প্রতিবেদন : ৩৭ বছর আগের কথা। ১৯৮৪। ডিসেম্বরের ২ তারিখের রাত; ৩-ও বলা যায়। মধ্যপ্রদেশের ভোপাল শহর হয়ে উঠল এক মৃত্যুপুরী। ইউনিয়ন কার্বাইড নামক এক বহুজাতিক কোম্পানির কারখানা থেকে বেরিয়ে মিক (মিথাইল আইসোসায়ানেট) গ্যাস সেরাতে ছড়িয়ে পড়েছিল শহরজুড়ে। রাসায়নিক কীটনাশক তৈরির কারখানা থেকে বের হওয়া সেই বিষ গ্যাসের প্রভাবে সরকারিভাবে মারা যান তিন হাজার মানুষ। বেসরকারি মতে সংখ্যাটা পঁচিশ হাজার। পঙ্গু হন প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ। লক্ষাধিক মানুষ গুরুতর অসুস্থ হন।
ভারতের সর্ববৃহৎ পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য যারা দায়ী ছিল তারা কিন্তু বিশেষ শাস্তি পেল না। দুর্ঘটনায় অভিযুক্ত ইউনিয়ন কার্বাইড কোম্পানি বারবারই চেয়েছিল এই রাসায়নিক গ্যাস দুর্ঘটনার মামলাকে আমেরিকার পরিবর্তে ভারতের আদালতে নিয়ে যেতে। কারণ তারা ভাল করেই জানত যে ভারতে পরিবেশ সংক্রান্ত তেমন কোনও জোরালো আইন নেই। কাজেই আমেরিকার কোনও আদালত নিহতদের পরিবার এবং আক্রান্তদের যে পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলবে, ভারতীয় আদালত তার থেকে অনেক কম পরিমাণ ক্ষতিপূরণের আদেশ দেবে। আর ঘটেছিলও তাই।
আরও পড়ুন : ভয়াবহ! বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে নামল ভারত
এদেশে মানুষ ও পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য আইন তৈরি হল ভোপালের দুর্ঘটনার পরে। নাম ‘পরিবেশ রক্ষা আইন ১৯৮৬’। এর আগে দেশে পরিবেশ সংক্রান্ত যেসব আইন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল সেগুলোকে এক ছাতার তলায় আনা হল এই আইনে। ১৯৯৪তে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ আইন হয় ‘এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ নিয়ে। এই পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের বিষয়টি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণত কোনও জায়গায় কোনও কারখানা হওয়ার পরে দূষণের জেরে সেই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হলে স্থানীয় মানুষের আন্দোলনের কথা আমাদের জানা আছে। কিন্তু যদি এমন কোনও জায়গায় কারখানা গড়ে ওঠে যেখানে লোকালয় নেই? কারখানা গড়ে ওঠার পরে তাকে কেন্দ্র করেই তো গড়ে ওঠে জনবসতি। তারপরে যদি সেখানে শিল্পদূষণের অভিযোগ ওঠে তখন তো বলাই যাবে যে কারখানা গড়ার পরে যদি কেউ এসে বসতি স্থাপন ক’রে দূষণের শিকার হয় তবে তার দায় তো তারই। সেই অজুহাতকে অগ্রাহ্য করতেই চালু হল এই পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের বিষয়টি। এর লক্ষ্য, কারখানা স্থাপনের সময়ে নয়, পরে কারখানাজনিত দূষণের কী প্রভাব পড়তে পারে পরিবেশে, তার মূল্যায়ন করা। আর এই আইনের জন্যই শিল্পস্থাপকরা বাধ্য হত কারখানায় নানা ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে। বায়ুদূষণ বা জলদূষণ কমাতে বিভিন্ন ‘কন্ট্রোল প্ল্যান্ট’-এর ব্যবস্থা করা হত।
১৯৭৪ সালে জলদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইনে ‘কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষৎ’ গড়ে উঠলেও তা সক্রিয় হয়ে ওঠে ১৯৮৬এর পরে। বিভিন্ন রাজ্যে গড়ে উঠতে থাকে ‘রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ’। ফলে অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পরিবেশ বাঁচানোর একটা চেষ্টা যে দেশে শুরু হয়েছিল তা মানতে হবে।
