প্রতিবেদন : বর্ধমানের প্রশাসনিক বৈঠক থেকে বাঁকুড়ার বড়জোড়ার ত্রাণশিবির, সোমবার যেখানেই গিয়েছেন ডিভিসি ও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আগের দু’দিনের মতো এদিনও স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন বাংলার প্রতি কেন্দ্রের সীমাহীন উদাসীনতা ও বঞ্চনা তিনি সহ্য করবেন না। এদিন ফের তোপ দেগেছেন ডিভিসির বিরুদ্ধে। সেইসঙ্গে জেলা প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। ফের বৃষ্টি এসেছে। ডিভিসি জল ছাড়লে বিপদ বাড়বে। সোমবার দুর্গাপুরে রাত্রিবাসের আজ, মঙ্গলবার বীরভূম পৌঁছবেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘুরে দেখবেন এই জেলার বন্যাকবলিত এলাকাগুলি। কথা বলবেন দর্গতদের সঙ্গে। বাংলার প্রতি বঞ্চনা ও চক্রান্তের জবাব দেবেন মানুষই, সাফ কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
আরও পড়ুন-জেলমুক্ত অনুব্রত আজই বীরভূমে
সোমবারের পূর্ব বর্ধমানের বৈঠকে মন্ত্রী মলয় ঘটক, অরূপ বিশ্বাস, প্রদীপ মজুমদার, স্বপন দেবনাথ, সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী, চিফ সেক্রেটারি-সহ অন্যান্য সচিব, ডিএম, এসপি, পশ্চিম বর্ধমানের জনপ্রতিনিধি, বর্ধমানের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। বর্ধমানের বৈঠক সেরে মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে যান দুর্গাপুর ব্যারেজ পরিদর্শনে। সেখান থেকে যান বাঁকুড়ার বড়জোড়ার ত্রাণশিবিরে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাছে পেয়ে মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়েন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের আশ্বস্ত করে বলেন, ঘাবড়াবেন না, প্রশাসন আপনাদের সঙ্গে আছে। জেলাশাসক ও এসডিওকে ভিডিওতে নির্দেশ দেন ত্রাণকার্যে যেন কোনওরকম অবহেলা না করা হয়। মন্ত্রী-বিধায়ক-সাংসদদের সঙ্গে নিয়ে ত্রাণশিবিরে সকলের সঙ্গে কথা বলে ত্রাণ তুলে দেন কয়েকজনের হাতে। সাংসদ অরূপ চক্রবর্তী, বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদারদের নির্দেশ দেন সতর্ক থাকতে। কারণ, এই মুহূর্তে সেখানে ব্যাপক বৃষ্টি চলছে এরপর ডিভিসি ফের জল ছাড়লে আবারও বিপদ বাড়বে।
এদিন, প্রশাসনিক বৈঠকের শুরুতেই জেলা প্রশাসনের আধিকারিকদের ফিল্ডে নেমে কাজ করার কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী।
আরও পড়ুন-ঘামছে দার্জিলিং, দক্ষিণে টানা বৃষ্টি
তিনি বলেন, বর্ধমানে কে কী করছে সব খবর তিনি রাখেন। প্রশাসনের এক আধিকারিককে বাড়িতে বসে না থেকে ফিল্ডে নেমে কাজ করার নির্দেশ দেন। বৈঠকে বর্ধমানে দামোদর নদের ওপর দ্বিতীয় সেতু নির্মাণের কাজ এখনও শুরু না হওয়ায় রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। বন্যাপরিস্থিতিতে সকলকে আরও সক্রিয়ভাবে কাজ করতে বলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী এদিন সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, এই দু’-তিনদিনে আরও বৃষ্টি হবে। যেসব জায়গায় জল জমে আছে, আবার জল জমবে, আবার ডিভিসি যদি জল ছাড়ে তাহলে বিপদ বাড়বে। এইসব জায়গায় বিডিও, ডিএম, আইসিদের বলা হয়েছে মানুষকে বুঝিয়েসুঝিয়ে কাজ করবেন। কেউ বাসস্থান ছাড়তে চায় না। বিধায়কদেরও গুরুত্ব দিতে বলেছি। বন্যার জল চলে গেলে বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা প্রভৃতি জেলার যেগুলি শস্যভাণ্ডার সেই সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের জমির শস্যবিমার টাকা দিতে বলেছি। চাষিদের চিন্তা করতে বারণ করেছি। বাংলার দুর্ভাগ্য। বাংলার অবস্থান নৌকার মতো। বাংলায় বন্যা বেশি হয়। বাংলা নদীমাতৃক দেশ। ঝাড়খণ্ডে বৃষ্টি হলেই নিজেদের বাঁচাতে জল ছেড়ে দেয় বাংলার ওপর। ফরাক্কার জলেও প্লাবিত হয়। দীর্ঘদিন ড্রেজিং না করার ফলে জলটা ছেড়ে দেয়। মালদা, মুর্শিদাবাদ, বিহারের কিছুটা প্লাবিত হয়। বিহার বাঁধ কেটে দিয়ে বাংলায় জল ঢুকিয়ে দেয়। গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান, ফ্লাড কন্ট্রোল সব দিল্লির অধীন। আজ পর্যন্ত তারা কোনও কাজ না করার ফলে সব ডুবে যাচ্ছে। সব রাজনৈতিক দলকে বলব, নিজেদের মূর্তি বানিয়ে, বড় বড় বিল্ডিং