বঙ্গের ভোটে খুব একটা সুবিধা হচ্ছে না। দেখে-বুঝে চূড়ান্ত হতাশ বিজেপি। শুধু বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব নয়, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও একইভাবে হতাশ। এই হতাশার বহিঃপ্রকাশ একাধিক ঘটনায়।
এবারের ভোটে গেরুয়া শিবিরের প্রচারের মুখ দু’জনই, ‘বিশ্বগুরু’ নরেন্দ্র মোদি ও ‘স্ট্রংম্যান’ অমিত শাহ। বাকিরা জাস্ট এলেবেলে। অমিত শাহ গত মঙ্গলবার বঙ্গে প্রচারে এসে উলুবেড়িয়ায় বলেছেন, বাংলায় জিতে এলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের পরিমাণ বর্তমান এক হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১০০ করা হবে। অর্থাৎ ১০০ টাকা বাড়বে।
এত দিন শুনে আসছিলাম লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নিয়ে বিজেপি আর সিপিএমের, রামের আর বামের ভূরি ভূরি কটাক্ষ। নানারকম বিরুদ্ধ সুর। আর এখন অমিত শাহ সেই লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের পরিমাণ ১০০ টাকা বৃদ্ধির সস্তা প্রহসনে নেমেছেন।
আরও পড়ুন-ফলের দরে আগুন, কেন্দ্রের উদাসীনতায় ভুগছে মধ্যবিত্ত
অমিত শাহকে স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, ভাতা বৃদ্ধির প্রয়োজন হলে সেই দায়িত্বটা যথাসময়ে পালন করবেন মমতাই। আপনাকে বিমানের ধুলো উড়িয়ে এসে এই স্তোকবাক্য শোনাতে হবে না। বাংলার মা-বোনেরা তৃণমূল সুপ্রিমোকে অন্তর থেকে বিশ্বাস করেন এবং মানেন। ওসব নিয়ে আপনার না ভাবলেও চলবে। আপনি বরং বঙ্গ বিজেপির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবুন। কেন্দ্রের যে দল ও সরকার আড়াই বছর যাবৎ বাংলার বকেয়া দেড় লক্ষাধিক কোটি টাকা আটকে রেখেছে, দু’বছরেরও বেশি সময় মেটায়নি ১০০ দিনের কাজের টাকা, বন্ধ করেছে আবাস যোজনার কাজ, চারদিকে শুধু বঞ্চনা আর বঞ্চনা যাদের সৌজন্যে তারা এখন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নিয়ে কোনও ইতিবাচক কথা বললে মনে হয় ঠাট্টা করছেন। আর একটা জুমলা। বোঝাই যাচ্ছে, ভয় পেয়ে এখন বাধ্য হয়েই ঢোঁক গিলছেন শাহরা।
দু’দিন আগেও বাংলায় এসে গেরুয়া নেতারা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বন্ধ করার হুমকি দিতেন, তাঁদের এই ভোল বদল বুঝিয়ে দিচ্ছে, যাঁরা ক’দিন আগে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছিলেন, তাঁরাই যখন বুকে টেনে নিচ্ছেন, তখন কারণটা পরিষ্কার। পায়ের তলার মাটি টালমাটাল, অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় আচমকা বেড়ে গেছে বুকের ধড়ফড়ানি।
আরও পড়ুন-ঐতিহ্যবাহী বুড়োরাজ মেলায় অস্ত্র নিয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
আর মোদি? তিনিই বা কম যান কীসে?
সপ্তাহ তিনেক আগে নরেন্দ্র মোদি রাজস্থানের এক জনসভা থেকে মুসলিমদের শুধু অশালীন ভাষায় তোপই দাগেননি, যে-ভাষায় কথা বলেছেন তা অন্তত দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখের ভাষা হতে পারে না। তারপর তিনিই আবার দাবি করছেন, বিভাজন করা আমার কাজ নয়!
কিন্তু ভোট বড় বালাই। তাই একবার বলছেন, হিন্দু-মুসলিম করি না, পরক্ষণেই বুক বাজিয়ে আবার সেই পুরনো উল্টো তাস খেলছেন! কারণ, সাম্প্রদায়িক বিভাজনই বিজেপির অন্তিম আয়ুধ। শেষ চেষ্টা। কী মনে করেন প্রধানমন্ত্রী, দেশের ১৪০ কোটি জনগণ বুদ্ধু, যখন যা বলবেন তাই বেদবাক্য?
