পচা ভাদ্রের দুপুরের প্যাচপেচে গরমে আপ নৈহাটি লোকাল শিয়ালদা থেকে সবেমাত্র ছেড়েছে, আমার গন্তব্য ইছাপুর। হিন্দি খবরের কাগজের একটি পাতা হাতে নিয়ে আমার ডানপাশে বসা দুই মাঝবয়সি ভদ্রলোক ভীষণ উত্তেজিত স্বরে রাজনৈতিক আলোচনায় মত্ত, একজন ভাঙা বাংলায় ও আরেকজন পরিষ্কার বাংলায়। কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম দুজনেই মোদি-ভক্ত। বিষয়, মমতার প্রশ্রয়ে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকে এদেশে সব শেষ করে দিচ্ছে! অনেকক্ষণ ওঁদের উত্তেজক, প্ররোচনামূলক কথাবার্তা শুনছি, আশেপাশের অনেক যাত্রীর চোখমুখ দেখে বুঝতে পারছি তাঁরাও বেশ প্রভাবিত হয়ে পড়ছেন ওঁদের কথাবার্তায়। ট্রেন বেশ গতি নিয়ে বিধাননগর ছেড়ে দমদম অভিমুখে, আর সহ্য করে থাকতে পারলাম না…
আরও পড়ুন-সংবিধান বিরোধী বিলের প্রতিবাদে সরব তৃণমূল
আমি : দাদা কিছু মনে করবেন না, আমি আপনাদের আলোচনায় বাধ্য হয়ে অনুপ্রবেশ করলাম, একটা প্রশ্ন করতে চাই আপনাকে, প্লিজ উত্তরটা দিন, সীমান্ত কারা পাহারা দেয়? আর তারা কাদের আদেশ মেনে কাজ করে? আর গত ১০ বছরে অনুপ্রবেশকারীদের ভারতে আসার হার কমেছে না বেড়েছে?
ভক্ত : (চমকে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড মেপে নিয়ে) বর্ডার পাহারা দেয় বিএসএফ, ওদের নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র দফতর। অনুপ্রবেশের হার বেড়েছে কিনা সেটা বলতে পারব না, তবে এদের জন্য রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে, মহিলাদের নিরাপত্তা নেই এটা তো মানেন।
আরও পড়ুন-ইডির ভারপ্রাপ্ত অধিকর্তা হিসেবে রাহুল নবীনকে নিয়োগ করল কেন্দ্র
আমি : বাঃ বেশ ভাল, বিএসএফ সীমান্ত পাহারা দেয়, ওদের নিয়ন্ত্রণ করে দিল্লির সরকার আর অনুপ্রবেশের জন্য দায়ী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! অদ্ভুত কথা! আর শুনে রাখুন, দিল্লির সরকারের হিসেবে গত দশ বছরে বাংলায় অনুপ্রবেশের সংখ্যা কমেছে। আর মহিলাদের নিরাপত্তার কথা যদি বলেন তাহলে বলি এতদিন ধরে বিজেপি-শাসিত তিন রাজ্য মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানায় মহিলাদের ওপর অত্যাচারের হার সবচেয়ে বেশি, আর এখন তো সবাইকে ছাপিয়ে যাচ্ছে উত্তরপ্রদেশ, দিল্লির সরকারের পরিসংখ্যানে নারী-সুরক্ষায় বাংলা এদের থেকে অনেক এগিয়ে। আরও মজার কথা শুনবেন? মোদির ভারতবর্ষ বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে অসুরক্ষিত দেশ মহিলাদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে! এই রেকর্ড কতটা ‘গর্বের’ বুঝতে পারছেন দাদা? আর আইনশৃঙ্খলার কথা যদি বলেন তা হলে বলি দিল্লির সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী কলকাতা দেশের সবচেয়ে সুরক্ষিত শহর এবং পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে সুরক্ষার দিক থেকে বিজেপি-শাসিত বড় রাজ্যগুলির থেকে অনেক এগিয়ে। দাদারা একটু নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনা প্রয়োগ করুন, সঠিক খবরগুলি রাখুন।
আরও পড়ুন-আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে রাজ্যে বাড়ছে ডাক্তারির আসন সংখ্যা
ভক্ত : (কিছুটা নিস্তেজ) তাই বলে সংখ্যালঘুদের এতটা তোল্লা দেবে? দিদির প্রশ্রয়ে ওরা মাথায় উঠে বসেছে! ববি হাকিম কেন তারকেশ্বর মন্দিরের চেয়ারম্যান হবে? দেশে কি হিন্দুদের আকাল পড়েছে? কোনও মসজিদের চেয়ারম্যান হিন্দুদের করার ক্ষমতা আছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের?
