বর্ষায় ম্যালেরিয়া

বর্ষাকাল। বাড়ছে ম্যালেরিয়া (Malaria)। ইদানীং দেখা দিচ্ছে অনেক নতুন উপসর্গ। তাই জটিলতাও তৈরি হচ্ছে। সরকার থেকে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের সবরকম ব্যবস্থা নিলেও সচেতনতার অভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশিরভাগ মানুষ। ঠিক রোগনির্ণয়, চিকিৎসা এবং সতর্কতাই রুখবে ম্যালেরিয়া। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

ম্যালেরিয়ার ইতিহাস
প্রাচীন গ্রিসের চিকিৎসক হিপোক্রিটাস— যাঁকে ফাদার অফ মেডিসিন বলা হয় তিনি প্রথম রোগের এই লক্ষণগুলোর কথা বলেন। কিন্তু ম্যালেরিয়ার প্রথম নথিবদ্ধ চিকিৎসার খোঁজ পাওয়া গেছিল পেরুতে। ১৮৮০ সালে ফ্রান্সের সেনানী চিকিৎসক চার্লস ল্যাভেরন লোহিত রক্তকণিকায় একটিমাত্র কোষ বিশিষ্ট পরজীবী প্রোটোজায়াকে ম্যালেরিয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এরপর ১৮৯৭ সালে ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ ডাক্তার স্যার রোনাল্ড রস আবিষ্কার করেন যে, অ্যানোফিলিস মশা এই রোগের বাহক এবং এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান।

আরও পড়ুন-বাংলাদেশে অস্থিরতার জের, পুরনো মেলার মাঠে বৃক্ষরোপণ

কেন হয় এই রোগ
বর্ষা মানেই ম্যালরিয়ার বাড়বাড়ন্ত। খবর অনুযায়ী এই রাজ্যে গতমাসে এক কিশোর এবং এই মাসে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে ম্যালেরিয়ায়। সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ২৯০ মিলিয়ন মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং ৪ লক্ষেরও বেশি মানুষের এই রোগে মৃত্যু হয়। তাই সতর্ক হতেই হবে।
ম্যালেরিয়া রোগের জন্য দায়ী হল একটি পরজীবী প্রোটোজায়া যার নাম প্লাসমোডিয়াম। স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশার কামড়ে হয় এই রোগ। মশা কামড়ানোর পর তাঁর মধ্যে থাকা সেই প্যারাসাইট লালারসের মধ্যে দিয়ে মানবদেহের সংবহনতন্ত্রে ও যকৃতে পৌঁছয় এবং বংশবৃদ্ধি করে।
এই পরজীবী প্লাসমোডিয়াম পাঁচ ধরনের হয়। প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাকস, ফ্যালসিপেরাম, ম্যালেরি, ওভেল এবং প্লাসমোডিয়াম নোলেসি। মানুষের ক্ষেত্রে শুধু প্লাসমোডিয়াম ভাইভ্যাকস ও ফ্যালসিপেরামটাই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। বাকিগুলো এখনও পর্যন্ত শুধু পশুদের মধ্যেই দেখা গেছে। ভাইভ্যাকস ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট লিভারের মধ্যে ঢুকে সেখানেই হিপ্নজয়েট রূপে রয়ে যায়। তাই যদি সম্পূর্ণ চিকিৎসা না করা হয় তবে ভাইভ্যাকস ম্যালেরিয়া ফিরে ফিরে আসে। ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট লিভারের মধ্যে কিছুটা হলেও থেকে যায় অন্যভাবে। একজন ম্যালেরিয়া রোগীর থেকে অন্য সুস্থ মানুষের দেহে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ হয় মশার মাধ্যমেই। ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট নেই এমন মশাও যদি ম্যালেরিয়া রোগীকে কামড়ে তারপর সুস্থ ব্যক্তির গায়ে বসে তাহলে তারও ম্যালেরিয়া হবার সম্ভাবনা একশো শতাংশ।

