গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মণিপুর জ্বলছে— অথচ এই কেন্দ্রীয় সরকার, প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদির (Narendra Modi) নেতৃত্বে, নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছে। এই নীরবতা শুধু অপরাধ নয়, এটি সহানুভূতির মৃত্যুঘণ্টা।
রাষ্ট্রপতির শাসন কোনও স্থায়ী শাসনব্যবস্থা নয়। এটি সংবিধানের একটি জরুরি ব্যবস্থা— অস্থায়ী ও স্বল্পস্থায়ী হওয়ার কথা। এর পুনরাবৃত্তি গণতন্ত্রের উপহাস, আইনের শাসনের অপমান এবং কেন্দ্রীয় সরকারের চরম ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি।
১. আইন-শৃঙ্খলার ভয়াবহ ব্যর্থতা : ভারতের লজ্জা
একটি রাষ্ট্রের সর্বপ্রথম দায়িত্ব হল তার নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। কিন্তু মণিপুরে আমরা কী দেখেছি?
২০০-রও বেশি মানুষ নিহত, শিশু ও বৃদ্ধরাও বাদ যায়নি।
৬০,০০০-রও বেশি মানুষ গৃহহীন, ক্যাম্পে মানবেতর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
সম্পূর্ণ গ্রাম ধ্বংস, আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে শত-শত বাড়ি।
৬ মাসেরও বেশি সময় ইন্টারনেট বন্ধ, যা একটি গণতান্ত্রিক দেশে নজিরবিহীন।
৫০০-র বেশি গির্জা ও সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ধ্বংস।
এটা শুধুই ‘অশান্তি’ নয়— এটা একপ্রকার গৃহযুদ্ধ, এবং তা সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও পক্ষপাতিত্ব দ্বারা সম্ভব হয়েছে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত বলেছে— ‘মণিপুরে যা ঘটছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এটা সংবিধানিক কাঠামোর সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া।’
২. গৃহমন্ত্রকের চরম ব্যর্থতা
মাননীয় গৃহমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করতে চাই— যখন মণিপুর জ্বলছিল, আপনি কোথায় ছিলেন?
কোথায় ছিল গোয়েন্দা তথ্য? কেন IB, RAW বা রাজ্য গোয়েন্দা সংস্থা আগাম সতর্কবার্তা দেয়নি?
না কোনও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ, না কোনও সম্প্রদায়ভিত্তিক সংলাপ, না কোনও অস্ত্র বাজেয়াপ্ত।
সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পরেও যথাযথ কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়নি।
আপনি ভারতের গৃহমন্ত্রী হিসেবে নয়, যেন এক সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবে কাজ করেছেন।
৩. সাম্প্রদায়িক রাজনীতিই মূল সমস্যা
এই সংঘাত শুধুই জাতিগত নয়— এটি রাজনৈতিক। বিজেপি বছরের পর বছর হিন্দু বনাম খ্রিস্টান, মেইতেই বনাম কুকি, উপত্যকা বনাম পাহাড়— এভাবে এক সম্প্রদায়কে অন্যটির বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছে।
মণিপুরে বিজেপি সরকারের পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকা, বিশেষ করে সংখ্যালঘু খ্রিস্টান ও উপজাতিদের প্রতি চরম অবহেলা, পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করেছে।
প্রধানমন্ত্রী ৮০ দিন নীরব ছিলেন— একটিও বিবৃতি দেননি, একবারও সফর করেননি, একটিও সহানুভূতিপূর্ণ বাক্য পর্যন্ত বলেননি।
৪. নারী-নির্যাতন জাতির সম্মিলিত লজ্জা
আমি একজন ভারতীয় হিসেবে আজ কথা বলছি— যে ভিডিওতে দুই উপজাতি নারীকে নগ্ন করে হাঁটানো, নির্যাতন ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের দৃশ্য দেখা গেছে— তা জাতির বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু জানেন কি, FIR নথিভুক্ত হওয়ার পর ৭৭ দিন পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি?
এটি শুধু অপরাধ নয়— এটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত নৃশংসতা। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ— সকলেই ভারতের এই প্রতিক্রিয়াকে ‘ধীর’, ‘রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত’ ও ‘অত্যন্ত পক্ষপাতদুষ্ট’ বলে অভিহিত করেছে।
৫. সংখ্যালঘু অধিকার হুমকির মুখে
কুকি-জো খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদের ওপর প্রায় জাতিগত নিধন চলেছে।
২০০-র বেশি গির্জা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
সংখ্যালঘু অফিসার ও ছাত্রদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে।
ক্যাম্পে থাকা মানুষদের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়নি।
ক্যামব্রিজ হিউম্যান রাইটস রিভিউ বলেছে, ‘মণিপুরে সরকারের প্রতিক্রিয়ায় কাঠামোগত পক্ষপাত ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ক্ষেত্রে বিচারহীনতার নিদর্শন দেখা গেছে।’
৬. প্রতিবেদন উপেক্ষিত, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ
এই সরকার সকল সতর্কবার্তা উপেক্ষা করেছে,
ন্যায়মূর্তি অজয় লাম্বা কমিটির রিপোর্ট পুলিশের প্রাথমিক ব্যর্থতার কথা বলেছে।
সংসদের স্থায়ী কমিটি (হোম অ্যাফেয়ার্স) বলেছে, কেন্দ্র হস্তক্ষেপে দেরি করেছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ভারতের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন।
কিন্তু সরকার কী করেছে? যেসব মানুষ প্রতিবাদ করেছে, তাদের ‘দেশদ্রোহী’ তকমা, সাংবাদিকদের বাধা, ছাত্রদের গ্রেফতার করেছে, কর্মীদের বিরুদ্ধে ED ও CBI লেলিয়ে দিয়েছে। এটা কি গণতন্ত্র, না কর্তৃত্ববাদ?
