রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা, জাতীয় সংহতি ও ঐক্য বজায় রাখা একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি। সেখানে রাজ্যগুলিকে সহযোগিতামূলক ব্যবস্থাপনায় অংশীদার করা রাষ্ট্রের আবশ্যিক দায়িত্ব। উল্লেখ্য স্বাধীনতার সময় থেকেই ভারত পার্টিশনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ। সেখানে অনুপ্রবেশ সমস্যা গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো বলে প্রচারিত হয়। আবার ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী শরণার্থীদের সাদরে অভিবাদন করা হয়েছে। যদিও ভারত ১৯৫১ সালের আন্তর্জাতিক রিফিউজি কনভেনশন স্বাক্ষর করেনি। আবার বিভিন্ন সময়ে নাগরিকতা আইনের মাধ্যমে নানান শর্তে বিদেশিদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গ্রাহ্য করা হয়েছে। কিন্তু ২০১৯ সালের নাগরিকতা আইনের পর থেকে নানান বিতর্ক মাথা ছাড়া দিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম ধর্মভিত্তিক চিন্তায় শরণার্থী-অনুপ্রবেশকারী বিভাজন এবং সেই প্রেক্ষিতে জাতীয় সুরক্ষার প্রসঙ্গে কেন্দ্রের তরফে রাজ্যগুলিকে দোষারোপ করা। অবশ্য সরকারি দস্তাবেজ বিপরীত কথা বলে!
এই গৌরচন্দ্রিকার উদ্দেশ্য— গত ২৭ মার্চ সংসদে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ভাষণের মাধ্যমে অনুপ্রবেশ ও অশান্তির জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দায়ী করা এবং তাঁরই প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাইয়ের রাজ্যসভায় তার একমাস আগে লিখিত একটি উত্তরে সীমান্তে বেড়া দেওয়ার তথ্য প্রদান— এই দুইয়ের সম্পর্ক বিশ্লেষণ ও মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণের কুযুক্তি খণ্ডন। অবশ্য এখানে রাজ্য বিজেপি ও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বিভাজন নীতি অনুঘটকের কাজ করে, তারও বিশ্লেষণ জরুরি। অমিত শাহ সংসদে বলেন যে, ‘‘ভারত বাংলাদেশের মধ্যে যে সীমানা রয়েছে তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ২২১৬ কিলোমিটারের মধ্যে ১৬৫৩ কিলোমিটার সীমানা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা হয়েছে। তার পাশে রাস্তা বর্ডার আউট পোস্ট তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাকি ৫৬৩ কিলোমিটার সীমানা আজও খোলা তার মধ্যে ১১২ কিলোমিটার (প্রায়) সীমানা বেড়া দেওয়া সম্ভব নয়, প্রাকৃতিক ভৌগোলিক কারণে। কিন্তু বাকি ৪৫০ কিলোমিটার সীমানায় বেড়া দেওয়া রাজ্য সরকারের জমি না দেওয়ার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যেখানে সীমানা বেড়া দিতে যাওয়া হচ্ছে সেখানে রাজ্যের শাসকদলের ক্যাডাররা আন্দোলন করছে বা ধর্মীয় উসকানি দিচ্ছে।’’
দেখুন দ্বিচারিতা। একবার বলেন জমি না পাওয়ার জন্য সীমানা দেওয়া যাচ্ছে না। আরেকবার বলেন শাসকদলের আন্দোলনের জন্য বেড়া দেওয়া যাচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, খোলা সীমানার সমস্যা আজকের নয়। কিন্তু অনুপ্রবেশের জন্য পূর্বে কোনও কেন্দ্র সরকার কোনও রাজ্য সরকারকে এভাবে দোষারোপ করেছে কি না তা জানা যায়নি। তাহলে কি কেন্দ্র সরকার সীমানা সুরক্ষার জন্য যে সমস্ত প্রযুক্তিগত কৌশল নীতি বা বর্ডার আউটপোস্ট নীতি বা কর্মী ব্যবস্থাপনা কিংবা বিএসএফের তদারকি এলাকা ১৫ কিমি থেকে বাড়িয়ে ৫০ কিমি করেছে; সেই সব নীতি ও ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ব্যর্থ? জমি সমস্যা কি রাজ্যের দায় নাকি কেন্দ্র গরিব মানুষদের উপযুক্ত দাম দিতে চায় না?
