বামেরা মুখে বিকল্প অর্থনীতির কথা বললেও তার প্রকৃত রূপায়ণ জননেত্রীর কর্মযজ্ঞে। সরকারি তথ্য দিয়ে সেই সত্য তুলে ধরেছেন অধ্যাপক দেবনারায়ণ সরকার
বাম আমলে অসীম দাশগুপ্ত প্রতিবছর বাজেট বক্তৃতায় বিকল্প অর্থনীতির কথা বলতেন। ‘বিকল্প অর্থনীতি’ কী তা বোঝাতে গিয়ে উনি বলতেন, বর্তমান রাষ্ট্র কাঠামোয় সাধারণ মানুষের মূল আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সাধারণের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, আয় বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণই হল বিকল্প অর্থনীতির গোড়ার কথা।
কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিকল্প অর্থনীতি আরও বেশি সমৃদ্ধ, আরও বেশি ব্যাপক এবং আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে কার্যক্রম বিগত দশ বছরে আমরা দেখেছি তাতে একটি বিষয় পরিষ্কার। মা-মাটি-মানুষের সরকারের বিকল্প অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমূহ হলঃ ১) মহিলাদের ক্ষমতায়ন, ২) কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ৩) সাধারণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, ৪) দারিদ্র্য দূরীকরণ ৫) সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ৬) মানবিক উন্নয়ন ।
আরও পড়ুন- তালিবান ও হাক্কানি জঙ্গিদের আশ্রয়দাতা পাকিস্তানই: ব্লিঙ্কেন
এক এক করে বিষয়গুলি গভীরে দৃকপাত করা যাক।
প্রথম, মহিলাদের ক্ষমতায়ন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘‘তোমরা মেয়েদের উন্নতি করতে পার? তবে আশা আছে, নতুন পশুজন্ম ঘুচিবে না।“নোবেল পুরস্কারজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যাজ ফ্রিডম’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘‘Empowering Women is key building in future We want.” অর্থাৎ ভবিষ্যৎ নির্মাণে আমরা যা চাই তার দাবিকাঠি হল মহিলাদের ক্ষমতা প্রদান।
সুতরাং, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিকল্প অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন মহিলাদের ক্ষমতা প্রদানের ওপর। এজন্যই এই সরকার প্রবর্তিত বহু প্রকল্প– কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথী এবং স্বনির্ভর প্রকল্প–এগুলির প্রতিটি মহিলাদের ক্ষমতায়ন এবং কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত। স্বনির্ভর প্রকল্প ব্যতিরেকে বাদবাকি প্রকল্পগুলির জন্য বাজেট বরাদ্দ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পেও নারীর ক্ষমতায়ন গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়েছে। প্রতিটি পরিবারের মহিলাই হবেন স্বাস্থ্যসাথীর মূল ব্যক্তি বা কর্ণধার। এই প্রকল্পে প্রতিবছর পাঁচলক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে। ছ’সাত বছর ধরে চলছে কন্যাশ্রী প্রকল্প। এই প্রকল্পে সরকারের খরচের পরিমাণ প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের জন্য সরকারের বছরে ব্যয় হবে বারো হাজার কোটি টাকা।
আরও পড়ুন-৭ বছর পিছিয়ে ক্যালেন্ডার মহাসংকটেও ২০১৪ সালকে সাদরে বরণ করছে এই দেশ
অনেকেই অভিযোগ তুলেছেন, লক্ষ্মীর ভান্ডার দান খয়খয়রাতির আয়োজন ছাড়া আর কিছুই নয়। টা অপপ্রচার। এই প্রকল্পে সম্ভাব্য সুবিধাভোগীদের প্রায় এক চতুর্থাংশ পাবেন ১০০০ টাকা করে। বাকি চারভাগের তিনভাগ মহিলা পাবেন মাসে ৫০০টাকা করে। নগদ ৫০০- ১০০০ টাকা যদি মহিলাদের হাতে যায় তবে তা নিঃসন্দেহে তাদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে একটা বড় পদক্ষেপ, সন্দেহ নেই।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল কর্মসংস্থান বৃদ্ধি।
আরও পড়ুন-ভিক্ষা করে মাসে আয় ৭৫ হাজারের উপর!
ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভিস অর্গানাইজেশনের তরফে বেকারত্ব নিয়ে প্রাপ্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮-তে ভারতে বেকারত্বের হার ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু সে সময়েও, দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বেকারত্বের হার ছিল ৪.৬ শতাংশ। রাজ্যগুলির বেকারত্বের তালিকায় আমাদের রাজ্যের জায়গা ছিল নীচের দিক থেকে তৃতীয়। গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, তামিলনাড়ুর বেকারত্ব আমাদের ছেয়ে অনেক বেশি ছিল।
এছাড়া কিছুদিন আগে প্রকাশিত সরকারি তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গ্রামে পরিবারপিছু ব্যয়বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের হার সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় বেশি। ২০১০-২০২০-র মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে পরিবার পিছু ব্যয় করার ক্ষমতা ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেক্ষেত্রে সর্বভারতীয় হার মাত্র ৩ শতাংশ।
২০০০-২০১১-র মধ্যে বাম জমানায় বঙ্গে সেই হার ছিল জাতীয় গড়ের (৩.২ শতাংশ) চেয়ে অনেক কম, মাত্র ২.৪ শতাংশ।
আরও পড়ুন-ভিক্ষা করে মাসে আয় ৭৫ হাজারের উপর!
সুতরাং, এটা পরিষ্কার যে সারা ভারতের নিরিখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সকার গঠিত হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনীতি বলে, ক্রয়ক্ষমতার বৃদ্ধি প্রকারান্তরে আয় বৃদ্ধি।
দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গ দারুন সাফল্য অর্জন করেছে। ২০১১-২০১৮-র মধ্যে সারা ভারতে দরিদ্রতা ২২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২২.৮ শতাংশ হয়। পশ্চিমবঙ্গে সেখানে তা ২০শতাংশ থেকে কমে ১৪ শতাংশ হয়েছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন হল অর্থনৈতিক কাঠামোর উন্নয়ন ও জিডিপি–র বৃদ্ধি৷ ২০১৭–১৮তে সারা ভারতে জিডিপি বেড়েছিল ৭.২ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গে সেই বৃদ্ধি ছিল ৮.৯ শতাংশ৷ ২০১৮–১৯–এ সারা ভারতে জিডিপি বেড়েছিল ৬.৮ শতাংশ৷ পশ্চিমবঙ্গে সেই বৃদ্ধি ছিল ১২.৬ শতাংশ৷
পশ্চিমবঙ্গ নাকি ঋণে জর্জরিত একটি রাজ্য৷ কিন্তু রিজার্ভ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০–২১ –এ রাজ্যের রাজস্ব বাবদ আয় জিএসডিপি–র অনুপাতে ১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে৷ অন্যদিকে, গুজরাতে ২০১৮–১৯–এ রাজস্ব বাবদ আয় ছিল জিএসডিপি–র ৯ শতাংশ৷ ২০২০–২১–এ তা কমে দাঁড়ায় ৮.৬ শতাংশে৷ গত দশ বছর ধরে গড়ে প্রতি বছর ২৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে রাজ্য৷
আরও পড়ুন- তালিবানকে অবিশ্বাস, তাই দেশছাড়া আফগান নেত্রীরা
তথ্য বলছে, গৃহীত ঋণের ৮০ শতাংশ সুদ দিতে আর সুদ আসল মিলিয়ে গৃহীত ঋণের ১১২ শতাংশ ব্যয় হয়েছে৷ তা সত্ত্বেও ওই ঋণের থেকে আমরা মূলধনী ব্যয় চালাতে পেরেছি৷ তাই বামফ্রন্টের অন্তিম পর্বে সামাজিক খাতে ব্যয় যেখানে ছিল ৪১.৯ শতাংশ তা এখন বেড়ে ৪৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছে৷ উন্নয়ন খাতে বাম আমলে মোট জিএসডিপি–র ৮ শতাংশ ব্যয় হত৷ এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশেরও বেশি৷
মূলধনী ব্যয় মানে পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য ব্যয়৷ তথ্য বলছে, পুঁজি আকর্ষণের জন্য নতুন পরিকাঠামো গড়ে তুলতে বাম আমলে ছিল ঋণের ১৫ শতাংশ খরচ হত, এখন তা বেড়ে ৪২ শতাংশ ছাড়িয়েগিয়েছে৷
পরিশেষে আসি মানবিক উন্নয়নের কথায়৷ ২০১৯–এর তথ্য উপাত্ত বলছে, পশ্চিমবঙ্গে মানবিক উন্নয়ন ০.৬৪, গুজরাতে তা ০.৬৭২৷ আম আমলে ২০১০–এ পশ্চিমবঙ্গে মানবিক উন্নয়ন ছিল ০.৫৭২৷ এই তথ্যগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিকল্প অর্থনীতির সুবাদে পশ্চিমবঙ্গে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে৷
এগিয়ে বাংলা।