শুরু হয়েছিল উন্নয়নের ঢাক বাজিয়ে আর ৪০০ পারের গল্প শুনিয়ে। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বুঝতে পারলেন— উন্নয়ন, বিকাশে হবে না। হিন্দু-মুসলমান মোটা দাগের নোংরা খেলা ছাড়া বিশেষ সুবিধে হবে না। এ-জন্যই আমদানি করেছেন, সংখ্যালঘুদের বেশি বাচ্চা এবং মঙ্গলসূত্রের গল্প। সঙ্গে জুড়লেন মিথ্যে ন্যারেটিভ, কংগ্রেস এলে সব টাকা-পয়সা, সোনাদানা হিন্দুদের কাছ থেকে কেড়ে দিয়ে দেওয়া হবে মুসলমানদের। এই নিদান নাকি মনমোহনজি দিয়ে গিয়েছেন। লোকে চমকাল, ভয়ও পেল খানিকটা। শত হলেও দেশের প্রধানমন্ত্রী বলে কথা! কিন্তু তার তিন সপ্তাহ পরে আবার সুর বদল। এখন বলছেন, মুসলমানদের কথা তিনি একবারও বলেননি। বেশি বাচ্চা বলতে গরিব মানুষের কথা বুঝিয়েছেন। সবাই অবাক! মোদিজির হলটা কী? কোনও খারাপ খবর এসেছে? এমনও বলছেন, ‘যদি হিন্দু-মুসলিম করি, তাহলে সামাজিক জীবনে থাকার যোগ্যতা হারাব।’ যদি তাই হয়, তাহলে তো অনেক আগেই আপনি সেই যোগ্যতা হারিয়ে বসে আছেন।
আরও পড়ুন-মোদির গ্যারান্টি ফোর টোয়েন্টি তথ্য দিয়ে বোঝালেন অমিত
মোদি বলেছেন, ‘২০০২ সালের পর আমার ভাবমূর্তি নষ্ট করার অনেক চেষ্টা হয়েছিল। ইদের দিন আমরা বাড়িতে রান্না করতাম না। আশপাশের মুসলিম প্রতিবেশীদের কাছ থেকে খাবার আসত।’ খুব ভাল কথা। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘ভোট ব্যাঙ্কের জন্য কাজ করি না। আমি বিশ্বাস করি, সব কা সাথ, সব কা বিকাশে।’ এ তো প্রধানমন্ত্রী নন, শরৎচন্দ্রের সাক্ষাৎ ‘ছিনাথ বহুরূপী’! কিন্তু সত্যি সত্যি মোদিজির মুখে এই কথা বাংলার মানুষের হজম হছিল না। ব্যারাকপুরে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এখানে তৃণমূল নেতারা বলছেন হিন্দুদের ভাগীরথীতে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। চোয়াল শক্ত করে প্রধানমন্ত্রী এরপরই বলেন, ‘এত হিম্মত? এত সাহস?’ তাঁর দাবি, ‘বাংলায় মমতার রাজত্বে হিন্দুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী এ-ও বলেছিলেন, ‘ইন্ডি জোট এলে তফসিলি জাতি, উপজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ তুলে দেবে। ওরা বলছে, পুরো সংরক্ষণ মুসলমানদের দেওয়া হোক।
বেমালুম মিথ্যে বলে হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের মোটা দাগের চেষ্টা। যে বিষ বপন করে চলেছেন, সেই ক্ষত সরাসরি আমাদের সংবিধানকে জখম করবে। তিনি ক্ষমতায় আসুন আর নাই আসুন, তাঁর রাজনৈতিক লাভের জন্য ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চেহারা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। ইতিহাস কিন্তু এজন্য তাঁকে কোনওদিন ক্ষমা করবে না।
সাতবারের সাংসদ, কেন্দ্রে কয়লা, রেল, যুব ও ক্রীড়া, নারী ও শিশুকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা, মানুষের আশীর্বাদে তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী সাধে বলেন, “এত বড় ভাঁওতাবাজ প্রধানমন্ত্রী আগে দেখিনি!”
জননেত্রী বলছেন, ‘ওরা কর্নাটকে ঘেঁচু। কেরলে কাঁচকলা। তামিলনাড়ুতে নো চান্স। উত্তর-পূর্বে ঢুকতে দেবে না। হরিয়ানাতেও ঢুকতে দেবে না। দিল্লিতে না। রাজস্থানেও কমে যাবে আসন। মধ্যপ্রদেশে কম পাবে। উত্তরপ্রদেশে অর্ধেক হয়ে যাবে। পাঞ্জাব, বিহার, ওড়িশা, বাংলায় আসন পাবে না বিজেপি। ফলে অঙ্ক ক্লিয়ার!’
এই সত্যিটা টের পাচ্ছে বলেই মোদি-শাহ বঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চেষ্টা করতে মরিয়া।
সাধু সাবধান।