গত শতকের ছয় এবং সাতের দশক। ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে বাংলা গান। নতুন ধরনের কথা। নতুন ধরনের সুর। সেই সময় কয়েকজন সঙ্গীতশিল্পী নিজেদের উজাড় করে দেন। এঁদের গায়কি ছিল স্বতন্ত্র। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
তাঁর রক্তে ছিল গান। ঠাকুরদা গজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন অসম্ভব সঙ্গীতরসিক মানুষ। একই মেসে থাকতেন কবি রজনীকান্ত সেনের সঙ্গে। নিজে ভক্তিগীতি, হরিনামের গান গাইতেন। রজনীকান্ত মান্যতা দিতেন গজেন্দ্রনাথকে। দেখাতেন গান লিখে।
বরিশালের উজিরপুরে ছিল দেশের বাড়ি। তার চণ্ডীমণ্ডপে লেগেই থাকত গান। পরিবেশিত হত রাধাকৃষ্ণের লীলাকীর্তন, রয়ানী গান, মনসামঙ্গলের আসর। ডাক পড়ত মাঝিমাল্লাদেরও। তাঁরাও প্রাণ খুলে গান গাইতেন। সারিন্দা বাজিয়ে। সারিজারি। ভাটিয়ালি। মাতিয়ে তুলতেন আসর। সেই সময় জাতিভেদ প্রথা ছিল মারাত্মক। তার মধ্যে উচ্চবর্ণের পরিবারের চণ্ডীমণ্ডপে নিম্নবর্ণের মানুষদের উপস্থিতি নজির সৃষ্টি করেছিল।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন রকমের গান শুনে শুনে বড় হয়েছেন মানবেন্দ্র। পরবর্তী সময়ে তাঁর সুরের গড়নেও পড়েছিল সেই ভিন্নতার রেশ। বাবা অতুলচন্দ্র গানবাজনা করতেন না। চাকরি করতেন। তবে অতুলচন্দ্রের উৎসাহে তাঁর দুই ভাই রত্নেশ্বর এবং সিদ্ধেশ্বর করতেন সঙ্গীতচর্চা। কাকাদের সঙ্গে হরির লুঠের আসরে রূপানুরাগ, মান, মাথুর গাইতে যেতেন মানবেন্দ্র।
বাড়িতে ছিল ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, বড়ে গোলাম আলিদের আনাগোনা। ছোট থেকেই তাঁদের দেখা এবং শোনার সুযোগ হয়েছে মানবেন্দ্রর। নানা রকমের সুর কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করত। একটু বড় হওয়ার পর জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বাড়িতে যাতায়াত শুরু। বেগম আখতার কলকাতায় এলেই ছুটে যেতেন। সংস্পর্শে আসেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ আলি আকবর খান, পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ীর। সেতারবাদক নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুতা হয়। ধীরে ধীরে গান তাঁকে পেয়ে বসে।
কাজী নজরুল ইসলামের কাছে গান শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন মানবেন্দ্র। কাকা রত্নেশ্বর ছিলেন নজরুলের বন্ধু। মুগ্ধ হয়েছিলেন মানবেন্দ্রর কীর্তনে। নিজে দুটি গান শিখিয়ে দিয়েছিলেন। গান দুটি হল ‘সখী সাজায়ে রাখ লো পুষ্পবাসর’ আর ‘হে মাধব হে মাধব’।
গায়ক-অভিনেতা রবীন মজুমদার ছিলেন তাঁর আদর্শ। মানবেন্দ্র কলেজ জীবনে চেয়েছিলেন গায়ক-অভিনেতা হতে। উত্তম-সুচিত্রা জুটির প্রথম সিনেমা ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এ অভিনয় করেছিলেন মানবেন্দ্র। ছোট্ট একটি চরিত্রে নজর কেড়েছিলেন। সেই প্রথম, সেই শেষ। সিনেমায় আর অভিনয় করেননি।
একটা সময় মিউজিক্যাল বায়োস্কোপ বানাতে চেয়েছিলেন। সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে পাঁচশো টাকায় কিনেছিলেন ‘জলসাঘর’-এর কাহিনি। যদিও সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। পরবর্তী সময়ে ছবিটি তৈরি করেন বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়।
