আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে শহরের বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২৮ সালের এক গ্রীষ্মের দিনে সেখানে এলেন এক তরুণ। এখানকার অধ্যাপক-মহলে অন্তর্ভুক্তি ঘটল তাঁর। এখানে আসবার আগে থেকেই রসায়ন বিভাগের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা করবার সুযোগ পাওয়ার আশা ছিল তাঁর মনে, সেরকম আশ্বাসও নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন। এমনিতে সে-আমলে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বা জীববিদ্যা— এইসব বিষয়গুলোর অধ্যাপকদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকলেও যৌথভাবে কাজ করবার কোনও প্রথা ছিল না। তা এখানে আসবার পর তিনি একদিন নরওয়ের এক ইঞ্জিনিয়ারের লেখা একটি বৈজ্ঞানিক পেপার পড়ে ঠিক করলেন, একটা নতুন জিনিস বানাবেন। যা দিয়ে ধাক্কা দেওয়া যাবে পরমাণুর মধ্যে থাকা আরও ছোট্ট কণাদেরকে।
আরও পড়ুন-বাংলাদেশ-আতঙ্ক যোগীর
পরমাণু তৈরি হয় তিন ধরনের কণা দিয়ে, বাইরের দিকে ঘোরে ইলেকট্রনেরা, আর ভেতরের ছোট্ট একটুখানি জায়গায় ঠাসাঠাসি করে থাকে প্রোটন আর নিউট্রন। ওই জায়গার নাম নিউক্লিয়াস। এখন ওই পরমাণুর ভেতরকার হালহদিশ নিয়ে তখন পৃথিবীর নানা জায়গাতেই কাজ করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। এর আগে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড বা আর অনেকে মিলে দেখেছেন যে পরমাণুর ভেতরের বেশিরভাগ জায়গাই ফাঁকা, আর তাই যদি হয়, তাহলে বাইরে থেকে ধাক্কা দিয়ে পরমাণুকে অন্তত ভাঙার চেষ্টা তো করাই যায়।
সুতরাং লরেন্স সাহেব ওই খবরটা পড়ে কিছুদিন চেষ্টা করবার পর একদিন সত্যিই বানিয়ে ফেললেন এক যন্ত্র। যার কাজ খুব ছোট কণাদের বৃত্তাকার পথে ঘোরানো। লরেন্স সাহেব এই যন্ত্রটা বানিয়েছিলেন খুব সাধারণ কিছু জিনিস কাজে লাগিয়ে, যার মধ্যে ছিল মোম, চেয়ার, তার দিয়ে জড়ানো কাপড়ের তৈরি একটা গাছ— এইরকম আর কি! সেই জিনিস দেখে তাঁর সহকর্মীরা তো তাজ্জব! ছোট্ট কণাদেরকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্লান্ত করে তারপর সেগুলোকে পরমাণুর ওপর ছুঁড়ে দিয়ে পরমাণুর ভেতরের নিউক্লিয়াসটাকেই ভেঙে ফেলছে যন্ত্রটি।
লরেন্স সাহেবের তৈরি ওই যন্ত্র দেখতে তখন নানা বিভাগ থেকেই অধ্যাপক-ছাত্ররা আসেন। তাঁর সঙ্গে তখন আলাপ ছিল রসায়নের অধ্যাপক গিলবার্ট লুইস আর এক ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার লিওনার্ড ফুলার-এর। প্রথম জনের কাছ থেকে লরেন্স পেলেন সাধারণ হাইড্রোজেনের চেয়ে একটু ভারী ডয়টেরন কণা, যেটা দিয়ে পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভাঙা আরও সহজ হয়েছিল। আর ফুলার সাহেব তাঁকে জোগাড় করে দিয়েছিলেন একটা কাজে লাগে না এমন প্রকাণ্ড চুম্বক, যার ওজন ‘মাত্র’ আশি টন!
সাইক্লোট্রন কীভাবে কাজ করে
চুম্বক জিনিসটা এই যন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দুটো অর্ধবৃত্তাকার ভারী চ্যাপ্টা চুম্বককে মুখোমুখি বসিয়ে মাঝের ফাঁকা জায়গাটায় ছেড়ে দেওয়া হয় ছোট্ট চার্জযুক্ত কণা (যেমন প্রোটন বা আলফা কণা, ইলেকট্রনেরা এতটাই ছোট আর হালকা যে, ওদের নিয়ে কাজ চলে না)। এবার ওই কণা যখন বাইরে থেকে প্রয়োগ করা তড়িৎক্ষেত্রের প্রভাবে ছুটতে শুরু করে, তখন চুম্বকের কৃপায় তার ওপর প্রযুক্ত হয় আরও বেশি বল (এই বলের নাম লোরেঞ্জ বল)। সেই বলের প্রভাবে তার গতি আরও বাড়তে থাকে। এইভাবে যত গতি বাড়ে, ওর ভ্রমণ-পথও তত বড় হতে থাকে। মানে আগে ও যেমন ছোট বৃত্তাকার পথে ঘুরছিল, সেই পথটা বড় হতে থাকে। একসময় কণাটা চুম্বকের সীমানার বাইরে চলে আসে, তখন ওর গতি যথেষ্ট বেশি।
এরপর এই কণাকেই যদি ছুঁড়ে দেওয়া হয় পরমাণুর গায়ে, ও ভেঙে দিতে পারবে পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে। যে ব্যাপারটা সত্যিই ঘটিয়েছিলেন তিন জার্মান অটো হান, ফ্রিৎজ স্ট্রাসম্যান এবং লিসে মেইটনার। তবে সেটা বেশ কয়েক বছর পরের কথা। আর এই নিউক্লিয়াসকে ভাঙতে সফল হওয়ারই এক অনিবার্য পরিণাম বিশ্বযুদ্ধে পরমাণু বোমার ব্যবহার। যেটা তৈরির মূল ধারণা বা উপায় লুকিয়ে আছে ওই পরমাণুকে ভাঙবার যে কাজ, সেটার মধ্যেই।
আরও পড়ুন-ভোটের মুখে লাদাখে নতুন পাঁচ জেলা, নেপথ্যে বিজেপির রাজনৈতিক অভিসন্ধি?
