এক অজেয় নারী মাদাম কুরি

মহীয়সী বিজ্ঞানী মেরি স্কলোডসকা কুরি সংক্ষেপে ‘মেরি কুরি’ বা ‘মাদাম কুরি’। বিজ্ঞানজগৎ তাঁকে জানায় কুর্নিশ। তিনি ছিলেন মানবদরদিও। দুঃসহ বাধা ডিঙিয়ে পৌঁছেছিলেন সাফল্যের শিখরে। আগামী ৭ নভেম্বর তাঁর জন্মদিন। তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানালেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

‘মেরি কুরি’ বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিস্ময়ের সৃষ্টিকারী এক নাম। কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিজ্ঞানের দুটি শাখায় (পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে) নোবেল পুরস্কার পান। নারী হিসেবে প্রথম নোবেল জয়ের কৃতিত্ব তাঁরই।
পুরো নাম মেরি স্কলোডসকা কুরি। ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়। পোল্যান্ড তখন প্রুশিয়া, রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া-শাসিত।১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর রুশ শাসনাধীন ওয়ারস’ শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হয় তাঁর। মারিয়া বা মেরির ডাক নাম ছিল মানিয়া। তাঁর বাবা ব্লাদিস্লাভ শক্লোদোভস্কি একটি নামকরা কলেজের অধ্যাপক, মা একটি নামকরা স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। তিন বোন এবং এক ভাইয়ের মধ্যে মানিয়া ছিলেন সবার ছোট। বাবা প্রতি সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিজ্ঞান ও সাহিত্যের আসর বসাতেন। তাই বিজ্ঞানে প্রতি ভালবাসাটা ছোট থেকেই শুরু হয়েছিল।

আরও পড়ুন-বই অমর, বুঝিয়ে দিল শহরের একদিনের ভিজে বইয়ের মেলা

সংগ্রামময় জীবন
মানিয়ার জীবন খুব দুঃখের। তাঁর যখন ১০ বছর বয়স তখন মা যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মায়ের মৃত্যুর পর কিছুদিন যেতে না যেতেই তাঁর বড় বোন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সেই সময়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ উত্তাল। সেই টানাপোড়েনে তৎকালীন সরকার তাঁর বাবাকে আগের চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে একটি নিম্ন শ্রেণির চাকরিতে নিয়োগ করে। চরম আর্থিক সংকটে পড়ে মেরি কুরির গোটা পরিবার। কিন্তু মেরি ও তাঁর বোন ব্রনিস্লা হাল ছাড়ার পাত্রী ছিলেন না। তাঁদের মধ্যে চুক্তি হল যে, একজন আরেকজনের পড়াশোনার খরচ জোগাবে। সেই মতোই মেরি চাকরি করে বোনের পড়ার খরচ চালান এবং পরবর্তীতে তাঁর বোনের আর্থিক সহায়তায় মেরি বিজ্ঞানের উচ্চশিক্ষার জন্য প্রথমে অস্ট্রিয়ার শাসনাধীনে ক্রাকো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। এত লড়াই মেরির বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
মেরি ও পিয়ের কুরি
১৮৯১-এর শেষের দিকে মেরি পোল্যান্ড থেকে ফ্রান্সের উদ্দেশে পাড়ি দেন। তিনি প্যারিসের সোরবর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পদার্থবিজ্ঞানে, রসায়নে এবং অঙ্ক নিয়ে পড়াশুনো করেন। সেই সময়ও মেরি খুব আর্থিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যান। এরপর তিনি গ্যাব্রিয়েল লিপম্যানের গবেষণাগারে কাজ শুরু করেন। পোলিশ পদার্থবিদ অধ্যাপক জোজেফ কোভালস্কি মেরির খুব নিকটজন ছিলেন। তিনি জানতেন যে মেরির গবেষণা কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য বড় একটি গবেষণাগার প্রয়োজন। তাই তিনি পিয়েরের সঙ্গে মেরির পরিচয় করিয়ে দেন। কারণ তাঁদের গবেষণাগার ছিল। তাঁদের দেখা হওয়ার মুহূর্তেই পরস্পরকে ভাল লেগে যায়। কিন্তু তখনই কিছু প্রকাশ পায়নি। মেরি এবং পিয়ের দু’জনে মিলে চুম্বক গবেষণায় নিয়োজিত হন। এরপর ধীরে ধীরে সম্পর্ক বাড়ে এবং পরবর্তীকালে তাঁদের বিয়ে হয়।
কুরি দম্পতির আবিষ্কার
১৮৯৮ সালে এই দম্পতি প্রথমে প্লিচব্লেন্ড থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থ পোলোনিয়াম এবং পরে রেডিয়াম আবিষ্কার করেন, যা ইউরেনিয়ামের থেতে দশ লক্ষ গুণ বেশি শক্তিশালী। এই রেডিয়ামের ব্যবহার অপরিসীম। কুরি দম্পতি প্রমাণ করলেন যে, কোনও কোনও মৌলের পরমাণু ক্রমাগত ভেঙে গিয়ে রশ্মি বিকিরণ করে। এই বিকিরণ অন্য কোনও পদার্থ ভেদ করেও যেতে পারে। এই ধরনের পদার্থকে বলে তেজস্ক্রিয় পদার্থ, আর এই গুণকে বলে তেজস্ক্রিয়তা। মেরি এবং পিয়ের এজন্য ১৯০৩ সালে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান।
মানবিক মুখ মেরি কুরি
বিয়ের মাত্র এগারো বছর পর এক মোটর দুর্ঘটনায় স্বামী পিয়ের কুরি প্রয়াত হন। ছোট-ছোট দুটো মেয়েকে বড় করে তোলার দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। তাও বিজ্ঞান গবেষণার কাজ থেমে থাকেনি। ১৯১১ সালে প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে দ্বিতীয়বার নোবেল পুরস্কার পেলেন মেরি কুরি তবে এবার রসায়নে। এরপর মানবসেবায় নিজেকে উজাড় করে দিলেন। শুধু তেজস্ক্রিয় রশ্মির চরিত্র বিচার করা বা বিভিন্ন মৌল আবিষ্কারেই তাঁর গবেষণা সীমাবদ্ধ ছিলনা। তেজস্ক্রিয় রশ্মিকে কীভাবে রোগ সারানোর কাজে ব্যবহার করা চলে,তাই নিয়ে বাকি জীবনের প্রায় সবটাই কাটিয়েছিলেন তিনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সীমিত সামর্থ্য আর লোকবল নিয়েও মেরি গিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর সদ্য আবিষ্কৃত এক্স রশ্মির সাহায্যে ভাঙা হাড়ের চিকিৎসা করতে এবং অন্যান্য অসুখ-বিসুখে অসুস্থ সেনাদের পাশে দাঁড়াতে।
কিন্তু দিনরাত তেজস্ক্রিয় মৌল নিয়ে নাড়াচাড়ার ফল ভাল হল না। অচিরেই মৃত্যু হয় তাঁর। লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৯৩৪ সালের ৪ জুলাই এই মহীয়সী নারী পরলোক গমন করেন।