বানিয়ে টাকা খরচ না করে ফ্লাড কন্ট্রোলের এক-চতুর্থাংশ টাকা যদি আমরা পাই, আমরা কাজ করতে পারি। রাজ্যে অনেক ফ্লাড সেন্টার করা হয়েছে। স্কুল ছুটি হয়ে গেলে সেগুলিকে কাজে লাগাতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, পিএইচইতে জলের খামতি যাতে না হয় তা দেখতে বলা হয়েছে। পূর্ত দফতরকে বলা হয়েছে রাস্তা ঠিক করার জন্য। পঞ্চায়েত দফতরকে বলা হয়েছে বাড়ি তৈরির অর্ধেক বরাদ্দ টাকা ডিসেম্বরে ছাড়ব। জল কমে গেলে সার্ভে করতে বলা হয়েছে। ১১ লক্ষ মানুষের বাড়ি হবে। সংখ্যালঘু দফতরকেও বলা হয়েছে ৬৫ হাজার মানুষকে বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হবে। যাঁদের মাটির বাড়ি ধসে গেছে, তাঁদের বাড়িগুলিও সার্ভে করে তাঁদের প্রায়োরিটি দিতে হবে। ৫০ লক্ষ বাড়ি দিয়েছি। এখনও অনেক বাকি আছে। যাঁদের তালিকায় নাম নেই, তাঁদেরও করে দেওয়ার চেষ্টা করব। যাঁদের বাড়ি ভেঙে গেছে তাঁদের তিনটে করে ত্রিপল দিতে বলা হয়েছে। খাওয়াদাওয়া-সহ রিলিফ চলবে যতক্ষণ না স্বাভাবিক পরিস্থিতি হচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, দলের পক্ষ থেকে ১০ ট্রাক খাবার পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। পুলিশও অনেক জায়গায় কমিউনিটি কিচেন করে সাহায্য করছে। আমরা সাধ্যমতো ড্রাই প্যাকেট করে দিচ্ছি। কাউকে ৫ কেজি চাল, কাউকে ৫ কেজি মুড়ি, দুধ, চা, ডালও দেওয়া হচ্ছে পরিবার অনুযায়ী। এরপরেও বন্যা হলে আবার দেওয়া হবে। মানুষ যেন না ভাবেন তাঁরা বিপদে পড়ে আছেন। মায়ের কাছে প্রার্থনা করি, সব দুর্যোগ কেটে যাক। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বিধায়কদের বলা হয়েছে বিধায়ক কোটায় গ্রামীণ রাস্তা করুক। সাংসদরাও টাকা দিয়ে রাস্তা করুক— গ্রামীণ রাস্তাগুলি।
আরও পড়ুন-ট্রলারডুবি পরিবারগুলিকে অভিষেকের সাহায্য
উল্লেখ্য, এদিন পূর্বস্থলীর উত্তরের বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায় গঙ্গার ভাঙন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে বললে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে জানান, বিধায়ক কোটায় কাজ করতে। এদিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সংবাদমাধ্যমেরও দায়বদ্ধতা আছে। ৫টা কাজ করতে গেলে একটা ভুল হতে পারে। সেটা নিয়ে ন্যারেটিভ না করা উচিত। ন্যারেটিভ করে টিআরপি বাড়ানো যায় না। কেউ যাতে কুত্সা রটাতে না পারে সেটা খেয়াল রাখবেন। কুত্সা রটালে টিআরপি বাড়ে না, মানুষের পাশে থাকলে টিআরপি বাড়ে। তিনি বলেন, হাসপাতালগুলি, সুস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতেও সাপে কাটার ওষুধ বেশি করে ও ভাইরাল মেডিসিন, সর্দি-কাশি, ডায়েরিয়ার ওষুধ রেডি রাখতে বলেছি। ধান কেনায় কোনও গাফিলতি যাতে না হয়, যেখানে ধান পড়ে আছে সেগুলি কিনে নেওয়া হোক। যে ধান নষ্ট হয়েছে সেগুলিকে অন্যভাবে কাজে লাগাব। সুন্দরবনে ধান নষ্ট হয়ে যেত, সেজন্য স্বর্ণ ধান তৈরি করেছি রিসার্চ করে। নষ্ট হওয়া ধানকে সারের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদেও পিঁয়াজ হচ্ছে। ড্রাগন, স্ট্রবেরি চাষ হচ্ছে। আমরা ২০১৩ সালে ডায়মন্ড হারবারে ইলিশ মাছের রিসার্চ সেন্টার করে কোলাঘাট, নামখানা, দিঘায় এখন অনেক ইলিশ হয়। ডিসেম্বরের মধ্যে ডিমে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাব। ৫ লক্ষ পুকুর কাটা হয়েছে। লোয়ার দামোদরে কাজ করছি।
মুখ্যমন্ত্রী এদিন বলেন, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানে ৪০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। ডিপিআর তৈরি হচ্ছে। ৩ বছর লাগবে। এটা আমরা করব। অনেক জায়গায় বাঁধ ভেঙেছে। যেখানে জল জমে আছে, সেখানে এসি, টিভি বন্ধ রাখবেন। বিদ্যুতের কাজ হচ্ছে। ডিভিসি নিয়ে আমরা শেয়ার তুলে নিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছি। আমাদের দু’জন পদত্যাগ করেছেন। তাঁদের কিছু জানানো হত না। বাংলার এই বঞ্চনা আমরা মানব না। এর উত্তর মানুষ দেবে। মুখ্যমন্ত্রী এদিন বলে যান, বড়জোড়ায় একটা দ্বীপ আছে সেখানে যাব, আজ রাতে দুর্গাপুরে থাকব। বীরভূমে কাল যাব প্রশাসনিক বৈঠক করতে। তাহলেই বন্যাকবলিত জেলাগুলি ঘোরা তাঁর সম্পূর্ণ হবে।