আমি : ওওও… এবার মুসলমান! আচ্ছা সরকারি পয়সায় দুর্গাপুজোর কার্নিভাল দেখেছেন? কেমন লেগেছে? ইউনেস্কো সম্মান জানিয়েছে, জানেন? প্রতিটি দুর্গাপুজো কমিটিকে রাজ্য সরকার গতবছর ষাট হাজার টাকা করে দিয়েছেন, জানেন? দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের স্কাইওয়াক চড়েছেন? গত পাঁচ-ছয় বছরে তারাপীঠ, গঙ্গাসাগর, কালীঘাট মন্দিরে গেছেন? রাজ্যের ৩০ শতাংশ মুসলিম-সহ নাগরিকের করের টাকাও আছে এই সব খাতের খরচে! তারা কিন্তু একবারের জন্যেও প্রশ্ন তোলেননি কেন এত সরকারি টাকা খরচ করা হচ্ছে হিন্দুধর্মের আচার আয়োজনে! তাহলে মাথায় কারা উঠছে? আর হ্যাঁ, ববি হাকিম তারকেশ্বর মন্দিরের চেয়ারম্যান হয়েছে এই চরম মিথ্যা কথাটি কোথায় শুনলেন? তারকেশ্বর মন্দির সম্পূর্ণরূপে ট্রাস্টি বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন। মমতা দিদি তারকেশ্বর শহরের ব্যাপক উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে তারকেশ্বর শহর ডেভলপমেন্ট বোর্ড তৈরি করেছেন পূর্ত দফতরের অধীনে এবং কাজের সুষ্ঠু সমন্বয়ের জন্য তার চেয়ারম্যান করেছিলেন দফতরের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে। আগে সত্যটা জানুন, তারপর সঠিকটা প্রচার করুন।
আরও পড়ুন-মাদ্রিদে প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে ঘরোয়া মেজাজে মুখ্যমন্ত্রী
ভক্ত : (আরও নিস্তেজ, আশেপাশের সহযাত্রীদের মুখ-চোখ পাল্টে মৃদু হাসি আমার দিকে তাকিয়ে) কিন্তু ম্যাডাম এই রাজ্যে দিন দিন বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, দিদির সেদিকে নজর নেই, উনি শুধু শ্রী দিয়ে বেড়াচ্ছেন…
আমি : দাদা আবার ভুল করছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম দফতরের রিপোর্ট বলছে গত সাত বছরে এই রাজ্যে চল্লিশ শতাংশ বেকারত্ব কমেছে, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান দফতরের রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের বেকারত্বের হার বিগত চল্লিশ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছে, নতুন ভারী শিল্প স্থাপনে রাজ্য চতুর্থ স্থানে, মিডিয়াম, স্মল ও মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রি স্থাপনে প্রথম স্থানে পৌঁছেছে আমাদের রাজ্য। একশো দিনের কাজে এত প্রতিবন্ধকতার পরেও পরপর পাঁচ বার আমরা প্রথম! এরপরেও আপনাদের কুৎসা চলছে! আমার স্টেশন আসছে, নেমে পড়তে হবে নইলে আরও কিছু বলার ছিল। শুভেচ্ছা রইল, ভাল থাকবেন মমতাময় বাংলায়। আবার যদি কোনওদিন এভাবে পথের মাঝে দেখা হয় সেদিন আরও কথা হবে দাদা। কিছু মনে করবেন না।
ভক্ত : (হতচকিত হয়ে আমতা আমতা করতে করতে) না না ঠিক আছে, আপনিও ভাল থাকবেন।