আরও পড়ুন-কেন ইডি-সিবিআই তদন্ত করবে না, প্রশ্ন তৃণমূলের
তিনি আরও বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি জমি দিয়েও দেন এবং তিনি সীমানা বেড়া দিয়ে দিলেও যে ১১২ কিমি সীমানা ভৌগোলিক কারণে বেড়া দেওয়া অসম্ভব সেখান থেকে অনুপ্রবেশ কীভাবে আটকানো সম্ভব এবং ১১২ কিমি সীমানা বেড়া না দিতে পারলে দু’হাজার কিমি বেড়া দেওয়া উদ্দেশ্য কার্যকর হতে ব্যর্থ। তাহলে আবার প্রশ্ন, আপনি যখন নিজেই স্বীকার করছেন যে, একজনের অনুপ্রবেশের জন্য ওই ১১২ কিমি যথেষ্ট; তাহলে অনুপ্রবেশের জন্য রাজ্য সরকার কীভাবে দায়ী? আপনি সীমানা সুরক্ষার জন্য এত লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করে প্রযুক্তির ব্যবহার-সহ নানান ব্যবস্থা করলেন, সবটাই বৃথা? নিজের দোষ ঢাকতে রাজ্যকে দোষারোপ নাকি উদ্দেশ্যটা রাজনৈতিক? এ-বিষয়ে শাহজি কতটা ঠিক, সংসদে অধ্যাপক সৌগত রায়, সুখেন্দুশেখর রায় ও সাকেত গোখেল তুলে ধরেছেন।
উত্তর পাওয়া গেল এপ্রিলের শুরুতে একটি বেসরকারি গণমাধ্যমের সামিটে শাহজির বক্তব্যে। তিনি বললেন, ২০২৬ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে বিজেপিকে বাংলায় ক্ষমতায় আনলেই সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চলে অশান্তি থাকবে না! তাহলে আবার প্রশ্ন— আপনাদের সহায়তাতেই বা নিষ্ক্রিয়তার ফলেই কি অনুপ্রবেশ ঘটছে এবং অশান্তি তৈরি হচ্ছে? সে অন্য রাজ্য বা অন্য দেশ যেখান থেকেই হোক না কেন! আর তৃণমূল কংগ্রেস সেটা ধরে ফেলেছে বলে উল্টে রাজ্য সরকারকেই দোষ দিচ্ছেন?
এবার আসা যাক নিত্যানন্দ রাইয়ের দেওয়া কিছু তথ্যের বিষয়ে। ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাজ্যসভায় এক লিখিত উত্তরে জানান, ভারত-বাংলাদেশের ৪০৯৬.৭ কিমি সীমানার মধ্যে ৩২৩২.২ কিমি বেড়া দেওয়া গেছে। বাকি রয়েছে ৮৮৪.৪ কিমি। অর্থাৎ বাংলা বাদেও অন্য রাজ্যে ৪১৫ কিমি (প্রায়) বর্ডার খোলা। তার মধ্যে ১৭৪.৫ কিমি বেড়া দেওয়া প্রাকৃতিক ভৌগোলিক কারণে অসম্ভব। অর্থাৎ অন্য রাজ্যে (১৭৪-১১২) ৬২ কিমি বেড়া দেওয়া অসম্ভব।
রাই বাবু মার্চ মাসের শুরুতেই আর এক প্রশ্নের লিখিত উত্তরে জানান, গত ১৩ মাসে অর্থাৎ ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২৫-এর জানুয়ারি অবধি বিএসএফ ২৬০১ জন বাংলাদেশিকে বেআইনিভাবে ভারতে প্রবেশের জন্য আটক করেছে। মাথায় রাখতে হবে আটক বাংলা-সহ অন্য রাজ্যে থেকেও হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন (১) বাংলা বাদে যে সকল রাজ্যে সীমানা খোলা, ভৌগোলিক প্রাকৃতিক কারণে, সেখান থেকে অনুপ্রবেশ হয় না? (২) অন্য রাজ্যে যে ৪১৫ কিমি সীমানায় বেড়া দেওয়া গেল না তার কী কারণ? সেখানে তো ডবল ইঞ্জিন সরকার! জমি সমস্যা? মানে রাজ্য সরকার জমি দিচ্ছে না? অনুপ্রবেশকে মদত দিচ্ছে? (৩) গত তেরো মাসে যে ক’জন অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়ল তা কীভাবে সম্ভব হল? রাজ্য সরকার সহযোগিতা করেনি? বিএসএফ তাহলে অন্য ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ রুখতে ব্যর্থ? নাকি অমিত শাহ শুধুই উসকানি রাজনীতি করলেন?
আরও পড়ুন-যে বিজেপি চক্রান্তের নেপথ্যে তারাই কুম্ভীরাশ্রু ঝরাচ্ছে, জাতীয় মহিলা কমিশনকেও নিশানা দেবাংশুর
আসলে এসব প্রশ্ন বাংলার বিজেপি ও বিরোধী দলনেতার মগজস্থ হবে না! কারণ তাঁরা ধর্মীয় বিভাজন নীতি অনুসরণ করেই রাজনীতি করেন। মিথ্যাচার, দ্বিচারিতা, তথ্য-তত্ত্বের ভোজবাজি এগুলো তাদের অস্ত্র। তাইতো জাতীয় সুরক্ষা নিয়ে হেলায় ছেলেখেলা করতে পারে অগ্নিবীর নামক প্রকল্পের নামে! তৃণমূল তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সাংবিধানিকতা ও যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি অনুযায়ী কাজে বিশ্বাসী। তাই বিজেপির মিথ্যার ফল আবার ২০২৬-এ তারা পাবে। যেমন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘কুরসি কি পেটি বাঁধ লিজিয়ে, মৌসম বিগার নে ওয়ালা হ্যায়।’ ২০২৬-এ আপনাদের দ্বিচারিতার
মুখোশ খুলে বাংলা আবার নিজের মেয়েকেই সরকারে আনবে।