প্রতিবেদন: মা-মাটি-মানুষ-এর আশীর্বাদ নিয়ে তৃতীয়বার বাংলার মসনদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর মুখ্যমন্ত্রী হয়েই বাংলার উন্নয়ন যজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তিনি। বিরোধীরা যখন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর গত দশ বছরের উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই ‘জাগোবাংলা’-র উৎসব সংখ্যায় রেলকে হাতিয়ার করে বিরোধীদের কড়া জবাব দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রেলমন্ত্রী হিসেবে দু’দফায় প্রায় পাঁচ বছরের মতো সময় দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। এই সময়ে রেলকে সামনে রেখে কীভাবে রাজ্য তথা দেশের উন্নয়ন হয়েছে তাঁর বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দিয়েছেন দেশের সফলতম রেলমন্ত্রী।
ভাড়া বাড়িয়ে মানুষের ওপর বোঝা চাপিয়ে রেলের রোজগার বাড়ানোই ছিল এতদিনের দস্তুর। দায়িত্ব নিয়ে প্রথম সেই পরম্পরাতেই আঘাত হানেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিই প্রথম মানুষের ওপর বোঝা না চাপিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদকে ব্যবহার করে রেলকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর উদ্যোগ নেন। আর সে কাজে তিনি একশো ভাগই সফল। ‘জাগোবাংলা’-য় তিনি লিখেছেন, ‘আমার প্রথম লক্ষ্যদ ছিল, কিছুতেই সাধারণ মানুষের উপর বোঝা চাপাব না। ভাড়া বাড়বে না। ভাড়া বাড়লে মানুষের খুব অসুবিধা হয়। সেই জন্যাই জোর দিই অভ্যডন্তরীণ সম্পদ ব্য বহার করে রেলের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে।’ আজও দেশজুড়ে রেলের যত প্রকল্প চলছে তার সিংহভাগই তাঁর আমলে শুরু হয়েছিল অথবা তিনিই পরিকল্পনা করে গিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন :বিজেপি বধ করতে অক্ষম রাহুল গান্ধীকে তোপ কুণাল ঘোষের
গোটা দেশ আজ বেকারত্ব, ছাঁটাই, কর্মী সংকোচন, রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা বিক্রির মতো ঘটনায় আতঙ্কের প্রহর গুণছে। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনিই রেলের উন্নয়নের সঙ্গেই কর্মীদের মানোন্নয়নের কাজও শুরু করেছিলেন। যা অবশ্যই এক বিরাট ব্যতিক্রম। রেলমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল যাত্রী পরিষেবা ও তাঁদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘রেলমন্ত্রী হয়ে আমার প্রধান লক্ষ্যট ছিল ২০২০-র দিকে এগনো। ‘ভিশন ২০২০’। তাই সবার আগে জোর দিই সেফটি সিকিউরিটির উপর। তিন হাজারের বেশি আনম্যািন লেভেল ক্রসিং তুলে দেওয়া থেকে শুরু করে, দুর্ঘটনা এড়াতে অ্যা ন্টি-কলিশন ডিভাইস আমরাই তৈরি করেছি।’
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলেই নিছক একটি পরিষেবার সীমানা পেরিয়ে এক মানবিক ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল ভারতীয় রেলকে। তাঁর ভাষায়, ‘একদিকে যেমন, জন আহার দিয়ে গরিব রেলযাত্রীদের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি, তেমনই করমুক্ত বন্ড ছেড়ে নজির গড়েছি রেলের আয় বাড়িয়ে। রেললাইনের ধারে বসবাস করা গরিব মানুষকে আশ্রয় প্রকল্প থেকে গ্রুপ ডি কর্মীদের কন্যাআসন্তানদের মাসিক ১২০০ টাকা ভাতা আমরাই করেছি। সাংবাদিক থেকে ক্যানসার পেশেন্ট–সবার জন্য টিকিটে ছাড় দেওয়া হয়েছে।’
আরও পড়ুন : “জাগো বাংলা” পুজো সংখ্যা প্রকাশের মধ্য দিয়েই আজ শারদ উৎসবের সূচনা করবেন মুখ্যমন্ত্রী
পৃথিবীর বৃহত্তম সংস্থার পরিষেবার উন্নতি থেকে যাত্রীনিরাপত্তা, আধুনিকীকরণ থেকে সম্প্রসারণ, সবেতেই এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন ভারতীয় রেলকে। রেলের অব্যপবহৃত জমিতে ল্যাকন্ডব্যাঙ্ক তৈরি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘ রেলের অব্যবহৃত জমিতে ল্যান্ডব্যাঙ্ক তৈরি করা এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার ল্যা ন্ডব্যায়ঙ্ক না করে জোর করে জমি নিয়েছিল কৃষকদের হাত থেকে। অথচ, রেলের সমস্ত প্রকল্প রেলের জমিতেই করে ওদের দেখিয়ে দিয়েছিলাম, কাজ কীভাবে করতে হয়।’
