প্রচণ্ড গরমে বৃষ্টিবিরল কলকাতা শহরে এক নিঃসঙ্গ বাঙালির সাদাকালো জীবনবৃত্তান্ত এক রোম্যান্টিক বাস্তবতা বাংলা ছবি ‘মানিকবাবুর মেঘ’।
ব্যস্ত শহুরে জীবনে এক মধ্যবিত্তের নতুন ভালবাসার রসায়নের গল্প ‘মানিকবাবুর মেঘ’। অনেক কিছুই এই ‘মানিকবাবুর মেঘ’। কিন্তু কে এই মানিকবাবু? টুকরোটাকরা হিসেব করে চলতে চলতেই সারাজীবন অতিবাহিত হয়ে যায় মধ্যবিত্ত বাঙালির। বাজারে গিয়ে যে বাঙালি দামি মাছটি দর করেন তিনি কিন্তু কেনেন সেই সস্তার মাছটিই। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দ্যাখা যে বাঙালি— সেই বাঙালি হলেন মানিকবাবু। সামান্য কেরানির চাকরি তাঁর। তাই নিজের পেশা সেরে দিনের শেষে আবৃত্তির টিউশন করেন রোজগার বাড়াতে। বাড়িতে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত, অসুস্থ বৃদ্ধ বাবার সেবাযত্ন করেন। সকালে বাবাকে ঘুম থেকে ওঠানো, ব্রাশ করানো, মুখ ধোয়ানো। তারপর বিছানায় বসিয়ে বহু পুরনো সংবাদপত্র নতুনের মতো করে হাতে ধরিয়ে দেওয়া। কারণ বাবা যে বোঝেন না নতুন পুরনোর তফাতটা। তারপর বাজার-রান্না। কাজে বেরনোর আগে বাবাকে ভাত খাওয়ানো, খাওয়া শেষে মুখ মোছানো সবটাই অতি সাধারণ জীবনের অমোঘ রোজনামচা তাঁর। সব বিষয়েই অত্যন্ত সাধারণ এই মানিকবাবু। দালালকে কোনও লেখাপড়া ছাড়াই টাকা দিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার মতো বোকা এই মানিকবাবু। আবার তিনি রোম্যান্টিকও। ছাদের গাছপালাগুলো তাঁর বড় প্রিয়। বাবা চলে যাবার পর বাড়িওয়ালা যখন তাঁকে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলে তখন গাছগুলো নিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়া মানিকবাবুর।
আরও পড়ুন-ইউরোপের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় উত্তরপাড়ার শুভমের
একরত্তি ছোট্ট আকাশের তলায় একাকী মানিকবাবু। আকাশের মেঘপুঞ্জের মাঝে তার বাস। মেঘরাই তাকে পথ চেনায়। এদিক-সেদিক নিয়ে যায়। এক ছায়াজগতের মানুষ এই মানিকবাবু। সূর্যের আলো নয় মেঘেরাই তার সঙ্গী। ধীরে-ধীরে এই মেঘেরাই একদিন হয়ে ওঠে মানিকবাবুর বন্ধু, ‘মানিকবাবুর মেঘ’। স্বভাব-ভিতু মানিকবাবু তাকে ভয় পেলেও সেই মেঘেরা কিন্তু নাছোড়বান্দা, তাঁর সঙ্গে এগিয়ে চলে, শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে। এই মেঘরাই একদিন নিঃসঙ্গ মানিকবাবুকে শেখায় প্রেমিকা রূপে ভালবাসতে। তখন মানিকবাবু মেঘের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। তার শূন্য জীবনে নেমে আসে স্নিগ্ধ ছায়া, সমাধান হয় তার সব অশান্তির। আসলে আমরা নিজেই নিজের আসল বন্ধু। আর আকাশ বাতাস, মেঘ, বৃষ্টি, পাখ-পাখালি আমাদের আমির সঙ্গে পরিচয় করায়। তখন দূর হয়ে যায় নিঃসঙ্গতা।
