মানস ভট্টাচার্য : ৮০-র ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। ভয়ানক পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম আমরা। বিদেশ, গৌতম, প্রশান্ত, প্রসূন, কম্পটন, ভাস্কর। ভারতীয় ফুটবলের সব নক্ষত্রের তখন যা-তা অবস্থা। আমারও তাই। কেউ বাড়ি থেকে বেরোতে পারছি না। বেরোলেই চারিদিক থেকে ছি-ছিক্কার! এটা কী করলে তোমরা? দেশের কথা একবারও ভাবলে না? আমরা প্রচুর বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কাজ হয়নি। শেষমেশ একদিন সুব্রতদা ডাকলেন। আমি বাটানগরের ছেলে। সেই সুবাদে চিনতেন। তারপর যা হল, সেটা শুধু ওঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল।
এশিয়াডের আগে সল্টলেকে প্রস্তুতি শিবির চলছিল আমাদের। কিন্তু প্রস্তুতি কী সারব, মশা আর নিম্নমানের খাবার-দাবারে আমাদের তখন ভয়ানক অবস্থা। অনেক বলেছি। সব জায়গায় বলেছি। কোনও সুরাহা হয়নি। এও বলেছিলাম, এরকম অব্যবস্থার মধ্যে ক্যাম্পে থাকব না। আমরা বরং বাড়ি থেকে প্র্যাকটিসে আসব। কেউ শোনেনি। শেষপর্যন্ত একদিন আমরা সবাই মিলে বেরিয়ে এলাম। তারপরই ধুন্ধুমার। যেন সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। এরমধ্যে একটি দৈনিক আমাদের দেশদ্রোহী বলে দাগিয়ে দিল। তাতেই যেন জনতার রোষে ঘৃতাহূতি পড়ল। আমরা ভয়ে বাড়ির মধ্যে গুটিয়ে গেলাম।
সুব্রতদা নিয়ম করে শনি ও রবিবার সারেঙ্গাবাদে আসতেন। উনি ওখানকার মিলন সংঘের সদস্য ছিলেন। আমিও ওই ক্লাবের সদস্য ছিলাম। দেখতাম শত ব্যস্ততার মধ্যেও সবার সঙ্গে কথা বলতেন। পুরনোদের নামে চিনতেন। খোঁজ নিতেন। তা আমাকে তখন থেকে চিনতেন বলেই সুব্রতদা একদিন ডাকলেন। ওঁর কাছে গেলাম। উনি বললেন, হ্যাঁরে, তোরা কী করেছিস যে এত লেখালেখি হচ্ছে কাগজে? ওঁকে সব বুঝিয়ে বললাম। উনি মন দিয়ে শুনলেন। তারপর বললেন, যা, আমি দেখছি। এরপরই কাগজে সুব্রতদার বক্তব্য এল। উনি বললেন, আমি দেশভক্তির সংজ্ঞা জানতে চাই। কে বুঝিয়ে বলবে আমাকে? ব্যস, সুব্রতদার এই বিবৃতির পরই যেন ক্ষোভের আগুনে জল পড়ল। সবকিছু থিতিয়ে গেল। আমরা আবার রাস্তায় বেরোলাম। মাঠে ফিরলাম। জাতীয় দলের হয়ে খেললাম। কেউ কেউ ভারতের অধিনায়ক হল। পরে বুঝেছি কী অসাধারণ দূরদৃষ্টি ছিল সুব্রতদার। দু-চারটে কথাতেই সবটা পড়ে নিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-সুব্রত মুখোপাধ্যায় মানেই আন্দোলন
মোহনবাগান অন্ত প্রাণ ছিলেন সুব্রতদা। খেলা থাকলে মাঠে আসতেন। খেলার পর পিঠ চাপড়ে দিতেন সবার। আমাকে একটু বেশিই ভালবাসতেন বাটার ছেলে বলে। আমি গোল করলে একটু বেশি পিঠ চাপড়ানি পেতাম। দেখতে দেখতে ওঁর পরিবারেরও কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। বউদি খুব ভালবাসতেন। মনে আছে সুব্রতদার ভাইয়ের বিয়ের কথা। আমার ছেলে তখন খুব ছোট। উনি বলেছিলেন ছেলেকে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসবি। তাই গেলাম। রাজ্যপাল এলেন। জ্যোতি বসু এলেন। আমি সুব্রতদা ও বউদির পাশে দাঁড়িয়ে বাড়ির ছেলের মতো ওঁদের আপ্যায়ন করলাম।
সুব্রতদা কখনও পুরনো সম্পর্ককে ভুলতেন না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যখনই সারেঙ্গাবাদে এসেছেন, সবার সঙ্গে আড্ডা মেরে যেতেন। আমার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। যখনই সমস্যায় পড়েছি, পাশে সুব্রতদাকে পেয়েছি। যেমন বাড়ি করতে গিয়ে সিমেন্ট পাচ্ছিলাম না। তখন সবারই খুব সমস্যা হচ্ছিল সিমেন্ট নিয়ে। সুব্রতদাকে বললাম। সিমেন্ট জোগাড় হয়ে গেল। মনে পড়ছে রোভার্স কাপের ঘটনা। আমরা ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়েছি। সুব্রতদা কাজে মুম্বই এসেছেন। হোটেলে ডেকে ডিনার খাওয়ালেন। দিল্লিতেও কতবার ডুরান্ড খেলতে গিয়ে ওঁকে পেয়েছি।
শুক্রবার রবীন্দ্র সদনে সুব্রতদার মরদেহর কাছাকাছিই ছিলাম। গিয়েছি কেওড়াতলা মহাশ্মশানেও। খুব কাছ থেকে মহাপ্রস্থানের দিকে এগিয়ে যেতে দেখলাম ওঁকে। মাথায় ভিড় করেছিল অজস্র স্মৃতি। ভাবছিলাম, এবার দরকার হলে কার কাছে যাব!