আর নতুন ট্রেন দেওয়ার ক্ষেত্রে তো তাঁর আমলে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছিল। উত্তর থেকে দক্ষিণ, গোটা বাংলা জুড়ে তাঁর আমলে লোকাল, মেল, এক্সপ্রেস, কত যে ট্রেন চালু হয়েছে তা গুণে বলার চেষ্টা না করাই ভালো। রেলকে সামনে রেখে দেশ তথা রাজ্যে যে ভাবে কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার তুলনা বোধহয় কেবল তিনিই। তাঁর জমানায় একের পর কারখানা পেয়েছে বাংলা। তবে বঞ্চিত হয়নি বাকি দেশও। সুদূর মণিপুরকে রেলের কোচ ফ্যাক্টরি দেওয়াই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। তিনি বলেন, ‘ ছাঁটাই, কর্মী সংকোচন, এসব আমাদের নীতি ছিল না। বরং রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ডকে চাঙ্গা করে তুলেছিলাম। শিলিগুড়িতে বোর্ডের একটি দফতরও করে দিয়েছিলাম। প্রচুর আদর্শ স্টেশন গঠন করা থেকে স্থানীয় হেরিটেজকে মাথায় রেখে স্টেশনের নির্মাণশৈলী আমরাই করেছি। ৫০টি বিশ্বমানের স্টেশন করার পরিকল্পনা ও অর্থবরাদ্দ আমাদের হাত দিয়েই হয়েছিল। রেলের পরিত্যদক্ত জমিতে ৫২২টি হাসপাতাল, হকার ও কুলিদের রাষ্ট্রীয় বিমা যোজনায় এনেছিলাম আমরাই।’
নিজের লেখায় বাংলার প্রতি বঞ্চনা নিয়েও সরব হয়েছেন তিনি। তাঁর নিজের কথায়, ‘২০০৯ সালে রেলমন্ত্রী হওয়ার পর আমি লক্ষ্য করি, দশ বছর বাংলাকে ভয়ংকরভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। প্রথম বাজেটেই ৫২টি ট্রেন বাংলাকে দিয়েছিলাম। তার মধ্যে ভারততীর্থ, মাতৃভূমির মতো ট্রেন রয়েছে।’ কিন্তু বাংলার জন্য কাজ করাটা তখন খুব সহজও ছিল না। তাঁর লেখাতে উঠে এসেছে সে কথাও। তিনি লিখেছেন,‘ সেই সময় আমাদের কাজে বারবার বাধা দেওয়া হয়েছিল। গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। কিন্তু মানুষ সঙ্গে ছিল বলে ওরা কিছুই করতে পারেনি। আমি আমার মতো কাজ করে গিয়েছি। রেলের কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলাম।’ বিজেপিকে আক্রমণ করে তিনি আরও বলেছেন, ‘আমি যে বলি না, বিজেপি দলটি পুরো বাংলা বিরোধী, তা স্পষ্ট হয়েছিল ২০০৯ থেকে ’১১, আমার সব রেল বাজেটে ওদের রিঅ্যাকশনে। বাংলাকে কেন প্রকল্প দিয়েছি, তাই নিয়ে ওদের রাগ। আজ রেল বাজেটটাই এই দলটা তুলে দিয়েছে।’
আরও পড়ুন : বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে DVC-কে তোপ দেগে প্রধানমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রীর
তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর লেখায় দৃপ্তভঙ্গীতে উঠে এসেছে, ‘সেদিন আমি সংসদ ভবনে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট বলেছিলাম, “আমার রাজ্য্ বাংলা। আমি তার জন্য্ কাজ করতে পেরে গর্বিত। তাতে যদি কারও গায়ে ফোস্কা পড়ে, কিছু বলার নেই। দেশের মানুষ জানে, আমি সব রাজ্যের জন্য কাজ করেছি। জাগরণের পথে এগিয়ে দিয়েছি ভারতীয় রেলকে।”
উত্তরবঙ্গের কথা চিন্তা করে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগেই উত্তরবঙ্গের জন্য সুপার ফাস্ট শতাব্দী এক্সেপ্রেস-সহ একাধিক ট্রেন তিনি সেই কবে চালু করেছিলেন। আজ যারা উত্তরবঙ্গের জন্য সকাল সন্ধে কেঁদে ভাসাচ্ছেন তারা কী করেছেন তাও সবার জানা। দুরন্ত এক্সপ্রেসের মতো অজস্র নতুন ট্রেন তাঁরই পরিকল্পনা ছিল। একাধিক বিশ্বমানের স্টেশন, নতুন লাইন, সাগর-পাহাড়কে রেলপথে জুড়ে দেওয়া সবই প্রশাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফল্য। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শহর কলকাতায় জন্য তিনিই নিউগড়িয়া পর্যন্ত মেট্রোপথের সম্প্রসারণ করেছিলেন। বারাসাত, দক্ষিণেশ্বর, ব্যারাকপুর, জোকা, হাওড়া, সল্টলেক, এয়ারপোর্ট পর্যন্ত মেট্রো সম্প্রসারণের উদ্যোগ তাঁরই নেওয়া। এভাবেই ভবিষ্যতের মহানগরীর লাইফ লাইনটা তিনিই গড়ে দিয়েছিলেন।