গতকালই চলে গেল ১৩ মে। মা-মাটি-মানুষের সরকারের ১৪ বছর পূর্ণ হল। ২০১১ সালের ১৩ মে ৩৪ বছরের বাম শাসনের পতন ঘটিয়ে বাংলার মানুষের সেবা করার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাম জমানার শেষের দিকে যখন রাজ্য জুড়ে চলছে অপশাসন, হিংসার আগুনে জ্বলছে বাংলা, তখন বিপুল জনাদেশ মাথায় নিয়ে প্রথমবারের জন্য মা-মাটি-মানুষের সরকার তৈরি করেছিলেন জননেত্রী। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার রক্ষার সংগ্রামের পায়ের তলার মাটি শক্ত হয়। তখন বাংলার মসনদে বামাচারীর দল। তাদের পতন ছিল কেবল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে প্রথমবারের জন্য বাংলার মাটিতে মা-মাটি-মানুষের সরকার প্রতিষ্ঠার জনাদেশ দিয়েছিলেন বাংলার মানুষ। ২০১১ সালের ১৩ মে তাই কলকাতার লালবাড়িতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে জনকল্যাণকর সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই লালবাড়ি যেখান থেকে একসময় তাঁকে ‘চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে টেনে’ বার করে দেওয়া হয়েছিল। এ যেন সময়ের বিস্ময়কর বিবর্তন! সেই লালবাড়িতে প্রথম পা দিয়ে তাঁর বজ্রনির্ঘোষ ধ্বনি সেদিন শুনেছিল বাংলার মানুষ।
গতকাল ১৩ মে, ২০২৫ ছিল মা-মাটি-মানুষের সরকারের ১৪ বছর পূর্তি। ইতিমধ্যে মানুষের বিপুল জনাদেশে তৃতীয়বারের জন্য তিনি নির্বাচিত হয়ে নীলবাড়ি দখল করেছেন। তবে শেষবারের নির্বাচনে প্রধান প্রতিপক্ষ লাল ছিল না, ছিল গেরুয়া। সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২০০-র বেশি আসন নিয়ে তৃতীয়বারের জন্য সরকার গঠন করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যে গেরুয়া ঝড়ে ২০১৯-র লোকসভায় তৃণমূল কংগ্রেস যখন কার্যত পর্যুদস্ত, তখন কি এমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবিচলিত শক্তি, নাকি গত দু’দফায় অভাবনীয় সাফল্য, যে কারণেই হোক তৃতীয়বারের জন্য সরকার গঠনে বিন্দুমাত্র সমস্যায় পড়তে হয়নি তৃণমূল কংগ্রেসকে। আসলে, বাংলার মানুষের সার্বিক উন্নয়নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের অভাবনীয় কর্মযজ্ঞ এই ফলাফলে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না!
ক্ষমতায় এসেই মা-মাটি-মানুষের সরকার সাধারণ মানুষের জীবন ধারার মানোন্নয়নে মনোনিবেশ করেছে। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, পানীয় জল ইত্যাদির পাশাপাশি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এনেছে বিপুল পরিবর্তন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গত ১৪ বছরের সাফল্যের খতিয়ানে মাস্টারস্ট্রোক ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্প, তাও আবার বাড়ির একজন মহিলার নামে। যে প্রকল্পের আওতায় সেই মহিলার বাপের বাড়ির এবং শ্বশুরবাড়ি সদস্যরা চিকিৎসা ক্ষেত্রে সরকারি সুবিধা পেতে পারেন। বাড়ির মহিলার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন সুখী গৃহকোণের প্রথম শর্ত বাড়ির মহিলা।
সেই সঙ্গে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। বঙ্গের নারীশক্তির ক্ষমতায়নের প্রতীক। সেই প্রকল্পের সাফল্য এখন বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিকে বাধ্য করেছে সামাজিক নিরাপত্তামূলক প্রকল্পের মধ্যে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্প অঙ্গীভূত করতে। ফেল করা ছাত্ররা টুকে পাশ করতে সদা মরিয়া। এও তেমনটাই আর কী!
দ্বিতীয়ত, কন্যাশ্রী ও সবুজসাথী প্রকল্প। এই প্রকল্প দু’টির আওতায় বাড়ির পড়ুয়া মেয়েদের প্রতি বিশেষ সম্মান জানানো হয়। সাধারণত গ্রামাঞ্চলে বাড়ির মেয়েদের পুরুষদের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয়। কিন্তু কন্যাশ্রী প্রকল্পের আওতায় ঘরের কন্যারা সম্মানের সঙ্গে পড়াশোনার সুযোগ পায়। তাই কন্যাশ্রী তো আজ বিশ্বশ্রী উপাধিতে ভূষিত। সবুজসাথী প্রকল্পে সাইকেল দিয়ে পড়ুয়াদের বিদ্যালয় যাওয়ার পথ সুগম হয়েছে। ১৮ বছর বয়স হলেই বাড়ির মেয়েরা রূপশ্রী প্রকল্পের আওতায় এককালীন ২৫ হাজার টাকা পায়। তাই ১৮ বছরের আগে বাল্যবিবাহ অনেকটাই কমেছে রাজ্যে। কমেছে স্কুলছুটের সংখ্যাও।
আরও পড়ুন-লক্ষ্য, ২০২৬-এর বিধানসভা ভোটে বীরভূমের ১১ আসনেই তৃণমূলের জয়, এ মাসেই দেড় লক্ষ মানুষের মিছিল
মা-মাটি-মানুষের সরকার গত ১৪ বছরে কৃষকদের দিকে বারবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কৃষকদের সাহায্য করতে চালু করেছে ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্প। তার পাশাপাশি মিউটেশন ছাড়-সহ অন্যান্য সুবিধা প্রদান সাফল্যের খতিয়ানে লিপিবদ্ধ। ভূমিহীন কৃষকদের পাট্টাপ্রদান কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঋণমকুবের মতো কাজে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মা অন্নপূর্ণার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। গ্রাম-শহরের সৌন্দর্যায়নে প্রশংসা কুড়িয়েছে এই সরকার। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সমস্যা, পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থা অনেকটা উন্নত হয়েছে।
এই সরকারের জমানায় ভুলত্রুটি একেবারেই নেই বলা যায় না। কিন্তু সেই ভুল ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা চলছে নিরন্তর। আর সেই সংশোধন প্রয়াসের মধ্যেই উঠছে বড় বড় ঢেউ। টালমাটাল করে দিতে চাইছে নৌকাটাকে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃঢ় জনভিত্তি আর সমস্যা সমাধানকল্পে আন্তরিকতা, সব তরঙ্গ অতিক্রম করে, পাল তুলে অগ্রসরমান।
“আমরা চলি সমুখ পানে, / কে আমাদের বাঁধবে/ … চলব ছুটে রৌদ্র ছায়ে, / জড়িয়ে ওরা আপন গায়ে/ কেবলই ফাঁদ ফাঁদবে।/ কাঁদবে ওরা কাঁদবে।”