এক পলকে একটু দেখা
অন্তঃপুরের মেয়ে গোলাপদাসী সুন্দরী। মাথা তুলে পুরুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলার ধক ছিল না তখন তার। সমাজের কারাগারে বন্দি ছিল অন্তঃপুরে। শীত-সকালের রোদের মতো একচিলতে ভালবাসা উথাল-পাথাল করে দিত গোলাপ সুন্দরীদের জীবন। সে-যুগে প্রেমও ছিল অন্তঃপুরবাসী।
তারপরে অন্তঃপুর থেকে প্রেম পৌঁছাল চিলেকোঠার ছাদে ও ছাদ বারান্দায়। এক বাড়ির ছাদ থেকে অন্য বাড়ির ছাদে তখন চলত চোখের লুকোচুরি খেলা। স্নানের পরে অলস বিকেলে ছাদে রোদ পোহানো, চুলবাঁধা, আচার শুকানো, আর অন্য বাড়ির ছাদ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা— এগুলো একদিকে ছিল ‘রিলের’ জীবন অন্যদিকে ছিল ‘রিয়াল’ জীবন।
এবার প্রেম এল এ-বাড়ির বারান্দা থেকে ও-বাড়ির বারান্দায়। উত্তরের জানালা থেকে দক্ষিণের জানালায়। কখনও-বা পুবের জানালা থেকে পশ্চিমের জানালায়। তখনও অবশ্য মেয়েদের প্রেমপত্র পাঠানোর যুগ আসেনি। তাই এক পলকে একটু দেখেলেই ভালবাসার মেঘ জমত মনের ঈশান কোণে। কখনও-বা নির্জনে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ত টুপটাপ করে। এরপর সদর্পে এল চিঠিলেখার যুগ। সব প্রেম জমা হল কলমের নিবের আগায়। ভালবাসা ঝরতে থাকল কালো অক্ষর হয়ে। তার সুবাসে বিনোদিনীদের হৃদয়ে তখন ম-ম গন্ধ। কিন্তু এই প্রেমপত্র পৌঁছানোর জন্য ছিল নিজস্ব সব পোস্ট মাস্টার, দায়িত্ব নিয়ে অন্য হৃদয়ের ডাকবাক্সে ফেলে আসত ওইসব চিঠি। তাদের বেতন হত দু’দিক থেকে। তবু বেশিদিন দাপট দেখাতে পারেনি এইসব চিঠিবন্দি ভালবাসা। রূপান্তরিত হয়ে এই ভালবাসা এসেছে প্রযুক্তির দোরগোড়ায়। এখন অনলাইন ভালবাসার যুগ।
তোমারেই যেন ভালবাসিয়াছি
‘ভালোবাসা শত যুদ্ধেও জেতা যায় না, ভালোবাসা লুপ্ত রাজ কীর্তিনাশা একা মেয়েটার নরম গালের পাশে প্রহরীর মত রাত জাগে ভালোবাসা’— ভালবাসা নিজের মতো করে নিজের অনুভূতি দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে দেশে দেশে। কখনও দেশের প্রতি কখনও দ্রোহের প্রতি, কখনও প্রেমের প্রতি, কখনও সম্পর্কের প্রতি, ভালবাসা হয়ে উঠেছে সিঁড়িভাঙা অঙ্কের মতো। সে অঙ্ক মেলাতে পারেনি কোনওকালে কেউ। ভালবাসার ধরন পালটেছে। আজও অন্তঃপুরের গোলাপদাসীর থেকে সেক্টর ফাইভের প্রটাগোনিস্ট বলুক কিন্তু ভালবাসাতেই বেঁচে আছে। স্বার্থপরতা কখনও কখনও স্পর্শ করতে চেষ্টা করেছে এদের কিন্তু কখনওই তার স্পর্ধার সীমারেখা ছাড়ায়নি। বরং মায়ার বন্ধনে ডুবে গেছে।
মেয়েদের ভালবাসার প্রকাশভঙ্গিটা যুগ যুগ ধরে পাল্টেছে। চেনা ফ্রেমে ভালবাসা ওমর হয়েছে এই উপমহাদেশে রজকিনী-চণ্ডীদাস, চন্দ্রাবতী-জয়ানন্দের কাহিনি, রাধা ও কৃষ্ণের প্রেম-বিরহের কাহিনি— সবই চেনা ছকে বাঁধা। প্রেমে যেমন আকুতি আছে তেমন আছে হিংসা। রবীন্দ্রনাথের কথায়— তবু প্রেম কভু নাহি মানে পরাভব। আর তাই তো মানুষের মনে অন্তত ফাল্গুনী বয়ে যায়। তাই তারা বিশ্বাস করে— চির পুরাতন বিরহ মিলন কথা— তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি— শত রূপে শত বার— জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
