কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সমসাময়িক লেখকদের থেকে স্বতন্ত্র। আবির্ভূত হন কল্লোল যুগে। সাবলীল ভাষা শব্দ ব্যবহারে আশ্চর্য পারদর্শী। সাহিত্যে তুলে ধরেছেন মানব জীবন ও সমাজ জীবনের অবক্ষয়। সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরে প্রবেশ করে নিরীক্ষার মাধ্যমে মনোজাগতিকতাকে নিজের মধ্যে ধারণ করে রচনা করেছেন গল্প, উপন্যাস, কবিতা। আজীবন নতুন ধারার সাহিত্য রচনায় প্রত্যয়ী ছিলেন। গ্রামীণ জনপদের জনসাধারণের প্রেম, মনোভঙ্গি, হৃদয়বৃত্তি, দহন তাঁর সাহিত্যে ক্রিয়াশীল। দারিদ্রপীড়িত মানুষের মনের পীড়ন ভাঙন অসহায়ত্ব, চিত্তের আলোড়ন তাঁর সাহিত্যে বারবার ফুটে উঠেছে। নর-নারীর সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা দক্ষতার সঙ্গে তিনি তুলে ধরেছেন। তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি তাঁকে করে রেখেছে চিরস্মরণীয়। চারটি উপন্যাসের উপর আলোকপাত করা যাক।
আরও পড়ুন-ইডেনের ফাইনাল নিয়ে এখনও আশাবাদী সৌরভ
‘পদ্মা নদীর মাঝি’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস। ১৯৩৪ সালে ধারাবাহিকভাবে ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। পৃথিবীর বহু ভাষায় অনূদিত উপন্যাসটিতে জেলে সম্প্রদায়ের জীবন কাহিনি বিস্তৃতভাবে বিবৃত হয়েছে। কুবের উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। তিনি মাঝি। সংসারের প্রতি দায়বদ্ধ। শিরদাঁড়া সোজা রেখে চলেন। তবে একটা সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তাঁকে বাধ্য হতে হয় অন্যের কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করতে। উপন্যাসের নায়িকা কপিলা। ব্যক্তিগত পরিচয়ে কুবেরের স্ত্রী মালার বোন। সাংসারিক পরিচয়ে তিনি একজনের স্ত্রী। পুরুষের হৃদয়ে আদিম আবেদন সৃষ্টিকারী। কুবেরের সঙ্গে যেন উদাসীনভাবে প্রেমের অভিনয় করে যান। রহস্যময় অথচ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হোসেন মিয়া। বহুদর্শী ও অভিজ্ঞ এক ব্যক্তি। উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে গৌতম ঘোষের পরিচালনায়।
‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধ্রুপদিধারার আরও একটি শিল্পসফল উপন্যাস। প্রকাশিত হয়েছে ১৯৩৫-৩৬ সালে। এই উপন্যাসে তিনি মানুষের জীবন যাপনের বিচিত্র বোধকে স্বকীয়তায় ধারণ করেছেন। প্রধান চরিত্র শশী। কল্পনাবিলাসী চিকিৎসক। বয়সে তরুণ। তাঁর সঙ্গে বন্ধুতা হয় শ্যামবর্ণা লম্বা চেহারার কুমুদের। তিনি প্রচণ্ড বেপরোয়া ও খ্যাপাটে স্বভাবের। আর এক নারী চরিত্র মতি। তিনি সরল, নম্র। এঁদের কেন্দ্র করেই দানা বেঁধেছে কাহিনি। যথার্থভাবে উন্মোচিত হয়েছে মানুষের নানা স্বরূপ।
১৯৫১ সালে প্রকাশিত হয়েছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চতুষ্কোণ’। উপন্যাসে মানব মানবীর জৈবিক কামনাকে প্রতিপাদ্য করা হয়েছে। মূল চরিত্র রাজকুমার। তিনি মফস্বল শহরের শিক্ষিত যুবক। তাঁর জীবন ঘিরে চারজন নারী— গিরি, মালতি, সরসী, রিনি। চলতে থাকে টানাপোড়েন। সম্পূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক কাহিনি।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পাশাপাশি’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৫২ সালে। উপন্যাসের নায়ক সুনীল। তাঁকে প্রত্যহ সংগ্রাম করতে হয় রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে। টিউশনির পাশাপাশি অর্থ উপার্জন করেন অন্যদের টাইপরাইটিং ও স্টেনোগ্রাফি শিখিয়ে। মায়ার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তবে মনের গভীরে শিহরন জাগানোর মতো কোনও পরিস্থিতি রচিত হয় না। নন্দার সঙ্গে সুনীলের পরিচয় হয় টিউশনি সূত্রে। উপন্যাসের অনেক চরিত্রের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন দেখা যায়।
আরও পড়ুন-ফের হার ম্যান ইউয়ের
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে বারবার ভেঙেছেন। তাঁর লেখার বাঁক বদল ঘটেছে বিভিন্ন সময়। ফলে প্রতিটি উপন্যাসই হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র। মৌলিক। একটার সঙ্গে আরেকটার কোনও মিল নেই। সেই কারণেই আজও তিনি পঠিত, চর্চিত।