জাগরণে কাটল তাঁর বিভাবরী, তাই আমরা রইলাম নিশ্চিন্তে

কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে, কেন আগামী উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের অনুকূলে ৬-০ ফলই অনিবার্য, বিশ্লেষণ করছেন তানিয়া রায়

Must read

মাঝরাতে স্থলভাগ ছুঁয়েছে ঘূর্ণিঝড় ডানা। ল্যান্ডফল হয়েছে ধামারা ও ভিতরকণিকার মধ্যবর্তী এলাকায়। তবে ডানা-র ঝাপটা লেগেছে এ-রাজ্যেও। বিশেষ করে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলা ভারী বৃষ্টিপাতের সম্মুখীন হয়েছে।
মধ্যরাতে ল্যান্ডফল হওয়ায় তখন থেকেই ঝোড়ো হাওয়া ও ব্যাপক বৃষ্টির সাক্ষী দুই মেদিনীপুর, দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি। ভোরের দিকে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে কলকাতাতেও। ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’র গতিবিধি নজরে রাখতে রাতভর নবান্নে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার দুপুরেও তিনি সেখানেই। পরিস্থিতির দিকে অপলক দৃষ্টিতে সারা রাত নজর রেখেছেন। রাত আড়াইটে নাগাদও সাগর, দিঘা, গোসাবা, মথুরাপুর-সহ অন্যান্য এলাকার পরিস্থিতির খবর নেন তিনি। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলাশাসক সুমিত গুপ্তকে বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়টি নজরে রাখতে নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। এছাড়াও, রিলিফ ক্যাম্পগুলি কেমন চলছে, কতজন আশ্রয় নিতে এসেছে সে-সম্পর্কেও ঝাড়গ্রামের জেলাশাসক সুনীল আগরওয়ালকে ফোনে জানতে চান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি, বাঁকুড়া, উত্তর ২৪ পরগনা ও দুই মেদিনীপুরের জেলাশাসককেও রাতে ফোন করে আপডেট নেন মুখ্যমন্ত্রী।

আরও পড়ুন-আজ অস্কারের বেঞ্চে বসা নিয়ে জট, সমস্যার পাহাড় টপকে জয়ের খোঁজে ইস্টবেঙ্গল

আশঙ্কা থাকলেও এই রাজ্যে ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’র প্রভাবে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কোনও শিথিলতা রাখতে চাননি। তাই, শুক্রবার দুপুরে নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক থেকে জেলা প্রশাসনের আধিকারিকদের কাছে সংশ্লিষ্ট জেলার পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেন তিনি। সেখানে বসেই প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন। বিশেষ ভাবে নজর দিতে বলেন উপকূলবর্তী দুই জেলা পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার পরিস্থিতির উপরে। দুর্যোগে বহু চাষের জমি নষ্ট হয়েছে। কৃষকদের ক্ষতি কতটা, তা যাচাই করতে সমীক্ষা করানোর নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। জমা জল থেকে মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মশারি বিলির পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, যেখানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ রয়েছে, সেখানে মশারি দিতে হবে। সরকারি তৎপরতা জারি থাকবে দুই জেলায়, সারা রাত নজরদারির পর শুক্রবার দুপুরে ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর।
দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কোনও শিথিলতা রাখতে চাইছে না রাজ্য প্রশাসন। শুক্রবার দুপুরে রাজ্য প্রশাসনের এই মনোভাবের কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আবহাওয়া পরিস্থিতির সম্পূর্ণ উন্নতি না-হওয়া পর্যন্ত ত্রাণ শিবিরগুলি চলবে বলে শুক্রবার জানিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন রোগের হানা রুখতে মেডিক্যাল ক্যাম্প চালানোর নির্দেশ দেন তিনি। পর্যাপ্ত ত্রাণের বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে বলেন। এক্ষেত্রে টেলিমেডিসিন কার্যকর করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। দুর্যোগে যাঁদের বাড়ি ভেঙে গিয়েছে, তাঁদের বিষয়টি সরকার দেখবে বলে জানান। বিপর্যস্ত এলাকায় আরও দু’দিন জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দল (এনডিআরএফ) এবং রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা দল (এসডিআরএফ)-এর কর্মীদের মোতায়েন রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী যখন রাত জাগছেন, তখনই খবর আসে ঝাড়খণ্ডে বৃষ্টি হলেই ডিভিসি জল ছাড়ছে। পাশাপাশি, জেলাশাসকদের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, কোথাও পলির কারণে জল জমে থাকলে, তা খতিয়ে দেখতে হবে।