লরেন্স সাহেব প্রথম যে যন্ত্র বানিয়েছিলেন, তাতে মূল অংশটায় যেখানে আসল কাজটা হয়, সেই জায়গার ব্যাসার্ধ ছিল মাত্র আড়াই ইঞ্চি। পরে এই যন্ত্রের বহুবার উন্নতিসাধন করা হয়েছে, লরেন্স নিজেও কাজটা নিয়ে লেগে থেকে পরপর যন্ত্রের ক্ষমতা বাড়িয়ে যেতে পারছিলেন, প্রথম দিকে যেখানে এই ব্যাসার্ধের মাপ ছিল আড়াই-তিন ইঞ্চি, পরে সেটাই বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে তেরোয়, আর ১৯৩৬ সালে গিয়ে সেই মাপ হয় তিরিশ ইঞ্চি, মানে আড়াই ফুট। সেই বড় মাপের যন্ত্রের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই একটা আলাদা ভবন ছিল। লরেন্স সাহেবের মৃত্যুর পর সেখানেই তৈরি হয় ‘আর্নেস্ট অরল্যান্ডো লরেন্স বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি’।
লরেন্স সাহেব সাইক্লোট্রন যন্ত্র আবিষ্কারের জন্য নোবেল পেয়েছিলেন ১৯৩৯ সালে। পুরস্কার পাওয়ার পরেও তাঁর এই সংক্রান্ত কাজ থামেনি, তখন তাঁর লক্ষ্য এমন সাইক্লোট্রন বানানো, যার ওই মূল অংশের ব্যাস হবে ১৮৪ ইঞ্চি, বা ৪৬৭ সেন্টিমিটার। হ্যাঁ, সে যন্ত্রও বানানো গিয়েছিল। তাতে ঘুরতে থাকা কণার শক্তি পৌঁছে যেত একশো মিলিয়ন ইলেকট্রন-ভোল্টে। তবে বলি, ইদানীং যে-সব কণা ত্বরকযন্ত্র নিয়ে কাজ চলে পৃথিবীতে, সে-সব যন্ত্রের ক্ষমতা লরেন্সের ওই যন্ত্রের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। তবু আমরা লরেন্সকে মনে রেখেছি, কারণ তিনিই দেখিয়েছিলেন যে স্বপ্ন আর চেষ্টা করবার ইচ্ছে থাকলে একের পর এক লক্ষ্য পূরণ করাই যায়।
আরও পড়ুন-ডুরান্ড সেমিফাইনালে সামনে বেঙ্গালুরু, ৯০ মিনিটেই জয় চায় মোহনবাগান
পুরনো থেকে হাল আমল
যুগের পরিবর্তন ঘটেছে। শক্তিশালী দেশগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে এমন এক অস্ত্র, যা একটু বেশি পরিমাণে ব্যবহার করলে এই গোটা গ্রহটাই যেতে পারে নিশ্চিহ্ন হয়ে। যুদ্ধ চলাকালীন পরমাণু বোমা তৈরির গোটা পর্বটাই ঘটে গিয়েছিল যথেষ্ট তাড়াহুড়ো করে, যে কারণে এই অস্ত্রের ক্ষতিকর দিক নিয়ে বিজ্ঞানীরা অবহিত করবার সুযোগটাই পাননি। তবে হিরোশিমা আর নাগাসাকির বিপর্যয়, মানুষের বা প্রকৃতির অবস্থা, সেইসব দেখে কিছুটা অন্তত বুঝে নেওয়া যায় পরমাণুর নিউক্লিয়াস ভাঙলে কী পেতে পারি আমরা।
আর্নেস্ট লরেন্স-এর জন্ম ১৯০১ সালের ৮ অগাস্ট, আর মৃত্যু হয় ১৯৫৮ সালের ২৭ অগাস্ট, মানে আজকের দিনে। এই লেখায় সেই মানুষটির কাজের সামান্য বিবরণ দিয়ে আমরা তাঁকে শ্রদ্ধা জানালাম।