মোদি জমানার অগণতান্ত্রিক গণতন্ত্র!

Must read

পার্লামেন্টে আলোচনা প্রায় বন্ধ। বাক্‌স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বিসর্জিত। লিখছেন পূর্ণেন্দু বসু

‘অগণতান্ত্রিক গণতন্ত্র’। সে আবার কী! গণতন্ত্র কী করে অগণতান্ত্রিক হয়? আসলে এটা কোনও হেঁয়ালি নয়। এটাই বাস্তব। সোজা কথা সোজা ভাবে বললে, প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল যে, নিয়মিত সময়ান্তরে নির্বাচন অথবা পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা (ব্রুট মেজরিটি) মানেই গণতন্ত্র নয়। এর সঙ্গে চায় সুগভীর সাংবিধানিক মূল্যবোধ। যার অর্থ হল—
নিয়মিত নির্বাচন-ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত থাকবে, আলাপ-আলোচনায় অংশগ্রহণের ইচ্ছা, যুক্তরাষ্ট্রীয় মানসিকতা, সংখ্যালঘুর আধিকারকে মর্যাদা দেওয়া, বিরোধিতা বা বিরোধী মত সম্পর্কে সহনশীলতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, সমতার প্রশ্নে অক্লান্ত প্রচেষ্টা, সামাজিক সংহতি, বিভিন্ন সংবিধানসম্মত প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধিকারের প্রতি সম্মানবোধ, স্বচ্ছতা ও আইনের শাসন দ্বারা পরিচালিত হওয়া। নরেন্দ্র মোদির ‘নতুন ভারত’-এ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলির অস্তিত্ব নেই। এই জমানাকে সংখ্যাগুরুবাদের জমানা বলতে পারি আমরা। বলতে পারি মোদির কর্তৃত্ববাদের জমানা।

আরও পড়ুন-চলতে-ফিরতে বিজ্ঞান, আঙুল ফাটালে শব্দ হয় কেন?

বর্তমান মোদি-রাজত্বে কারও সঙ্গে আলাপ-আলোচনা বা বুদ্ধি পরামর্শ করার কোনও উদ্যোগ নেই। পার্লামেন্টে পর্যন্ত আলোচনা হয় না। এমনকী শোনা যায়, নিজের মন্ত্রীদের সঙ্গেও নাকি আলোচনা করা হয় না। শুধু তাই নয়, একের পর এক বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়। নোটবন্দি, জিএসটি (গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স), লকডাউন, নির্বাচনী তহবিল গঠন, সংবিধানের ৩৭০ ধারার বিলোপসাধন, জম্মু-কাশ্মীরের থেকে রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেওয়া, নাগরিকতা সংশোধনী আইন (সিএএ), ইউএপিএ সংশোধনী আইন, এনআরসি, কৃষি আইন ইত্যাদি হল তার উদাহরণ। শ্রম কোডগুলিও একপাক্ষিকভাবে নিজেদের মতকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এ-ছাড়া আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের মতামতকে অক্লেশে অবজ্ঞা করা হয়। আর দু’একজন চাটুকার অবশ্য বেশ গুরুত্ব পান এই নতুন জমানায়।
পার্লামেন্টে কোনও বিতর্কের অনুমোদন নেই বললেই চলে। এমনকী প্রতি পাঁচটি খসড়া বিলের মধ্যে একটি বিলও পার্লামেন্টের কমিটিগুলিতে আলোচনার জন্য পাঠানো হয় না। আগে ৭০ শতাংশ বিল এই প্রক্রিয়ায় ভাল করে খুঁটিনাটিতে পরীক্ষা করার জন্য পাঠানো হত। এই জবরদস্তির অবশ্যম্ভাবী ফল হল সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদ বা বর্তমান একটানা কৃষক আন্দোলন। এই গণতান্ত্রিক প্রতিবাদগুলিই আমাদের আগামীর আশা।
মোদি জমানায় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। বিশেষ করে বিরোধী দলের রাজ্য সরকার হলে তো কথাই নেই। রাজ্যগুলির সঙ্গে আইন প্রণয়ন বা নীতিগত বিষয়ে কোনও আলোচনা হয় না বললেই চলে। অর্থের জন্য আত্মসমর্পণ করতে হয়, নচেৎ আইনসঙ্গত পাওনা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। জিএসটি-ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রেও একই কায়দায় চলে সরকার। ফিনান্স কমিশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে নানা টালবাহানা। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলিকে বিরোধী দল পরিচালিত রাজ্যে পাঠিয়ে দিয়ে নানা প্রকার হেনস্থা করা হয়। সিবিআই, ইডি ও আয়কর হানার সময়ে বিপুল সংখ্যায় কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানো হয়। অথচ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব রাজ্যের। বিরোধী দল শাসিত রাজ্যে এখন রাজ্যপালদের ভূমিকা শাসক দলের নেতাদের অনুরূপ। নির্বাচিত রাজ্য সরকারগুলির পতন ঘটাতে প্রভূত সম্পদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এ-সবের ফলে পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হচ্ছে।