আরও পড়ুন-কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে দিল্লিতে আছেন হাসিনা

এই হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার আপামর জনতার দিদি। বাংলার অভিভাবিকা। বাংলার জন্য বিনিদ্র রজনী যাপনেও অকুণ্ঠিত। ভূভারতে অন্য কোনও মুখ্যমন্ত্রী কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জনগণের বিষয়ে এভাবে সমমর্মিতা পোষণ করেন, কেউ দেখাতে পারবেন? মানুষের জন্য এত ভাবেন, আর কেউ আছেন?
সম্ভবত নেই। সম্ভবত কেন বলছি? নেই। একজনও নেই। জনস্বার্থের ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনন্য।
একমেবাদ্বিতীয়ম।
বিগত তেরো বছরের শাসনকালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ভঙ্গিটি রাজ্যবাসী বারংবার দেখেছেন, বিবিধ ঘটনার অনুষঙ্গে। একের পর এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে নাগরিক সহমর্মিতার দূরত্ব অন্য দলের নেতা-নেত্রীর মতো কয়েক যোজন নয়। যে নেত্রী একদিন নাগরিক বিক্ষোভের পথ ধরে উঠে এসেছিলেন ক্ষমতায়, নিজে শীর্ষ শাসক হয়েও তিনি বারংবার বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তিনি জনতার পাশেই আছেন সতত। জনবিচ্ছিন্ন হননি, একবারের জন্যও।
কংগ্রেস ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন, ৩৪ বছরের বাম শাসনকে ভেঙেছেন, বিজেপি চালিত এনডিএ জোটের কার্যত কোমর ভেঙে রেখেছে যে ইন্ডিয়া জোট, তার অন্যতম প্রধান মুখও তিনি। রাজ্যে এই মুহূর্তে ঘটে চলা ঘটনাপ্রবাহের পর, বোঝাই যাচ্ছে, তিনিই মানুষের পালস বোঝেন, অন্য কেউ যা পারে না। ভোটের প্রচারে তাঁকে সামনে রেখে স্লোগান ছিল, ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’, এবং রাজনীতির সহজ সমীকরণেই বোঝা যায়, যাঁর প্রধান ইউএসপি ‘গার্লস টু দ্য নেক্সট ডোর’ । বৃহস্পতিবার দুর্যোগের রাত বুঝিয়ে দিল, তিনি এখনও ঘরের মেয়ে হয়েই আছেন। কর্তব্যনিষ্ঠ ঘরের মেয়ে। রাজ্যের প্রচণ্ড অস্থির পরিস্থিতিতে, তাঁর সরকারের বিরুদ্ধেই উঠে আসা বিপুল ক্ষোভের মাঝে তিনি আরও একবার দু’চোখের পাতা এক না করে বুঝিয়ে দিলেন, আসলে চুপ থাকার সময়ে, তিনি হিসেব করেন প্রবল দুর্যোগেও পশ্চিমবঙ্গ বাকি রাজ্যের থেকে কতটা নিরাপদ। ওটাই পালস।

আরও পড়ুন-ভারত থেকে কানাডাগামী পড়ুয়াদের মগজধোলাই করার জঘন্য চক্রান্ত ফাঁস, খালিস্তানপন্থীদের হেনস্থা নিয়ে দেশে ফিরে সরব সঞ্জয়

প্রশাসন, ভোটের রাজনীতি এবং পপুলিস্ট রাজনীতি কোথায় মিলিয়ে দিতে হয় আর কোথায় হ্যাঁচকা টান মেরে আলাদা করে দিতে হয়, সেটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে জানেন ও বোঝেন, অন্য কেউ তেমন ভাবে বোঝে কই?
দক্ষ চিকিৎসকদের মতোই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে চোখ বন্ধ করেই রাজনীতিতে মানুষের পালস কখন কোন দিকে, তা খুঁজে পান, বাকিরা তা পারে কই?
যাঁরা রোজ চিৎকৃত উল্লাসে বলেন, আমরা বাংলায় পরিবর্তন চেয়েছিলাম, এটা সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন নয়, তাঁরা রাজনৈতিক প্রণোদনার তাগিদে ভুলে যান, এই রাজ্য এমন মুখ্যমন্ত্রী আগে কখনও দেখেনি, যিনি গোটা বাংলাকে নিজের পরিবার মনে করেন এবং সেই পরিবারের বিপদের রাতে পাশে থাকেন, জেগে থাকেন। এইজন্যই, শুধু এইজন্যই, আগামী উপনির্বাচনেও রাজ্যের ছ’টি আসনে জোড়া ফুলই ফুটবে।

Latest article