অন্তঃপুরের যুগ থেকে এই যুগের মেয়েরা বদলে দিয়েছে ভালবাসার গ্রামার। তাই যখন কোচিং সেন্টারে হালকা করে ভালবাসার জন্ম হয় তখন বড়রা শাসানি দিতে শুরু করে ‘পকেটে পয়সা না থাকলে ভালবাসা জানলা দিয়ে পালাবে’। পকেট মোটা দেখে এ-যুগের মেয়েরা ভালবাসতে শুরু করে, সঙ্গে থাকে চকোলেট আর গিফট। তবে সব ভালবাসা যে এমন সেটাও নয়। মেয়েদের ভালবাসা সাদা-কালো যুগ পার করে নিয়ে এসেছে ইস্টমেন কালার। আর এখন তো ফুল ডিজিটাল প্রেম। পুরনো দিনের মেয়েদের প্রেম ছিল আলো-আঁধারির দীর্ঘশ্বাস। রোমিও জুলিয়েটের মতো প্রথম প্রেমের নজির খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রথম প্রেম শব্দটা শুনলেই এমন একটা মুখের ছবি ভেসে ওঠে যেটাতে একটা মিষ্টি গন্ধ এবং হাতে লেখা চিঠির সারপ্রাইজ থাকে। একজোড়া আশ্চর্য হাত আর দু’মুঠোর ভিতরে পৃথিবীর সেরা নিরাপত্তা লুকিয়ে থাকে। আর থাকে একটা অলীক কন্ঠস্বর। উত্তম-সুচিত্রার হিট জুটির সিনেমা মানেই ছদ্মবেশে গোলাপি আবির মার্কা প্রেম যা হাতের মুঠোয় ঝিনুকের মতো পরে থাকে। এখন বাড়ির অন্দরমহলে প্রেমের কী মহিমা!
তোমাকে আমার বড্ড ভাললাগে
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রেমের ধরন, কাহিনি— সব কিছুতেই এসেছে পরিবর্তন। সেকালে নারীর প্রেম ছিল ‘গোপন’ বিষয়। কেউ জেনে ফেললেই ‘খবর’ হয়ে যেত! একালে তাদের প্রেম মানেই প্রকাশ্য। প্রেমের কথা বন্ধুবান্ধবদের না জানালেই বরং ‘খবর’ হয়ে যায়। তখন কারও প্রেমে পড়লে সেটি বলার সুযোগ হত না। দেখা যেত, বলার আগেই প্রেমিক বা প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেছে! এখন তারা কারও প্রেমে পড়লে সেটি দুমদাম বলে দেওয়া হয়। ওই সময় দু’জনের মধ্যে প্রেম হতে অনেক সময় লাগত। মেয়েরা তাদের ভালবাসার কথা জানত না। পছন্দের মানুষকে ‘তোমাকে আমার ভাল লাগে’ বলার পর পরবর্তী সাক্ষাতে জবাব শোনার জন্য হয়তো কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাসও অপেক্ষা করতে হত! এ-সময় প্রেম হচ্ছে টি-২০-র মতো বিষয়! ভাল লাগল, বললাম, হয়ে গেল! এখন তারা সাহসিনী।
আরও পড়ুন- দ্য স্টোরিটেলার
মিস ইউ প্রেম
ওই সময় মেয়েদের প্রেম ছিল বড্ড গভীর। কোনও কারণে বিচ্ছেদ হলে প্রেমিক-প্রেমিকারা কেঁদে বুক ভাসাতেন। এ-সময়ে প্রেম হচ্ছে উড়াধুড়া! ছ্যাঁকা খেলেই নতুন কারও সন্ধানে নেমে পড়ো, কাঁদার সময় নাই। সেকালে প্রেমের প্রস্তাব দিতে গোপনে তাদের চিঠি লিখে ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করতে হত।
একালে ফেসবুকে ইনবক্সে ‘লাভ ইউ’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই রিপ্লাই! তাতে হয় ব্লক-খাওয়া, না হয় প্রত্যুত্তরে ‘মি টু’! সে সময় প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে ‘ওয়ো’ বলে কিছুই ছিল না।
এ-সময় বেশির ভাগ প্রেমিক-প্রেমিকা ‘ওয়ো’ বিষয়টা সম্পর্কে ভালই জানে! সেকালে প্রেমিকদের মনে ‘টাকা কোথায় পাব’ এ ভয় ছিল না! কারণ সে-সময় প্রেমিকাকে নিয়ে ডেটিংয়ে যাওয়া, রেস্টুরেন্টে খাওয়ানো, দামি গিফট দেওয়া— এসব কিছুই ছিল না। একালে প্রেমিকমাত্রই ‘টাকা কোথায় পাব’ চিন্তায় তটস্থ! কারণ প্রেমিকাকে নিয়ে ডেটিংয়ে যাওয়া, খাওয়ানো, গিফট দেওয়া— এযুগে বাধ্যতামূলক!
