মালা রায়
একুশে জুলাই আমাদের আবেগ। মানুষের দাবিতে, সচিত্র পরিচয়পত্রের দাবিতে সেই আন্দোলন। সেইসময় দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষ ভোটাধিকারের দাবি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে একটা আন্দোলনের আবেদন জানিয়েছিলেন। মানুষের সেই দাবি অনুযায়ী ১৯৯৩ সালের একুশে জুলাই যুব কংগ্রেসের সভানেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাচন কমিশনের সেইসময়ের দফতর মহাকরণ অভিযানের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।
আমাদেরও বয়স তখন কম। সেই ঐতিহাসিক দিনে বিভিন্ন জেলা থেকে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনে যুব কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকরা শহরের পাঁচটি জায়গায় জমায়েত করেছিল। কিন্তু তখনও তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। তাই যুব কংগ্রেসের নেত্রী হিসেবে যুবদের নিয়েই গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু সেইসময় তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্ব গণআন্দোলনে শামিল হয়নি।
আমিও ব্যক্তিগতভাবে সেদিনের সেই আন্দোলনে ছিলাম। বিশেষ করে টি-বোর্ডের কাছে যে জমায়েত হয়েছিল, সেখানে আমিও ছিলাম। কিছুক্ষণ পরই প্রতিবাদী জমায়েত যখন ধীরে ধীরে মহাকরণমুখী হতে শুরু করল, সেইসময় দেখলাম গুলি চলছে। জমায়েত ছত্রভঙ্গ হচ্ছে। কিছু মানুষ প্রাণভয়ে দৌড়চ্ছে, কিছু মানুষের পদপিষ্ট হওয়ার পরিস্থিতি। সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত বিশৃঙ্খলা। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমরা তখন টি-বোর্ড থেকে ক্রমশ ধর্মতলার দিকে এগোতে থাকলাম। পথচলতি বহু মানুষ আমাদের বলছিলেন, ওদিকে যাবেন না। ব্যাপক গোলাগুলি চলছে! কারণ, মানুষ তখনও জানত না কী হচ্ছে না হচ্ছে। ওদিকের মানুষ এদিকে আসতে পারছেন না, এদিকের মানুষ ওদিকে যেতে পারছেন না। গুলির শব্দে হুড়োহুড়িতে প্রচুর মানুষ পদপিষ্ট হয়েছিলেন। তেরোজনের তো প্রাণটাই চলে গেল। যাঁরা আহত হয়েছিলেন, তাঁদের দেখতে আমরা সেই পরিস্থিতিতে পিজি হাসপাতালে দৌড়ালাম। অন্যান্য হাসপাতালেও কিছু মানুষকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই স্মৃতি যেন এখনও টাটকা। সেই গণআন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সারা বাংলার মানুষ সচিত্র পরিচয়পত্র হাতে পেয়েছিল।
আরও পড়ুন-নেত্রীর আন্দোলনের ফসল ভোগ করছেন দেশবাসী
সেই আন্দোলনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনে সাহস জুগিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার স্বার্থে, বাঙালির স্বার্থে তারপরও বহু আন্দোলনে শামিল হয়েছেন তিনি। নন্দীগ্রাম থেকে নেতাই-সিঙ্গুর, একের পর এক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন থেকেই তাঁর প্রতি বাংলার মানুষের আস্থা ক্রমাগত বাড়ছিল। উনি চেয়েছিলেন, সিপিএমের বর্বরতার বিরুদ্ধে সরব হোক কংগ্রেসও। কিন্তু কোনও কংগ্রেস নেতৃত্ব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে কোনও আন্দোলনে শামিল হননি। বরং তাঁকে অপদস্থ করার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা-চক্রান্ত চলছিল। এমনকী যখন সভাপতি পদে লড়াই হল, তখনও পিছন থেকে ছুরি মারল কংগ্রেস। সেই নির্বাচনের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম আমরা। সেই ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই জিততেন। কিন্তু সেখানেও কংগ্রেসের লোকজন চক্রান্ত করে তাঁকে হারিয়ে দিল। যদিও সেই হারের পর তিনি আরও বেশি করে আন্দোলনমুখী হয়ে পড়লেন।
৩৪ বছরের বাম আমলে প্রচুর মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। প্রায় ৫৬ হাজার রাজনৈতিক খুন হয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেস কিংবা অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের কোনও নেতাকে দেখিনি নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে। শুধুমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই দেখলাম, এত বছর পরও ১৯৯৩ সালের একুশে জুলাইয়ের সেই শহিদদের ত্যাগ তিনি ভোলেননি। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০২৫ পর্যন্ত এখনও এই দিনটিকে আমরা শহিদ দিবস হিসেবে স্মরণ করি। শহিদদের পরিবারকে মঞ্চে এনে তাঁদের সম্মান জানানো হয়। ১৩ শহিদের পরিবার সেইসময় নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর্থিক সাহায্য থেকে শুরু করে ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার দায়ভার নিয়ে সেই শহিদ পরিবারগুলির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ তিনি বাংলার তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী। অনেকেই সরকারে থাকলে পুরনো দিনের কথা, পুরনো আন্দোলনের কথা ভুলে যান। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু সেই আন্দোলনের কথা, ১৩ শহিদের আত্মত্যাগের কথা ভুলে যাননি। তাই আজও তিনি শহিদ পরিবারগুলির পাশে রয়েছেন, নিয়মিত তাঁদের খোঁজখবর নেন।
আমি নিজে ১৯৭৩ সাল থেকে ছাত্র পরিষদ করে বড় হয়েছি। আজকে ২০২৫ সাল। বহু আন্দোলন দেখেছি, বহু সরকার দেখেছি, বহু মুখ্যমন্ত্রী দেখেছি, বহু নেতা-নেত্রী দেখেছি। কিন্তু এত মানবিক মুখ্যমন্ত্রী কখনও দেখিনি। আজও বাংলার কোনও কোণায় কোনও ঘটনা ঘটলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির খোঁজ নেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন; সেটা অনেক মানুষই ভুলে যান। কিন্তু তিনি ভোলেন না।
আজও বাংলার মানুষের জন্য বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে, বঞ্চনার বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রয়োজনে তিনি প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে বাংলার ১০ কোটি মানুষের ন্যায্য দাবিদাওয়া ছিনিয়ে এনেছেন। এটা তাঁর স্বভাবজাত কর্ম। তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ, বিধায়ক-সহ জনপ্রতিনিধিরা তাঁর এই মানবিক ভূমিকার জন্যই তাঁর সঙ্গে, তাঁর পাশে রয়েছি। দলের নেতা-মন্ত্রী থেকে শুরু করে একেবারে তৃণমূলস্তরের কর্মী পর্যন্ত, যার সঙ্গেই তাঁর আলাপ রয়েছে; তিনি সবার প্রতি মায়ের ভূমিকা পালন করেন। এরকম নেত্রী আমি আর দেখিনি।
কিন্তু তাঁকে বারবার অর্থনৈতিকভাবে, মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়ার চক্রান্ত হয়ে চলেছে। তবু এইসব কিছুর বিরুদ্ধে আমাদের নেত্রী আগেও লড়েছেন, আগামীতেও লড়বেন।