আরও পড়ুন-হরিয়ানায় নৃশংসভাবে খুন প্রাক্তন ক্রিকেটার

মেরি কুরির বিখ্যাত ডায়েরি
মেরি কুরির বিখ্যাত এবং বিপজ্জনক ডায়েরি। যে ডায়েরি আজও বিজ্ঞানী-গবেষক থেকে শুরু করে সাধারণের কাছে আকর্ষণের বস্তু। ডায়েরিটি রাখা রয়েছে ফ্রান্সের ‘বিবলিওথেক ন্যাশনাল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে। কেন ডায়রিটি এত বিখ্যাত। আসলে মেরি কুরির ব্যবহৃত জিনিসপত্র অনুসন্ধান চালিয়ে ধরা পড়েছে তেজস্ক্রিয় রশ্মির অস্তিত্ব। যার মধ্যে রয়েছে তাঁর পড়াশুনোর টেবিল, অন্যান্য আসবাব, পোশাক, রান্নার সরঞ্জাম এবং ওই ডায়েরিটি। যার গায়ে লেগে রয়েছে রেডিয়ামের এক আইসোটোপ, যার ভরসংখ্যা ২২৬। এই ডায়েরি দেখতে দেওয়া হয় বিশেষ অনুমোদন সাপেক্ষে। যাঁরা দেখতে যান তাঁদের এই মর্মে লিখতে হয় এই কাজের জন্য আমার যা ক্ষতি হবে, তার জন্য শুধুই আমিই দায়ী। ডায়েরির কাছে যাওয়া এতটাই বিপজ্জনক যে তাঁদের পরতে হয় বিশেষ এক ধরনের পোশাক।
মারি কুরির ডায়েরিতে লেগে থাকা ওই বিশেষ মৌলের আইসোটোপের অর্ধেক আয়ু ১৬০০ বছর। এর অর্থ হল নির্দিষ্ট পরিমাণ ওই পদার্থের মধ্যে যতগুলো তেজস্ক্রিয় কণা রয়েছে, সেটার সংখ্যা ১৬০০ বছর পর কমে অর্ধেক হয়ে যাবে। তখন হয়তো ওই ডায়েরিতে হাত দেওয়া যেতে পারে, খুব একটা ক্ষতিকর হবে না। এই কারণে মৃত্যুর পর মেরি কুরির দেহ সীসার তৈরি বদ্ধ কফিনে সমাহিত করা হয়। কারণ সীসাই হল একমাত্র ধাতু, যে কোনও তেজস্ক্রিয় মৌল ক্ষয় হতে হতে একসময় এই ধাতুতেই পরিণত হয়। তাছাড়া সীসা পারে বেশিরভাগ তেজস্ক্রিয় রশ্মিকে (বা গামা এবং এক্স রশ্মিকেও) শোষণ করে নিতে।

Latest article