নারীবিদ্বেষী বিজেপি বাংলা থেকে দূর হটো

ভারতীয় জনতা পার্টির ভাবনার সাথে, দর্শনের সঙ্গে মূল ‘ভারতবর্ষ’ নামক ভাবনার দূরত্ব যে অনেক, বিজেপি তাদের কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে বারংবার সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। লিখছেন মুর্শিদাবাদের ডোমকল গার্লস কলেজের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান প্রিয়ঙ্কর দাস

Must read

অপারেশন সিঁদুরের প্রথম অভিঘাতে একাধিক সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটিগুলোকে নির্মূল করার পর যখন গোটা বিশ্বের কাছে ভারতীয় সেনার মহিলা অফিসার কর্নেল সোফিয়া কুরেশি, ভারতীয় বায়ুসেনার উইং কমান্ডার ভোমিকা সিং সংবাদমাধ্যমের মধ্যে দিয়ে সেই অভিঘাতের খুঁটিনাটি তুলে ধরেছিলেন, সেদিন ভারতবাসীর মনে দেশপ্রেমের স্ফুলিঙ্গ খেলা করেছিল। দেশপ্রেমের সাথে সাথে আরও একটি বিষয় ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী সেদিন সুস্পষ্ট করে দিয়েছিল যে, রাজনীতির কারবারি যারা পহেলগাঁওয়ের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ধর্মীয় মেরুকরণের তাস সাজাতে চাইছেন তাঁদের এবং সেই সমস্ত সন্ত্রাসবাদীরা যারা ভারতবর্ষকে প্রতিপন্ন করতে চায় একমাত্রিক, সংখ্যাগুরুবাদের ধর্মীয় আধিপত্যের রাষ্ট্র হিসেবে তাদের স্থান ‘ভারতবর্ষ’ নামক ভাবনার মধ্যে নেই। ভারতবর্ষ বহুমাত্রিক রাষ্ট্র এবং এই রাষ্ট্র তার সংবিধানের মূল কাঠামোর উপর আস্থাশীল, যেখানে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত।

আরও পড়ুন-সিকিমে খারাপ আবহাওয়ায় ব্যাহত পর্যটকদের উদ্ধারকাজ

ভারতীয় জনতা পার্টির ভাবনার সাথে, দর্শনের সাথে মূল ‘ভারতবর্ষ’ নামক ভাবনার দূরত্ব যে অনেক বিজেপি তাদের কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে বারংবার সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। তারা ভারতবর্ষের মধ্যে ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গের মানুষের সমানাধিকার চাননা। অপারেশন সিঁদুরের পরবর্তী সময় থেকে, যে মানুষটি জাতীয় আইকন হয়ে উঠেছেন সেই কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করতে পিছপা হননি মধ্যপ্রদেশের বিজেপির মন্ত্রী বিজয় শাহ। গোটা দেশে এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে বিতর্কের ঝড় উঠেছে, সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত সেই মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন। সম্বিত ফেরেনি কেবল ভারতীয় জনতা পার্টির, দল থেকে বরখাস্ত তো দূর অস্ত্, প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার কোনও দলীয় নির্দেশ পর্যন্ত বিজেপির কাছ থেকে আসেনি। আসলে সম্বিত ফেরার কথাটি বলা হয়তো এই লেখকেরই ভুল ভাবনা, বিজেপি নামক দল তাঁদের মননে, ভাবনায়, আদর্শগত জায়গা থেকেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিদ্বেষী ও নারীবিদ্বেষী। এই নারীবিদ্বেষের আরেক নজির গড়েছেন হরিয়ানার বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ রামচন্দ্র জাংড়া, পহেলগাঁওয়ের সন্ত্রাসবাদীদের নির্মম হত্যালীলায় প্রাণ হারানো নিরীহ পর্যটকদের স্ত্রীদের সাহসিকতা নিয়ে তিনি প্রশ্ন করেছেন। নারীদের সমস্যার মূল ভর কেন্দ্রে নিয়ে এসে তাঁদের কালিমালিপ্ত করার এ এক পুরুষতান্ত্রিক চক্রান্ত।

