বাঙালির কাছে ক্রিসমাস বড় আনন্দের বড়দিন। বারো মাসে তেরো পার্বণের অন্যতম তো বটেই। শীতের কলকাতার বড়দিন শুধু শিশুদের নয়, আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে যেন সান্টাক্লজ হিসেবে ধরা দেয়। বলাবাহুল্য, কেক-পেস্ট্রি আস্বাদনের মধ্যে শারদোৎসবের বর্ধিত যাপন চলে। ইংরেজি বর্ষবরণের আগে এক আনন্দঘন সন্ধিক্ষণ!
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর বড়দিনের আবেগ-উচ্ছ্বাস অনেক বড় আকার নিয়েছে রাজ্য তথা কলকাতায়।
পার্ক স্ট্রিটের অ্যালেন পার্কে ক্রিসমাস কার্নিভালের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে যিশুর মাহাত্ম্য, তাঁর শান্তির বাণীর কথা তুলে ধরেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পাশাপাশি, বড়দিনের জাতীয় ছুটি তুলে দিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার উগ্র ধর্মান্ধতার বকলমে যে নিচ মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে তার তীব্র সমালোচনা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রসঙ্গত, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিও কেন্দ্রের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নিজ নিজ রাজ্যে বড়দিনের ছুটি বাতিল করেছে।
আরও পড়ুন-বড়দিনের উপহার সাংসদের
মুখ্যমন্ত্রী এও বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে যথারীতি বড়দিনের সরকারি ছুটি বহাল থাকছে। বাংলা যে ভারত সরকারের মধ্যযুগীয় অপসংস্কৃতির তীব্র বিরোধী তাও স্পষ্ট করেছেন তিনি।
বস্তুত, বড়দিনকে কেন্দ্র করে ফের বিজেপির সংকীর্ণ মানসিকতা চলে এসেছে প্রকাশ্যে। ধর্মীয় ভেদাভেদের সেই জরাজীর্ণ বদ-অভ্যেস।
ভারতের সুপ্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ যদিও বিজেপির এই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাকে সমর্থন করে না।
গৌতম বুদ্ধের শান্তির বাণী, সর্ব ধর্ম সমন্বয়ে মহামতি আকবর প্রস্তাবিত দিন-ই-ইলাহি, চৈতন্যদেবের সাম্যবাদ থেকে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবের ‘যত মত তত পথ’-এই নিহীত ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের পরম্পরা। সঙ্গে অতি অবশ্যই জেসাস ক্রাইস্টের ক্ষমা-ই পরম ধর্ম-র সহিষ্ণুতা।
‘শিবজ্ঞানে জীব সেবা’র কথা বলতেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস। তাঁর প্রিয়তম শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দের কথাতেও গুরুর প্রতিধ্বনি, ‘জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’ মহাপুরুষরা এভাবেই যুগে যুগে জীব সেবার বার্তা দিয়েছেন। মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরকে খুঁজে নিয়েছিলেন তাঁরা। নিশ্চিতভাবে, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যেও সেই ঐশ্বরিক শক্তির স্ফুলিঙ্গ বিরাজমান। মমতা তো তাঁর নামের মধ্যেই বর্তমান। তার সঙ্গে দয়া ও ক্ষমার ত্র্যহস্পর্শে তিনি অনন্যা।
প্রভু যিশুর ওপর যারা পাশবিক অত্যাচার নামিয়ে এনেছিল, নির্মমভাবে ক্রুশবিদ্ধ করেছিল তাদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন যুগাবতার এই মহাপুরুষ। তিনি বলেছিলেন পাপকে ঘৃণা করতে, পাপীকে নয়। অজ্ঞানতার জন্য ওরা এই পাপকাজে লিপ্ত হয়েছে ভেবে শত শারীরিক নির্যাতন-কষ্টের মধ্যেও প্রাণ কেঁদে উঠেছিল যিশুখ্রিস্টের।