আরও পড়ুন-নিউক্লিয়ার পাওয়ারে কর্মী নিয়োগ

স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার যথেচ্ছভাবে খণ্ডন করে বিরোধীমতকে জাতীয়তা বিরোধী এবং রাষ্ট্রদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাজগতের প্রখ্যাত ব্যক্তি-সহ সমাজকর্মী, ছাত্র-ছাত্রী, সাংবাদিক জগতের অনেককে সরকারের সমালোচনা করার জন্য জেলে বন্দি করে রাখছে কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলি। সামাজিক মাধ্যম এবং ডিজিটাল মাধ্যমগুলিকে পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। যারা একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। টেলিভিশনে যে ঘৃণা ছড়ানোর বক্তব্য পেশ করা হচ্ছে মোদি সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করছে না। একেই বলে সংখ্যাগুরু তোষণ। সংখ্যালঘুর মর্যাদা ছাড়া গণতন্ত্র হয় না।
বিভিন্ন সংবিধান অনুমোদিত সংস্থাগুলিকে সরকারি ও দলীয় নিয়ন্ত্রণে এনে তাদের স্বাধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এমনকী বিচার ব্যবস্থা এবং ক্যাগ (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল) পর্যন্ত বাদ যাচ্ছে না। সরকার যা চায়, তা পাওয়ার জন্য অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের পুনর্নিয়োগ করা হচ্ছে যথেচ্ছভাবে। পার্লামেন্টকে অকেজো করে দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে অত্যাচার চালিয়ে প্রতিবাদের আঁতুড়ঘরগুলিকে নীরব করে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, কোন দলকে কে কত টাকা অনুদান দিচ্ছে তা জানার কোনও অধিকার নেই দেশের নাগরিকদের। মোদি জমানায় এমনই ব্যবস্থা হচ্ছে, যেখানে নাগরিকেরা যত কম জানবেন ‘গণতন্ত্র’ ততই শক্তিশালী হবে! আসল গণতন্ত্র হচ্ছে ঠিক এর উল্টোটা।
গণতন্ত্রে স্বচ্ছতার গুরুত্ব অসীম। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার (মানে নরেন্দ্র মোদি) নানা ক্ষেত্রে এমনভাবে অস্বচ্ছাতার অন্ধকার তৈরি করছে তাতে সরকারি কর্মপ্রণালী সম্পর্কে সন্দেহ ক্রমশই বাড়ছে। নির্বাচনী বন্ড, ফরাসি রাফেল যুদ্ধবিমানের দাম, পিএম কেয়ারস, লাদাখে চিনের অনুপ্রবেশ, ইভিএম-ভিভিপ্যাট সম্পর্কে প্রশ্ন, নরেন্দ্র মোদির দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি-সহ নানা অস্বচ্ছতা ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট ও বিভিন্ন সার্ভের ফলাফল ইত্যাদি সরকারের পছন্দ না হলে সব কিছুরই স্থান হচ্ছে কবরে। নামী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির কাছে ভারতের পরিসংখ্যান এখন আর বিশ্বাসযোগ্য নয়। তারা নিজেরাই নিজেদের সার্ভে করে নিচ্ছে। নির্বাচন কমিশন, ক্যাগ এবং কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনের সরকারের বিরুদ্ধে কিছু নির্দেশনামা লিখতে সংশ্লিষ্ট প্রধানদের হাত কাঁপে।
এ-সবের মাধ্যমে এ-কথা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, গণতন্ত্রহীনতা বা অগণতান্ত্রিকতা প্রতিদিন আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। কোনও যোগাসনের নিচে সে-সব আর ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। নীতি আয়োগ বা অর্ণব গোস্বামীর মতো লোকেরাও এ-সব ঢাকা দেওয়ার মতো বড় ধামা খুঁজে পাচ্ছেন না।
এই জামানায় অর্থনীতির নেতিবাচক পতনই শুধু নয় বা ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকার সংখ্যাই শেষ কথা নয়। অথবা জিএসটি ও নোটবন্দির ব্যর্থতা যে ভয়ঙ্কর আঘাত হেনেছে ক্ষুদ্রশিল্পের ক্ষেত্রে— এ-সবের মধ্যেই মোদি জামানার ব্যর্থতার কাহিনি শেষ হবে না। গণতন্ত্রের মধ্যে যে সমাজকল্যাণের ধারণা, যে মানবোন্নয়নের ধারণা— সেখানেও মোদি সরকার চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। মিথ্যার বেসাতি করে চলছে মানুষের ভোটে নির্বাচিত একটা সরকার। গণতন্ত্রের যেটুকু আবরণ ছিল এদেশে, তাকে নিরাবরণ করে ছাড়ছে মোদি জামানা। ২০১৪ থেকে যার শুরু।
যা ছিল আগে তা ফিরিয়ে আনতে হবে। সেই কাজটাই এখন করার। যার পোশাকি নাম— গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। গণতন্ত্রকে মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে বাঁচিয়ে তুলতে হবে। মোদিতন্ত্রের গোলামি করে বেঁচে থাকার চেয়ে গণতন্ত্রের জন্য লড়তে লড়তে মৃত্যুবরণও শ্রেয়। এটা হোক আজ নাগরিক অঙ্গীকার। বলা বাহুল্য যে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠা গণতন্ত্রের অন্তর্বস্তুকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। মোদিতন্ত্রকে যতই শক্তিশালী মনে হোক না কেন, গণতন্ত্রের কাছে মোদিতন্ত্র পরাজিত হবেই।

Latest article