সেকালে নারীর ভীরু প্রেম হত চোখে চোখে। একালে প্রেম হয় ফেসবুকের ইনবক্সে সেকালের প্রেমিক-প্রেমিকাদের কোনও কিছু ফাঁস হওয়ার ভয় ছিল না। একালের প্রেমিক-প্রেমিকারা স্ক্রিনশট ফাঁস হওয়ার ভয়ে থাকতেন সেসময় মা-বাবা ভয়ে থাকতেন, সন্তান যদি প্রেম করে বসে!
গোপন অভিসার
সেই আমলের নারীর প্রেম ছিল অসাধারণ। চার চোখের মিলন নিয়ে কবিরা হয়ে উঠেছেন নস্টালজিক। পূর্বরাগ থেকে পরকীয়া— সবই ছিল নারীর গোপন অভিসারে। পরস্পরকে নিয়ে ছিল কত স্বপ্ন আর কত ভাবনা। তখন ডেটিং মানে ছিল কোনও নিভৃত স্থানে দেখা করে নিভৃতে দু’দণ্ড মনের কথা বলা। স্বপ্ন বোনা স্বপ্নচারিণীর সঙ্গে। কোনও নারী যদি ভালবেসে কারও হাত ধরতে পারত, তাহলে সেটা ছিল পরম পাওয়া। আর তাতেই ছিল আবেগ আর লজ্জা। সেই স্মৃতি তারা সারা জীবন ভুলতে পারত না। প্রথম হাত স্পর্শ করার দিনটি সারা জীবন মনে রাখা হত। পরবর্তী দাম্পত্য জীবনে তারা স্মরণ করত প্রথম হাত ধরা স্পর্শের মধময় স্মৃতি।
এখন দিন বদলেছে। ডিজিটাল যুগ এখন। তাই প্রেমেও ডিজিটালের ছাপ সুস্পষ্ট। আর তাই এখন নারীর প্রেম শুরু হয় মোবাইলের মিস কল দিয়ে। কিংবা ফেসবুকের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিয়ে। আর শেষ হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় দুঃখের পোস্ট দিয়ে।
আগের দিনের প্রেমে ছেলে মেয়ে উভয়ই সুন্দর সোনালি স্বপ্ন দেখত। নীড় বাঁধার কাব্যিক স্বপ্ন মাখা ছিল তাতে। আর এখন প্রেমের মূল টার্গেটই যেন ফিজিক্যাল। প্লেটোনিক ভালবাসার ছুটি।
এক নারী এক প্রেম
এমন একটা সময় ছিল যখন এক দেশ এক ভোটের মতো প্রেম ছিল— এক নারী এক প্রেম। একজন নারী একজন পুরুষকে নিয়ে বিভোর থাকত। এখন শিডিউল করে অনেক মেয়েই একাধিক প্রেম সামাল দেয়। এক্ষেত্রে তারা এক পা-ও পিছিয়ে নেই। ভালবাসায় এসেছে নিঃশব্দ বিপ্লব।
আগের দিনে প্রেমিকাকে না পেলে প্রেমিক দিওয়ানা হয়ে যেতেন। খোঁচা-খোঁচা দাড়ি রেখে দেবদাস হয়ে উঠতেন। দুর্মুখেরা বলত ছেলেটি ছ্যাঁকা খেয়েছে।
এখন প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে বিশ্বাস আর আস্থার দারুণ আকাল! আজও আছে সেই প্রেম। আজকের বিনোদিনীরাও প্রেমে আত্মসমর্পণ করে। কানুর প্রেমে মজে আছে। সেক্টর ফাইভের বৃন্দাবনবিলাসিনীরা। গোধূলি আলোয় আজও অপেক্ষায় থাকে নীরারা একটা হোয়াটসঅ্যাপের আশায়। তাই তো রূপ বদলালেও প্রেম থাকবে— যেমন আছে আজও।