কিন্তু ছবিটা বদলে গেল মোদি জমানায়, জুমলা শাসনে।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার পরিবেশ রক্ষার জন্য তাবৎ প্রতিবাদী কন্ঠ রুদ্ধ করার সব রকম ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কোভিড পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সরকার ‘এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’-এ সংশোধন এনেছে। এতে শিল্পপতিদের এমন সব সুযোগ দেওয়া হয়েছে যা অবিশ্বাস্য। পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই শুরু করে দেওয়া যাবে কোনও প্রকল্প। শিল্পকারখানার প্রভাবের যে সীমানা আগের আইনে ছিল তা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসাকে সহজ করার নামে দেশের জল-মাটি-বাতাসকে বিপন্ন করছে আম্বানি-আদানিদের সরকার। উন্নয়নের নামে চলছে পরিবেশনিধন প্রকল্প। অভিযোগ, এর আগেও কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা ‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ (নিরি) পরিবেশ-দূষক সংস্থার বিরুদ্ধে এমন লঘু রিপোর্ট পেশ করেছে যে কোনও কার্যকর ব্যবস্থাই তার পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া যায় নি। অগ্রাহ্য করা হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ‘কিউমিলেটিভ ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’কেও। অর্থাৎ কোনও জায়গায় আগে থেকে চলা শিল্পপ্রকল্পের জন্য যে পরিবেশগত প্রভাব তার সঙ্গে নতুন প্রকল্প যোগ হলে কী প্রভাব পড়তে পারে তা একবারও বিবেচনা করা হচ্ছে না। যেনতেনপ্রকারেণ ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়াটাই এই সরকারের লক্ষ্য।
আরও পড়ুন : ফের বাইক দুর্ঘটনা মা উড়ালপুলে, আহত ৪
অতিমারি অজুহাত মাত্র। দেশের পরিবেশকে বেচে দেওয়ার কাজ আগেই শুরু হয়ে গেছে। পরিবেশ নিয়ে আগের সব অনিয়ম আর দুর্নীতিকে ছাপিয়ে গিয়েছে এই মোদি-শাহের সরকার। ভাবতে পারেন, ২০১৭সালে গোয়ার সমুদ্র-উপকূলের নারকেল গাছকে ঘাস হিসেবে চিহ্নিত করার এক চেষ্টা শুরু হয়েছিল সরকারি মদতে। আইনে নারকেল গাছ কাটায় বাধা আছে আর ঘাস কাটতে তো কোনোই বাধা নেই। পর্যটনব্যবসার নামে চলতেই পারে গাছ কাটা। একই গল্প উত্তরাখণ্ডের। সেখানে তীর্থযাত্রী আর পর্যটকের যাত্রা সুগম করতে হাইওয়ে নির্মাণের জন্য কাটা পড়েছে পঁচিশ হাজার গাছ, এমনটাই খবরে প্রকাশ।
অথচ আপনি যদি সরকারি পরিসংখ্যানে চোখ বোলান তবে আশ্চর্যজনকভাবে দেখবেন দেশে নাকি ‘ফরেস্ট কভার’ বা অরণ্য-আচ্ছাদন বেড়ে চলেছে। কী করে সম্ভব এমন অসাধ্যসাধন? এত গাছ কাটা চলছে অথচ অরণ্য বাড়ছে কি করে? ২০১৭র ভারতের অরণ্যের অবস্থা বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৫-২০১৭, এই দু’বছরে দেশের অরণ্য-আচ্ছাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৭৭৮ বর্গ কিলোমিটার। আসলে অরণ্য-আচ্ছাদনের সংজ্ঞাই বদলে ফেলেছে মোদি সরকার। এখন ১০% সবুজের আচ্ছাদনকেও অরণ্য আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। একদিকে হিসেবের কারচুপি আর অন্যদিকে কর্পোরেট মাফিয়াদের হাতে চলে যাচ্ছে দেশের অরণ্যসম্পদ। এই লুঠপাটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে।