাসির ছবি, ‘সখের চোর’। পরিচালক প্রফুল্ল চক্রবর্তী। দেখা গেল সেখানেও বাসবী স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল। পরপর সব হাসির ছবি। আবার আরেকটি হাসির ছবির নায়িকা হলেন। নাম দুই বেচারা। ১৯৬১ সালে এই হাসির ধারার শেষ ছবিতে অভিনয়। ছবির নাম’ কাঞ্চন মূল্য’। একপেশে হয়ে যাচ্ছিল তাঁর অভিনয় জীবন। সিরিয়াস ছবিতে অথবা অন্য ধরনের চরিত্রে ডাক পাচ্ছিলেন না।

আরও পড়ুন-রাজ্যের বিরোধী দলনেতাকে ফের নোটিশ পাঠাল তমলুক পুলিশ

পালাবদল
বিজয় বসু তখন পরিচালনা করছেন ‘রাজা রামমোহন’ ছবিটি। সেখানে বাসবী নন্দী সুযোগ পেলেন রামমোহনের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করার। রামমোহনের চরিত্রে বসন্ত চৌধুরী। সুযোগকে কাজে লাগালেন। অজয় কর পরিচালিত ‘কায়াহীনের কাহিনি’ ছবিতে তিনি উত্তম কুমারের ঘরণি। উত্তম কুমারের বিপরীতে নায়িকা হলেন ‘রোদন ভরা বসন্ত’ ছবিতে। পরিচালক সুশীল মুখোপাধ্যায়। এছাড়া তিনি ‘সজারুর কাঁটা’ ছবিতে নায়িকা হলেন। পরিচালিকা মঞ্জু দে। তাঁর বিপরীতে সতীন্দ্র ভট্টাচার্য। স্মরণীয় অভিনয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে সুশীল মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘আমি সিরাজের বেগম’ ছবিতে। সেখানে বিশ্বজিৎ (সিরাজ), সন্ধ্যা রায় (লুৎফা), বিকাশ রায় (মিরজাফর) হয়েছেন ঠিকই কিন্তু সবার নজর কাড়লেন বাসবী ঘসেটি বেগমের চরিত্রে। দাপটের সঙ্গে অভিনয় করলেন সেখানে।

আরও পড়ুন-প্রভাতকুমার কলেজে দুর্নীতি তদন্তে বিশেষ প্রতিনিধি দল

চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ
নায়িকা থাকতে থাকতেই তিনি চরিত্রাভিনয়ের দিকে চলে এলেন। কনক মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘মহালগ্ন’ এবং ‘দীপ নেভে নাই’ ছবি দুটিতে চরিত্রাভিনয়ে এলেন বাসবী নন্দী। তিনি সুচিত্রা সেনের মাসতুতো দিদির ভূমিকায় অভিনয় করলেন ‘নবরাগ’ ছবিতে। ‘বাঘিনী’ ছবিতে তিনি সন্ধ্যা রায়ের সম্পর্কিত দিদির ভূমিকাতে। উত্তম কুমারের সঙ্গে তিনি আরও দুটি ছবিতে অভিনয় করলেন ‘আমি সে ও সখা’ এবং ‘সেই চোখ’। একটি মাত্র হিন্দি ছবিতে তিনি নায়িকা হয়েছিলেন। ছবির নাম ‘প্যার কা দস্তান’। তাঁর বিপরীতে ছিলেন প্রদীপ কুমার। এছাড়াও তিনি অভিনয় করেছেন ‘রাতের কুহেলি’, ‘শত্রুপক্ষ’, ‘গজমুক্তা’ প্রভৃতি ছবিতে।

আরও পড়ুন-ক্যান্সার রোগীদের সুস্থ করার অঙ্গীকার

পেশাদারি মঞ্চে অবতরণ
মঞ্চে প্রথম নায়িকা হয়ে এলেন স্টার থিয়েটারে ‘তাপসী’ নাটকে। পেশাদারি রঙ্গমঞ্চে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম অবতরণ সেখানে। তিনি সৌমিত্রের বিপরীতে অভিনয় করেছেন। বাসবী একের পর এক নাটকে নায়িকার দুরূহ চরিত্রগুলিতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সেই তালিকায় আছে ওই স্টার থিয়েটারে শেষাগ্নি এবং একক দশক শতক নাটক দুটিতে। পরবর্তীকালে রঞ্জিতমল কাংকারিয়া যখন স্টার থিয়েটারের দায়িত্ব নিলেন তখন ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (দ্বিতীয় পর্যায়ে) নাটকে তিনি রোহিণী। গান এবং অভিনয়ে জমিয়েছিলেন। মাঝে এলেন রংমহল থিয়েটারে। পরিচালক জহর রায়। ‘সেমসাইড’, ‘আমি মন্ত্রী হব’ এবং ‘নন্দা’ এই তিনটি নাটকে দুরন্ত অভিনয় করলেন। বাসবীর আরেক গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চাভিনয় ‘প্রজাপতি’ নাটকে মিনার্ভা থিয়েটারে। শক্ত রোলের পাশাপাশি মঞ্চেও কমেডি চরিত্রে তিনি কতটা সফল হয়েছিলেন তার প্রমাণ আছে বিজন থিয়েটারে রবি ঘোষের পরিচালনায় ‘শ্রীমতী ভয়ঙ্করী’ নাটকটিতে। নাম ভূমিকায় তিনি জমিয়ে দিয়েছিলেন। সারকারিনা মঞ্চে ‘কনে বিভ্রাট’ নাটকেও তিনি প্রচণ্ড হাসিয়েছেন। বিজন থিয়েটারের ‘জজ সাহেব’ নাটক, কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে ‘হচ্ছেটা কী’ নাটক, রঙ্গনা থিয়েটারে ‘অঘটন’ নাটকে সাড়াজাগানো অভিনয় করেছেন বাসবী। এছাড়া সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে তাঁর মঞ্চাভিনয় রয়েছে তপন থিয়েটারে ‘দর্পণে শরৎশশী’ নাটকে। মঞ্চে তাঁর বিপরীতে নায়ক হয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, দিলীপ রায়, নবকুমার, অসীম কুমার, সতীন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখ শিল্পীরা।

আরও পড়ুন-বিজেপি নেতার স্ত্রী খুনে দলের নেতাই বিপাকে

অন্যান্য গুণপনা
বাসবী নন্দী গায়িকাও বটে। আধুনিক গানের রেকর্ড আছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড তিনি করেছেন। তাছাড়া তিনি যেসব ছবিতে কাজ করেছেন বা নাটকে অভিনয় করেছেন সেখানে সুযোগ থাকলে তিনি গান গেয়েছেন। রেডিও নাটকে বহুবার অভিনয় করেছেন। বিচিত্রানুষ্ঠানে তিনি গান গেয়েছেন বহু জায়গাতে।
শেষের কথা
স্বামী ও কন্যাসন্তান নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। কোনও অজ্ঞাত কারণে নিজেকে তিনি গুটিয়ে ফেলেছিলেন। অভিনয় করেননি চলচ্চিত্র বা নাটকে। দূরদর্শন থেকে ডাক পেলেও সাড়া দেননি। হয়তো অভিমানে। নতুবা নতুন কিছু দেওয়ার নেই এমন উপলব্ধি থেকে। তাঁকে আমরা হারিয়েছি ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই। তবে তিনি ছবির জগতে যা দিয়ে গেছেন, তাতেই তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন চিরকাল।

Latest article