আরও পড়ুন-চাকরি আটকাতে ফের রাম-বামেরা আদালতে

কাঠামোগতভাবে এবং মানসিকভাবে বিজেপি যে সাংঘাতিক মাত্রায় নারীবিদ্বেষী তা কিছু ঘটনাকে, কিছু তথ্যকে অবলোকন করলেই আমরা বুঝতে পারব। ২০২৪ সালে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস ও ন্যাশনাল ইলেকশন ওয়াচের করা একটি যৌথ সমীক্ষায় উঠে আসে যে, গোটা ভারতবর্ষে বর্তমান সমস্ত বিধায়ক ও সাংসদদের মধ্যে ১২৪ জনের বিরুদ্ধে নারী বিদ্বেষী হিংসার ঘটনার জোরালো অভিযোগ আছে, এই ১৩৪ সংখ্যার মধ্যে বিজেপির সাংসদ ও বিধায়কদের সংখ্যাটাই সর্বাধিক, যার সংখ্যা ৪৪ অর্থাৎ ৩৩ শতাংশ।
বিজেপির শাসনকাল শুরুর পর থেকেই নারীর বিরুদ্ধে হিংসা, নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের মাত্রা ক্রমবর্ধিত হয়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড প্রদত্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২১ সালে মোট নথিবদ্ধ অপরাধের সংখ্যা ছিল প্রায় ৬০ লক্ষ যেখানে ৪২৮,২৭৪টা অপরাধই ছিল নারীর বিরুদ্ধে হিংসার অপরাধ। ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সাল অবধি মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে নারীর বিরুদ্ধে হিংসার অপরাধের মাত্রা ২৬.৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই তথ্য মোদি সরকারের নারী সুরক্ষার ব্যর্থতার দিকটাকেই তুলে ধরে।
ভারতবর্ষে নারী পুরুষের লিঙ্গ অনুপাতে যে একটা বড় রকমের ব্যবধান আছে সেই বিষয়ে আমরা সকলেই অবগত এবং এই লিঙ্গ অনুপাত এর মধ্যে যে বৈষম্য তার পিছনে কারণ হিসাবে আমরা জানি যে ভারতবর্ষের অনেক রাজ্যে এখনও কন্যাভ্রুণ হত্যা, কন্যাসন্তান হত্যার মতো ঘটনা ঘটে। ভারতীয় জনতা পার্টি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার এই লিঙ্গ অনুপাতের বৈষম্য নিয়ে যে একটুও ভাবিত নয় তা পরিষ্কার হয়ে যায় যখন ২০১৬ সালে তৎকালীন কেন্দ্রের নারী ও শিশু উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী মানেকা গান্ধী গর্ভস্থ ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ণয় করাকে বাধ্যতামূলক করার দাবি তোলেন। এই দাবি ভারতবর্ষে চালু থাকা প্রি কনসেপশন অ্যান্ড প্রি ন্যাটাল ডায়াগনস্টিক টেকনিক সিলেকশন (প্রহিবিশন অফ সেক্স সিলেকশন) আইনের পরিপন্থী। এই আইন চালু হয়েছিল কন্যা ভ্রূণ হত্যাকে প্রতিরোধ করার জন্য।  বিজেপির নারী বিদ্বেষের আরেকটি উদাহরণ হল, যখন স্বয়ং মানেকা গান্ধী বলেন, “বৈবাহিক ধর্ষণের ধারণা ভারতীয় প্রেক্ষাপটে প্রয়োগযোগ্য নয়”, এর অর্থ দাঁড়ায় একটাই, নারীর বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়া হিংসার মূল্যে চোকাতে হবে পরিবারের অটুট বন্ধনের ভাবনাকে।
বিলকিস বানোর ধর্ষণ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া ধর্ষকদের যখন জেলমুক্তি ঘটে তখন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্যদের দেখা যায় ফুলের মালা নিয়ে সেই ধর্ষকদের বরণ করে নিতে। পরবর্তী সময়ে গুজরাতের একাধিক বিধায়ক ও সাংসদদের সাথে সেই ধর্ষকদের মঞ্চ ভাগ করে নিতে দেখা যায়। সম্প্রতি একটি ঘটনার কথা বলতে হয়, খোদ মহারাষ্ট্রের একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কন্যা একজনের বিরুদ্ধে এফ আই আর দায়ের করেন তাঁকে ও তাঁর বান্ধবীদের উত্ত্যক্ত করার জন্য, পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয় যে, সেই অভিযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন বিজেপির একজন প্রাক্তন পৌরপিতা, পীযূষ মোরে।

আরও পড়ুন-সংসদের বিশেষ অধিবেশনে ডাকতে ১৬ টি বিরোধী দল একযোগে চিঠি দেবে প্রধানমন্ত্রীকে, জানালেন ডেরেক

প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, বিজেপি নামক দলটা আপাদমস্তক নারীবিদ্বেষী মনোভাবে সিক্ত কেন? উত্তরটা খুঁজলে বোঝা যায় যে, বিজেপির মতাদর্শের ভরকেন্দ্রে যে আরএসএস বসে আছে তাঁরা মহিলাদের নিশ্চিদ্র ঘেরাটোপের মধ্যে রাখতে চায়, মহিলাদের পুরুষের অধীনস্থ করে রাখতে চায়। বিজেপি খুব ভাল করেই জানে যে, আরএসএসের আশীর্বাদধন্য হাত মাথার উপর না থাকলে গো-বলয়ের অনেক রাজ্যেই তাঁদের পরিণতি বেশ খারাপ হতে পারে। তাই আরএসএসকে পরিতুষ্ট রেখে তাঁদের নারী বিদ্বেষী কার্যকলাপকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক।

Latest article