আমাদের মানবিক মুখ্যমন্ত্রীও প্রভু যিশুর মতোই ক্ষমার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছেন যুযুধান প্রতিপক্ষ সিপিএমকে। যাদের ভয়ঙ্কর অত্যাচারে পদে পদে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, রক্তাক্ত হয়েছেন, সেই সিপিএমের প্রতি প্রতিহিংসার রাস্তায় হাঁটেননি তিনি। বেছে নিয়েছেন ক্ষমা ও অহিংসার পথ। যিশু, শ্রীচৈতন্য, গৌতম বুদ্ধ ও মহাত্মা গান্ধীর আদর্শের প্রতিফলনে ২০১১-র পালাবদলের পর মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘বদলা নয় বদল চাই।’ সিপিএমের অত্যাচার ও স্বৈরতন্ত্রের অবসান চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, সাধারণ সিপিএম তথা বামপন্থী নেতা, কর্মী-সমর্থকদের যাতে রোষানলের মুখে পড়তে না হয় সেদিকে একজন মমতাময়ী অভিভাবকের মতো সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলেন। সাঁইবাড়ি, মরিচঝাঁপি, আনন্দমার্গী, বানতলা, ধানতলা, সিঙ্গুর, নেতাই, নন্দীগ্রামে পৈশাচিক অত্যাচার চালানো সিপিএম যে ক্ষমার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না, তার সার্থক রূপায়ণ ঘটিয়েছেন বাংলার মানবিক মুখ্যমন্ত্রী।
আরও পড়ুন-গেরুয়া সরকারের অপদার্থতা, অসমে অব্যাহত বাল্যবিবাহ
যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে বড়দিনে সারা দুনিয়ার সঙ্গে আবেগে উচ্ছ্বাসে ভেসে যায় আমাদের বাংলা। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, জেরুজালেমে থাকলে চোখের জলে নয়, যিশুর পা তিনি ধুয়ে দিতেন হৃদয়ের রক্তক্ষরণে। পরবর্তীতেও পরমপিতার প্রতি শ্রদ্ধার সেই ধারা অব্যাহত থেকেছে সমানতালে।
কবিগুরুর আমল থেকেই শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলায় বড়দিন উপলক্ষে বাইবেল পাঠ, প্রার্থনা-সহ নানা উপাচারের মধ্যে বড়দিন উদযাপিত হয়। বিদেশে থাকলেও বাঙালির প্রাণের ঠাকুর রবিঠাকুর এই বিশেষ দিনে প্রভু যিশুর আরাধনায় মেতে উঠতেন। বাংলায় বড়দিনের সেই মহান সংস্কৃতি আজও অটুট। এবারেও যথারীতি ধুমধাম সহকারে বাংলায় বড়দিন পালিত হচ্ছে।
বিশ্বপিতা যিশু যে বাংলা ও বাঙালির একান্ত আপন। লালনের ভাষায় মনের মানুষ। এহেন ঘরের মানুষটির জন্মদিন যাপন বলে কথা। কেক খাওয়া তো মাস্ট। ঠিক যেমন কৃষ্ণের জন্মদিনে তালের বড়া খেয়ে নন্দোৎসবে মাতোয়ারা হই আমরা। জেসাস ক্রাইস্ট আর আমাদের কেষ্ট ঠাকুর কোথাও যেন মিলেমিশে একাকার। যে রূপে দেখবে তাতেই ধরা দেবেন তিনি।
সম্প্রতি, পার্ক স্ট্রিট এলাকার শর্ট স্ট্রিটের নতুন নামকরণ হয়েছে সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার সরণি। বড়দিনের মধ্যরাতের প্রার্থনায় বরাবরের মতো অংশ নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
বলাবাহুল্য, রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে বড়দিনের পার্ক স্ট্রিট যেন ব্যাবিলন, নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, রোমের কোলাজ হয়ে ওঠে। শুধু আলোকসজ্জা, চাকচিক্য বা আড়ম্বরের ঘনঘটায় নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে‘ধর্ম যার যার— উৎসব সবার’ এটাই মহামন্ত্র হয়ে উঠেছে বাংলায়। রেড রোডে ইদের নামাজ থেকে বড়দিনে যিশুর উপাসনা, কার্নিভালের মাধ্যমে দুর্গাপুজোর আন্তর্জাতিকীকরণ, গুরু নানক থেকে গৌতম বুদ্ধ—জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা এটাই। যা নিয়ে রীতিমতো গর্ব করা যায়। সম্প্রীতির সমাদরে উষ্ণতা লাভ করি আমরা। আজও বাংলার উদারতার আলোকে প্রজ্বলিত হয় গোটা দেশ।
বাংলা ও বাঙালির এই উদার মানসিকতার উদাত্ত কণ্ঠ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বমাঝারে।
অপরদিকে, বড়দিনের ছুটি তুলে দিয়ে ঘুরপথে যেন ব্রিটিশের কাছে মুচলেকা দেওয়া সাভারকর কিংবা গান্ধী হত্যাকারী গডসের জন্মদিন পালনের পথে হাঁটছে দিল্লির জমিদাররা।
তাই তো প্রভু যিশুর জন্মদিনে আমাদের শপথ হোক, হে বিশ্বপিতা, যতবার তোমার সন্তানদের ওপর ধর্ম, জাতপাতের বিষ ধেয়ে আসবে ততবার যেন আমরা সেই বৈষম্যকারী, বিভেদকামীদের ছত্রভঙ্গ করতে পারি। সুজলা,সুফলা রবীন্দ্র-নজরুল-মাইকেল মধুসূদনের বাংলায় সাম্প্রদায়িক শক্তির কোনও ঠাঁই নেই। বড়দিনের পবিত্র ক্ষণে সম্প্রীতির এই আবহ বাংলার আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ুক। গির্জার পবিত্র ধ্বনিতে কেটে যাক ধর্মান্ধতার অভিশাপ।