ধীরে ধীরে আধুনিক বাংলা গানের শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মানবেন্দ্র। গাইতে থাকেন বহু সিনেমায়। অন্যান্য সুরকারদের সুরে। নিজেও সুর করেছেন। বহু কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন শ্রোতাদের। তালিম নিয়েছিলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের। তাঁর গানে লেগে থাকত ক্লাসিক্যাল টাচ।
মহানায়ক উত্তমকুমার ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কয়েকটি ছবিতে তাঁরা একসঙ্গে কাজ করেছেন। মহানায়কের ‘দেয়া নেয়া’ ছবিতে শ্যামল মিত্রর সঙ্গে মানবেন্দ্রর ডুয়েট শ্রোতাদের মনে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। উত্তমকুমার চেয়েছিলেন ‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবিতে কাজ করুন মানবেন্দ্র। কিন্তু নানা কারণে সেটা হয়নি।
একটা সময় বহু মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন নজরুলের গান থেকে। বিষয়টা মেনে নিতে পারেননি মানবেন্দ্র। আধুনিক গানের পাশাপাশি তিনি আঁকড়ে ধরেন নজরুলের গান। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নজরুলের গান গাইতে শুরু করেন। এর ফলে ঘটেছে বেশ কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনা। শ্রোতাদের একটা অংশ শুনতে চাইতেন তাঁর জনপ্রিয় গানগুলো। অথচ তিনি শোনাতে থাকেন নজরুলের গান। ফলে ঝামেলা বাধে। বিরক্ত হয়ে কয়েকবার মানবেন্দ্র নেমে এসেছেন মঞ্চ থেকেও। তবে তিনি দমে যাননি।
গ্রামাফোন কোম্পানিতে রেকর্ডিং অফিসার সন্তোষকুমার সেনগুপ্ত ছিলেন নজরুল-অনুরাগী। তিনি পাশে দাঁড়ান মানবেন্দ্রর। প্রকাশিত হয় মানবেন্দ্রর গাওয়া ‘বেস্ট লভ সঙ্গস অব নজরুল’ এলপি। তাতে ছিল দুটি গান— ‘এত জল ও কাজল চোখে’ আর ‘বউ কথা কও’। এত বিক্রি হয় যে কোম্পানি স্পেশাল ইপি করতে ডাকলেন। লেবেলে লেখা হল ‘নজরুল গীতি’। সেই প্রথম বার। আগে লেখা থাকত ‘সঙ্গস অব কাজী নজরুল’। এইভাবেই শুরু হয় গায়ক মানবেন্দ্রর নতুন সফর। দ্বিতীয় ইনিংস। নজরুলের গানকে তিনি বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। বিমান মুখোপাধ্যায় তাঁর কাছে উজাড় করে দিয়েছিলেন অসংখ্য নজরুলের গানের ভাঁড়ার। মানবেন্দ্র গান শুনিয়েছিলেন কবিকেও। কবি তখন অসুস্থ। রবীন্দ্রনাথের গানে মানবেন্দ্রর কণ্ঠ সেইভাবে পাওয়া যায়নি। জানা যায়, দেবব্রত বিশ্বাস নাকি তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের বদলে অন্য ধরনের গানে মনোযোগী হতে।
১৯২৯-এর ১১ অগাস্ট কালীঘাটে জন্ম মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের। তবে দেশের বাড়িকে ভুলতে পারেননি। আত্মীয়স্বজন, পরিচিতদের সঙ্গে কথা বলতেন খাঁটি বাঙাল ভাষায়। মানুষটি ছিলেন শিক্ষিত, সংসার-অন্তপ্রাণ। ১৯৯২-র ১৯ জানুয়ারি, ৬১ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন। তাঁর অকালে চলে যাওয়া বড় রকমের ক্ষতি করেছিল বাংলা গানের। আজ জন্মদিনে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের
স্মৃতিচারণ করলেন কন্যা মানসী মুখোপাধ্যায় এবং হৈমন্তী শুক্লা, শিবাজী চট্টোপাধ্যায়, অরুন্ধতী হোম চৌধুরী ও নচিকেতা চক্রবর্তী।
মহামানবের সুরের তীরে
অসামান্য সঙ্গীত শিল্পী। গেয়েছেন বাংলা আধুনিক ও চলচ্চিত্রের গান। সুরকার হিসেবেও পেয়েছিলেন ঈর্ষণীয় সাফল্য। নজরুলের গানকে পৌঁছে দিয়েছিলেন বাঙালির ঘরে ঘরে। তিনি মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। আজ জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করলেন অংশুমান চক্রবর্তী