‘মানিকবাবুর মেঘ’, যার ইংরেজি নাম ‘দ্য ক্লাউড অ্যান্ড দ্য ম্যান’। অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত প্রথম বাংলা ছবি। যে ছবির জন্য এর আগে রাশিয়ার প্যাসিফিক মেরিডিয়ান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ প্রধান অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন চন্দন সেন। বিভিন্ন দেশের ৩৮টি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় মোট ১৪টি নমিনেশন ও পুরস্কার পেয়েছে। অভিনেতা চন্দন সেন যাঁকে নিয়ে আলাদা করে বলার মতো কিছু নেই। অভিনয় গুণে বরাবর নজর কেড়েছেন তিনি। চ্যালেঞ্জিং অভিনয়ের প্রতি বরাবর ঝোঁক তাঁর। বারবার প্রমাণ করেছেন নিজেকে। ‘মানিকবাবুর মেঘ’ তাঁর সেরা অভিনয়গুলোর অন্যতম। সাদা-কালোয় এই ছবির বিভিন্ন দৃশ্যকল্পে ফুটে উঠেছে আধুনিক শহরের কিছু রয়ে যাওয়া প্রাচীন মূল্যবোধ। এ-শহর এখনও যে শুধুমাত্র শপিংমল আর উচ্চ-মধ্যবিত্তের সম্পর্কের টানাপোড়েনে আবদ্ধ নেই সেই বাস্তবটাই ধরা পড়েছে ছবির প্রতিটি ফ্রেমে।
আরও পড়ুন-সাজ-সাজ রব হাওড়ায় প্রস্তুতি ভিড় সামলাতে, একুশে কর্মীরা আসবেন রেল ও জলপথে
ছবিটি দেখতে বসলে মনে হবে চন্দন সেন কোনও অভিনেতা নন, এক জীবন্ত মানুষ। প্রতিদিনের জীবনসংগ্রামে যে মানুষ মরে বেঁচে থাকে, হঠাৎ-ই এক টুকরো মেঘের সঙ্গে গড়ে ওঠা তার সখ্য। রোজ হেরে বসে থাকা মানিকবাবু এখানেই জিতে যান।
এই ছবিতে তাঁর অসাধারণ অভিনয় প্রসঙ্গে অভিনেতা বললেন, ‘ছাত্রজীবন থেকে যে অভিনয়-শিক্ষা চলছে, সেই শিক্ষারই প্রতিফলন এই ছবি। যে সুযোগ আমাকে দেওয়া হয়েছে তার ষোলো আনাই কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছি।’ আমার মা সারাজীবন চেষ্টা করে গিয়েছেন, এমনকী না খেয়েও ঈশ্বরের কাছে কামনা করে গেছেন যাতে আমি যা চাই, তাই যেন পাই। আজ তাঁর কথাই বারবার মনে আসছে।
চন্দন সেন ছাড়াও এই ছবিতে অভিনয় করেছেন ব্রাত্য বসু, দেবেশ রায়চৌধুরী, অরুণ গুহঠাকুরতা, নিমাই ঘোষ প্রমুখ দক্ষ শিল্পী। প্রথম কাজ হিসেবে যে সাহস পরিচালক দেখিয়েছেন অন্য কোনও পরিচালক হলে হয়ত এমন কিছু করার সাহস করতেন না। এই ছবির প্রযোজক বৌদ্ধায়ন মুখার্জি এবং মোনালিসা মুখার্জি। ছবির পরিবেশক অনির্বাণ ভট্টাচার্য। ক্যামেরায় রয়েছেন অনুপ সিং। নিজের ছবি প্রসঙ্গে পরিচালক অভিনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, বর্তমানে বিশ্বের দরবারে আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত, ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরীর মতো মাত্র কয়েকজন বাঙালি পরিচালকের ছবি বিদেশে পৌঁছয়, প্রশংসিত হয়। বিদেশের মাটির মতো এ-দেশেও যদি ‘মানিকবাবুর মেঘ’ গৃহীত হয়, তাহলে একটা বার্তা পৌঁছবে। এরকম ছবি আরও তৈরি হতে পারে। ফের সাহস পাব এ-ধরনের ছবি তৈরি করার। যদি এ-ছবি মানুষের ভাল লাগে সেটা আখেরে বাংলা ছবির লাভ। এটুকুই বলার। ছবির শেষভাগে অনির্বাণের কণ্ঠে ‘তোমার আমার গল্প হত’ গানটা অপূর্ব লাগে শুনতে। সংলাপের বাহুল্য নেই অথচ কী বাঙ্ময় গোটা ছবি। দর্শকের দরবারে সেরা।