৭. সংসদের অপমান
প্রধানমন্ত্রী এই সংসদে একবারও মণিপুর ইস্যুতে মুখ খোলেননি। বিদেশে দুর্ঘটনার জন্য ট্যুইট করেন, কিন্তু নিজের দেশের উপজাতিদের জন্য একটিও শব্দ বলেন না।
এমনকী মণিপুর থেকে নির্বাচিত বিজেপি-র সাংসদ আর কে রঞ্জন সিং নিজেই বলেছেন— ‘তার বাড়ি পুড়ে গেল, কিন্তু সরকার কোনও সাহায্য করেনি।’ এটাই কি আপনার ‘ডবল ইঞ্জিন সরকার?’ ডবল নিষ্ঠুরতা, ডবল ব্যর্থতা?
৮. রাষ্ট্রপতির শাসন বাস্তবে একটি ঢাকনা
আপনারা এখন রাষ্ট্রপতির শাসন বাড়াতে চাইছেন। কেন? কারণ আপনাদের সাহস নেই নির্বাচন করানোর। কারণ আপনাদের কোনও শান্তির পরিকল্পনা নেই। কারণ আপনারা নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে চাইছেন।
Ashoka University Conflict Monitoring Report (এপ্রিল ২০২৫) দেখিয়েছে, রাষ্ট্রপতির শাসনের সময় সহিংসতা বরং বেড়েছে।
আইনের শাসন ফেরেনি— এসেছে শুধুই নিস্তব্ধতা।
৯. আমাদের দাবি
আমি এই সংসদে স্পষ্ট ও সংবিধানসম্মত কিছু দাবি জানাচ্ছি—
১. ৩৫৬ ধারা অনির্দিষ্টকাল বাড়ানো বন্ধ করুন। ৩ মাসের মধ্যে বিধানসভা নির্বাচন দিন।
২. সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে বিশেষ তদন্ত দল (SIT) গঠন করে নারী ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অপরাধের তদন্ত করুন।
৩. নিরপেক্ষ শান্তিরক্ষী বাহিনী (CRPF/Army) মোতায়েন করুন— রাজ্য পুলিশের নিয়ন্ত্রণে নয়।
৪. গোয়েন্দা ব্যর্থতা ও কেন্দ্রের প্রতিক্রিয়া নিয়ে শ্বেতপত্র (White Paper) প্রকাশ করুন।
৫. গণমাধ্যমকে পূর্ণ প্রবেশাধিকার দিন— জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে।
৬. সহমর্মিতা, ন্যায়বিচার ও পুনর্বাসনের ভিত্তিতে পার্লামেন্টারি রিকনসিলিয়েশন রেজোলিউশন পাশ করুন।
১০. শেষ কথা— মণিপুর ভারতেরই অংশ।
মণিপুর কোনও দূরবর্তী রাজ্য নয় — এটি ভারতেরই অঙ্গ, এটি ভারতবর্ষেরই হৃদয়।
যখন ইম্ফলের এক শিশু ক্যাম্পে ক্ষুধায় কাঁদে— সেটি আমাদের লজ্জা।
যখন একজন উপজাতি মা তার ধর্ষিতা কন্যার জন্য কান্না করে— সেটি আমাদের ব্যর্থতা। যখন সংখ্যালঘুরা সংবিধানের ওপর আস্থা হারায়— তখন গণতন্ত্রও মৃত্যুবরণ করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন— ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ।’ কিন্তু মণিপুরে দেখেছি— ‘কিছুর সাথ, অনেকের সর্বনাশ।’ এটা সংবিধানের ভারত নয়। এটা ড. বি আর আম্বেদকরের স্বপ্নের ভারত নয়। এটা বারাসত, বাংলা বা মণিপুরের মানুষের প্রাপ্য ভারত নয়।
আমরা মণিপুরে ৩৫৬ ধারা বৃদ্ধির তীব্র বিরোধিতা করছি। আমরা সংবিধান, নারীর সম্মান, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবাধিকারের নামে।এই ব্যর্থতাকে প্রত্যাখ্যান করছি।
মণিপুর আবার বাঁচুক— মর্যাদা, শান্তি ও গণতন্ত্র নিয়ে। জয় হিন্দ। জয় ভারত।
মণিপুর জ্বলছে, নিরো বেহালা বাজাচ্ছে, মোদি শুধু বিদেশে ছুটছে
ঔদাসীন্য সীমাহীন। আর তাতেই আঁধার ঘিরছে অন্তহীন। মণিপুর নিয়ে মোদি সরকারের অবস্থান রোমের রাজা নিরোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। নিত্যনিধনকাণ্ডের প্রতি অসংবেদনশীল উপত্যকা জল্লাদের দেশ হতে পারে, আমার নয়। লিখছেন ডাঃ বৈদ্যনাথ ঘোষ দস্তিদার