আরও পড়ুন-যাত্রী-দুর্ভোগ চলছেই, হাওড়া-আমতা শাখায় ফের বিঘ্ন ঘটল রেল পরিষেবায়

উপসর্গ
সাধারণত মশা কামড়ানোর দশ থেকে চোদ্দো দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়।
কাঁপুনি দিয়ে জ্বর সঙ্গে গায়ে ব্যথা, গাঁটে গাঁটে ব্যথা।
বমি-বমি ভাব। ক্ষুধামান্দ্য।
পেশি এবং বুকে অসহনীয় ব্যথা।
এখন অনেক সময়ই ম্যালেরিয়াতে জ্বর তেমন থাকে না। ইউরিনে একটা জ্বালাভাব। এক্ষেত্রে ইউরিন রিপোর্টে সংক্রমণ নেই। কিন্তু ওষুধ দেবার পর জ্বালাভাব কমলেও জ্বর অল্পবিস্তর রয়ে যাচ্ছে তখন পরীক্ষা করে ম্যালেরিয়া পাওয়া যাচ্ছে।
কিছু ক্ষেত্রে ঘুষঘুষে জ্বরও হচ্ছে। হঠাৎ করে ঘাম এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। প্রাথমিক ভাবে সুগার বা প্রেশার ফল মনে হলেও অনেক সময় পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেটা ম্যালেরিয়াই।
বেশকিছু ক্ষেত্রে জ্বরের সঙ্গে তলপেটে ব্যথা, শ্বাসকষ্টও থাকে।
কখন বুঝবেন সিভিয়র
ম্যালেরিয়া রোগী জ্ঞান হারাতে শুরু করে। খিঁচুনি শুরু হয়, শরীর ছেড়ে দেয়।
কিছু রোগীর মধ্যে ভাইভ্যাকস আর ফ্যালসিপেরাম দুটো ম্যালেরিয়া একসঙ্গে দেখা দেয়। সেক্ষেত্রেও জীবনহানির সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া হলে প্যারাসাইটগুলো মস্তিষ্কের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শিরায় রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। এতে ব্রেনের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ফুলে যায়। এর ফলে রোগী কোমায় চলে যেতে পারে।
ম্যালেরিয়া জটিল আকার ধারণ করলে লিভার, কিডনি— সবকিছু আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে। মাল্টি অরগান ফেলিওরের সম্ভাবনা থাকে।
ম্যালেরিয়া লোহিত রক্ত কণিকাকে প্রভাবিত এবং ধ্বংস করে ফলে শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ হয় না। এর ফলে অ্যানিমিয়া হতে পারে।
ম্যালেরিয়া জটিল হলে ফুসফুসে জল জমে। এর ফলে প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।
ম্যালেরিয়া রোগীর একটা কমন চিকিৎসা হল কুইনাইন। এই ওষুধ একটানা খাওয়ার ফলে অনেক সময় রোগীর ব্লাড সুগারের মাত্রা নিচে নেমে গিয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার একটা প্রবল সম্ভাবনা থাকে। এতে সুগার ফল করে রোগীর কোমায় চলে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
প্রথমে লক্ষণ বুঝে রক্তপরীক্ষা করতে হবে। এই পরীক্ষায় সরাসরি লোহিত রক্তকণিকার মধ্যেই প্রোটোজায়াগুলো ধরা পড়ে।
এছাড়া রয়েছে (RDT) বা র্যাপিড ডায়াগনোসিস টেস্ট। একটি কিটের মধ্যে একফোঁটা রক্ত নিয়ে অ্যান্টিজেনের মাধ্যমে পরীক্ষা করা। পজিটিভ বা নেগেটিভ দিয়ে বোঝা যায় ম্যালেরিয়া আছে বা নেই।

আরও পড়ুন-অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ, কুপিয়ে-পুড়িয়ে-গুলিতে খুন

চিকিৎসা
ভাইভ্যাকস ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে ক্লোরোকুইন বা কুইনিন দেওয়া হয়। পাশাপাশি প্রাইমাকুইনও দেওয়া হয়। প্রাইমাকুইন চোদ্দো দিনের জন্য দেওয়া হয় কারণ এটি যকৃতের মধ্যে লুকিয়ে থাকা হিপ্নজয়েটগুলো নষ্ট করে দেয়— যাতে তা ফিরে না আসে। মহিলাদের প্রাইমাকুইন দেওয়া চলবে না শুধুমাত্র কুইনিন চলে।
ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়া খুব বিপজ্জনক। এই ম্যালেরিয়াতে ক্লোরোকুইন কাজ করে না। আর্টিমিসিনিন ডেরিভেটিভস গ্রুপের ওষুধ দিতে হয়। ফ্যালসিপেরামে প্রাইমাকুইন একদিনই দেওয়া হয়। সিভিয়র ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রেও এই গ্রুপের ওষুধই দেওয়া হয়। ম্যালেরিয়া ওষুধ চলাকালীন যদি দেখেন ইউরিনের রং কালচে হচ্ছে বা হাত-পা নীলচে হয়ে চোখ হলদে হয়ে যাচ্ছে বা বমিভাব বাড়ছে তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ম্যালেরিয়া ছোট শিশু ও গর্ভবতী মহিলার জন্য খুবই বিপজ্জনক। ফলে এদের ক্ষেত্রে এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যান। ছোটদের ক্ষেত্রে বয়স আর ওজন মেপে ওষুধ দেওয়া হয়।
এই সময় সহজপাচ্য খাবার খেতে হবে। জল খেতে হবে বারবার। এই সময় সুগার ফল করে যেতে পারে তাই পেট খালি রাখা উচিত নয়।
ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচতে
বাড়িতে বা তার আশপাশে কোনও জল জমতে দেওয়া যাবে না। কারণ জমা জলেই এই মশা বংশবৃদ্ধি করে।
নিজেদের এলাকা পরিষ্কার রাখুন।
জানালায় জাল লাগানো যেতে পারে। রাতে অবশ্যই মশারি টাঙিয়ে শুতে হবে।
ছোটদের বড় স্লিভের জামাকাপড় পরান। মসকুইটো রেপেলেন্ট ব্যবহার করুন। অয়েনমেন্টও ব্যবহার করতে পারেন।

Latest article